অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে আফগান তালিবান কি লড়তে সক্ষম?


ফাইল-পাকিস্তানের আধা সামরিক বাহিনীর একজন সৈন্য (বামে) এবং তালিবান যোদ্ধারা এই দু দেশের সীমান্তে তাদের নিজ নিজ দিকে পাহারা দিচ্ছে। খাইবার জেলার তোরখাম, পাকিস্তান। ৫ সেপ্টেম্বর ২০২১অ
ফাইল-পাকিস্তানের আধা সামরিক বাহিনীর একজন সৈন্য (বামে) এবং তালিবান যোদ্ধারা এই দু দেশের সীমান্তে তাদের নিজ নিজ দিকে পাহারা দিচ্ছে। খাইবার জেলার তোরখাম, পাকিস্তান। ৫ সেপ্টেম্বর ২০২১অ

আফগান তালিবান তাদের শাসনের আড়াই বছরের মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি জুড়ে অতি-রক্ষণশীল শাসন সুসংহত করেছে কিন্তু এখনও তাদের যোদ্ধাদেরকে একটি ঐতিহ্যবাহী সামরিক বাহিনীতে পরিণত করতে পারেনি।

ভয়েস অফ আমেরিকা বিশ্লেষকদের সাথে এ বিষয়ে কথা বলেছে, যারা জানিয়েছেন যে ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত গোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তা হুমকি কার্যকরভাবে মোকাবেলা করার জন্য এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানের সাথে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা সামলানোর জন্য প্রাক্তন বিদ্রোহী বাহিনীর কোন সামরিক বাহিনীকে অনুসরণ করার প্রয়োজন নেই।

ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের বৈশ্বিক সামরিক বাহিনী সম্পর্কিত বাৎসরিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আফগান তালিবানের দেড় লক্ষ সক্রিয় যোদ্ধা রয়েছে। সেনাপ্রধান কারি ফাসিহউদ্দিন ফিতরাত রয়টার্সকে গত বছর বলেছিলেন, এই বাহিনীতে সরকারের আরও ৫০ হাজার যোদ্ধা বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে তবে তা কবে নাগাদ করা হবে তার কোন সময়সীমা তিনি সুনির্দিষ্ট করে বলেননি।

তালিবানের সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে তারা প্রকাশ্যে প্রতিরক্ষা বাজেট প্রকাশ করেনি। প্রতিরক্ষা বাহিনীকে আনুষ্ঠানিক কাঠামোর অধীনে আনার জন্য তারা বিশেষ বাহিনীর অধীনে তিনটি ব্যাটালিয়ান এবং আটটি পদাতিক দল তৈরি করেছে।

২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে হঠাৎ করে বিশৃঙ্খলভাবে আন্তর্জাতিক বাহিনী প্রত্যাহার করে নেওয়ার সময় আফগান ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি ফোর্সেস (এএনডিএসএফ) ভেঙ্গে পড়ে। তারপর তাদের আয়ত্বে আনা সামরিক বাহিনীর কাছে নানা ধরণের সাঁজোয়া যান, কামান, তিনটি হালকা বিমান এবং ১৪টি হেলিকপ্টার রয়েছে।

তালিবানের কাছে এএনডিএসএফ থেকে রাশিয়ার কয়েকটি যুদ্ধ হেলিকপ্টারও রয়েছে।

ফাইল - যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সৈন্য প্রত্যাহারের দ্বিতীয় বার্ষিকিীতে তালিবান যোদ্ধাদের উল্লাস । কান্দাহার, কাবুল। ,ৈআগস্ট ১৫,২০২৩।
ফাইল - যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সৈন্য প্রত্যাহারের দ্বিতীয় বার্ষিকিীতে তালিবান যোদ্ধাদের উল্লাস । কান্দাহার, কাবুল। ,ৈআগস্ট ১৫,২০২৩।

সক্ষমতা

যদিও যুক্তরাষ্ট্র বাহিনী আফগানিস্তানে প্রায় ৭ শ’ কোটি ডলার মূল্যের সামরিক সরঞ্জাম রেখে গেছে তবে বিশেষজ্ঞরা মূল্যায়ন করেছেন যে কিছু অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি পরিচালনা (বা ব্যবহার) করার ক্ষেত্রে তালিবানের ক্ষমতা সীমিত।

ইউএস ইনস্টিটিউট অফ পিসের উর্দ্ধতন বিশেষজ্ঞ আসফানদিয়ার মির ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “মেইন্টেন্যান্স চুক্তি ছাড়া বিদেশী সরবরাহকারীদের কাছ থেকে পাওয়া সরঞ্জামগুলোর বেশীর ভাগই সত্যিকার অর্থে ব্যবহার করা প্রায় অসম্ভব।ঐ সরঞ্জামগুলো মূলত আফগানিস্তান ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি ফোর্সেস বা এএনডিএসএফকে দেওয়া হয়েছিল।

কুইন্সি ইনস্টিটিউটের মধ্যপ্রাচ্য কর্মসূচির উপ-পরিচালক অ্যাডাম ওয়েনস্টাইন ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন যে এএনডিএসএফের মতো তালিবানও তাদের বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে।

২০১২ সালে আফগানিস্তানে দায়িত্ব পালন করা সাবেক আমেরিকান নৌ কর্মকর্তা ওয়েনস্টেইন বলেন, “এরা মূলত এখনও অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করছে যাদেরকে মাঝে মাঝে সৈনিক হিসেবে কাজ করার মৌলিক জিনিষগুলো শেখাতে হয়।

বিদ্রোহভাব

বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০ বছর ধরে চলা আমেরিকার নেতৃত্বাধীন যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আফগানিস্তানের তালিবান এখনও বিদ্রোহের মেজাজে রয়েছে।

ওয়েনস্টাইন বলেন, “এই লড়াই পৃথক ইউনিটগুলিকে কৌশলগত পর্যায়ে একটি আধা-স্বায়ত্তশাসিত উপায়ে কাজ করার সুবিধা করে দিয়েছে।” তিনি আরও বলেন, প্রাক্তন বিদ্রোহীরা এখনও তাদের যোদ্ধাদের উপর সংহতি এবং নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের শীর্ষ পরামর্শক গ্রায়েম স্মিথ বলেন, “তালিবানের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে তাদের জনপ্রিয়তা”।

স্মিথ আফগানিস্তানে জাতিসংঘের রাজনৈতিক বিষয়ক কর্মকর্তা হিসেবে ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন। তিনি বলেন, তালিবান বাহিনীকে স্বাভাবিক সামরিক বাহিনীর মতো দেখা উচিত নয়, কারণ স্থানীয় চাহিদার অনুযায়ী তাদের সংখ্যা পরিবর্তিত হয়।

স্মিথ এই বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেন, “অপ্রকাশিত নেটো গবেষণা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে, যে বছরগুলিতে (সেখানে) যুক্তরাষ্ট্র এবং নেটোর সেনা উপস্থিত ছিল (তখন) অধিকাংশ তালিবান যোদ্ধা তাদের নিজেদের বাড়ির এক কিলোমিটারের মধ্যে লড়াই করেছে। “স্থানীয়রা বাইরে গিয়ে নেটো সেনাদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে এবং তারপরে দুপুরের খাবারের জন্য বাড়িতে গিয়েছে এবং বাড়িতে রান্না করা খাবার খেয়েছে এবং তারপরে বিকেলে আবার ফিরে গিয়েছে এবং আরও নেটো সেনাদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে।”

স্মিথ বলেন, সহজেই যোদ্ধা পাওয়া এবং লুকানোর জায়গা থাকার কারণে তালিবান বাহিনীর জন্য তা ছিল উল্লেখযোগ্য সুবিধা।

নিরাপত্তাজনিত হুমকি

আফগান তালিবান কার্যকরভাবে সশস্ত্র প্রতিরোধ দমন করলেও ইসলামিক স্টেট খোরাসান প্রদেশ যা আইএস-কে বা যারা আইএসকেপি নামেও পরিচিত, তারা অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রতি উল্লেখযোগ্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মীর বলেন, “এটা বিদ্রোহ যা একই সাথে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং অবিরাম এবং তালিবানের জন্য একটি একটি আদর্শগত চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।

তালিবান আইএস-কে এর শীর্ষ কমান্ডারদের হত্যা করেছে। এই গোষ্ঠীর সেলগুলোকে নির্মূল করেছে এবং আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে তাদেরকে ভূখণ্ড দখল করে থাকতে বাধা দিয়েছে।

ওয়েনস্টাইন বলেন, “এটা তালিবান নিরাপত্তা বাহিনীর দক্ষতার প্রমাণ। তিনি আরও বলেন, “আইএসকেপি নেতাদের এবং আইএসকেপি সেলগুলি কোথায় আছে সে সম্পর্কে তারা জ্ঞান রাখে বলে মনে হচ্ছে এবং আপাতদৃষ্টে মনে হয় তারা তাদেরকে নিরাপদ দূরত্বে রাখতে পারছে।

বাহ্যিকভাবে, আফগানিস্তানের তালিবান পাকিস্তানের কাছ থেকে হুমকির সম্মুখীন। পাকিস্তান আফগানিস্তানের একমাত্র প্রতিবেশী যার সঙ্গে কাবুলের সীমান্ত বিরোধ রয়েছে। তালিবান ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী কথিত আস্তানাগুলির বিরুদ্ধে আফগান ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে দু'বার হামলা চালিয়েছে - একবার ২০২২ সালের এপ্রিলে এবং এই বছরের ১৮ মার্চ তারিখে।

পাকিস্তান আফগান তালিবানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানবিরোধী জঙ্গিদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ করে তবে তালিবান সরকার তা অস্বীকার করেছে।

এ মাসে, কাবুল সীমান্ত বরাবর বেশ কয়েকটি পাকিস্তানি সেনাচৌকি লক্ষ্য করে পাল্টা হামলা চালিয়েছে। এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের পূর্বতন পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়ে, তালিবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, পাকিস্তান যদি সীমান্তে আরও হামলা চালায় তবে এর “খুব খারাপ পরিণতি হবে যা পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে”।

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই

ভয়েস অফ আমেরিকা যে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছে তারা একমত যে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম পারমাণবিক শক্তিধর সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো অস্ত্রশস্ত্র তালিবানের নেই – তবে তারা বলছেন যে কাবুল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অপ্রচলিত কৌশল অবলম্বন করতে পারে।

ওয়েন্সটেইন বলেন (পাকিস্তানের অভ্যন্তরে) সম্ভবত আরও বড় ধরণের হামলা চালানোর সুযোগ করে দেওয়ার জন্য তালিবান টিটিপির (তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান) তৎপরতায় বাধা না দিয়ে বরং আরও সুযোগ করে দেবে। ওয়েনস্টেইন আরও বলেন, তালিবান টিটিপিকে “পাকিস্তান রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে অনেকটাই যেন বীমা পলিসির মত দেখে।

মীর সতর্ক করে বলেন, আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দিলে তা অবশ্যই “আন্তর্জাতিকভাবে উদ্বেগ সৃষ্টি করবে”।

স্মিথ বলেন, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ার সাথে সাথে কাবুল গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক প্রকল্পগুলিও বানচাল করতে পারে। তিনি বলেন, এরকম একটি হচ্ছে সেন্ট্রাল এশিয়া- সাউথ এশিয়া ইলেক্ট্রিসিটে ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ট্রেড প্রজেক্ট যা কাসা-১০০০ নামে বহুল পরিচিত প্রকল্প যা মধ্য এশিয়া থেকে আফগানিস্তান হয়ে পাকিস্তানে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাকিস্তান মধ্য এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য যে স্থলপথ ব্যবহার করে থাকে আফগান তালিবান তাতে বাধাদিতে পারে।

পাকিস্তান-আফগান সীমান্ত ঘন ঘন সংঘর্ষ এবং সীমান্ত বন্ধ থাকার কারণে দু’দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য হ্রাস পাওয়ায় পাকিস্তানের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিনিধি দল এই সপ্তাহে কাবুলে আফগান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছে।

বিশেষজ্ঞরা একমত যে প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আফগানিস্তানের তালিবানের ক্ষীণ করে তবে সতর্ক করে দিয়েছেন যে আফগানিস্তানের এই বর্তমান শাসক অসমযুদ্ধ পরিচালনা করতে পারে যেখানে আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী এবং স্থানীয় দলকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে যারা অনায়াসে প্রয়োজনে শাবল ছেড়ে বন্দুক হাতে নিতে পারে।

XS
SM
MD
LG