অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

কি কারনে ইউরোপীয় মুসলমান তরুন সমাজ জঙ্গীবাদে আকৃষ্ট হচ্ছে


সেলিম হোসেন

প্যারিস হামলার পর ইউরোপ জুড়ে যে নিরাপত্তা আশংকার সৃষ্টি হয় তারই প্রেক্ষিতে ইউরোপীয়ন সরকারসমূহ বোঝার চেষ্টা করে কি কারনে ইউরোপীয়ন মুসলমান তরুন সমাজ জঙ্গীবাদে আকৃষ্ট হচ্ছে; ইসলামিক ষ্টেটে যোগ দিচ্ছে, নিজ দেশেই কেন জঙ্গীবাদী কর্মকান্ড ঘটাচ্ছে। ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদদাতাদের পাঠানো রিপোর্ট থেকে শোনাচ্ছেন সেলিম হোসেন।

please wait

No media source currently available

0:00 0:06:04 0:00
সরাসরি লিংক

ইসলামিক ষ্টেট জঙ্গী দলে যে তরুন ইউরোপীয়ন মুসলমানেরা সম্প্রতি যোগ দিচ্ছেন তার মাত্রা ভয়াবহ। দ্রুত তারা বদলে ফেলছে নিজেদরকে। ধর্মতত্ব বিবেচনায় নিয়ে বা ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যে তারা তা করছে সেকথা বলা মুস্কিল। জিহাদী হওয়া ওই তরুনদের এক ধরনের ষ্টাইল; লাইফষ্টাইল।

প্যারিস হামলার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত ছিল তাদেরকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন বেলজিয়ান কর্তৃপক্ষ। সন্দেহভাজনদের প্রতিবেশী ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে যে ধারণা মিলেছে তাতে বোঝা যায় ধর্মীয় বিশ্বাস বা চেতনা তাদের কাছে জিহাদী হবার প্রেরণা নয়; জিহাদীদের জীবন যাপনের ধরণ তাদেরকে আকৃষ্ট করে। তারা জিহাদী হওয়া’কে এক ধরনের এ্যাডভেঞ্চার হিসাবে নিয়েছে।

ব্রাসেলসের থিংক-ট্যাংক প্রতিষ্ঠান Egmont Institute এর সিনিয়র ফেলো অধ্যাপক রিক কুলসায়েত বললেন, “ইউরোপের এই তরুন জিহাদী দলের প্রথম সফল হামলা এটি। তৃণমূল পর্যায়ের অসহায় তরুনদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে আইএস জঙ্গীরা তাদরেক দলে ভিড়িয়ে এই হামলা ঘটায়”।

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্যারিস হামলায় জড়িত অনেকেই ধর্মনিরপেক্ষ জীবনে অভ্যস্থ্য ছিল। তাদের অনেকে আবার মাদকাসক্ত বা ছোটোখাটো অপরাধের সঙ্গেও যুক্ত ছিল। জিহাদী হবার পরও তারা এমনই ছিল, বলে জানান তাদের পরিচিতরা।

প্যারিস হামলায় আত্মঘাতি বোমা বিস্ফোরণে ব্যার্থ হওয়া তরুন সালাহ আবদেসালামের ভাই মোহামেদ আবদেসালাম জানান, তার ভাই খুব একটা ধার্মিক ছিল না, মসজিদে যেতো না, মাঝে মধ্যে নামাজ পড়তো; জিন্স-শার্ট এসব আধুনিক পোষাক পরতো। সে যে জিহাদী এমন কোনো লক্ষন তার চাল চলন বেশ ভুষায় কখনো প্রকাশ পায়নি।

প্যারিস হামলায় জড়িত দুই তরুন যারা সেদিন মারা যায়, নিহত সালাহ ও তার ভাই ব্রাহিম মোলেনবিক এলাকার অভিবাসি অধ্যুষিত ব্রাসেলসে একটি বার চালাতো। সেখানে মাদক কেনাবেচা হতো এই অভিযোগে অক্টোবরেরর শেষদিকে কর্তৃপক্ষ সেই বারটি বন্ধ করে দেয়। তো ধর্শীয় চেতনা; বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের চেতনায় বিশ্বাসী হলে বার ব্যাবসা করার কথা না।

তবে তদন্তে দেখা গেছে ফ্রান্সে সম্প্রতি ছোটোখাটো অপরাধ করে জেলখাটা তরুনদেরকে জিহাদী হিসাবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে নানা প্ররোচনায় আকৃষ্ট করে। উদাহরণস্বরূপ শার্লী এবদোহ’তে হামলার ঘটনায় সম্পৃক্ত এ্যামেদি কওলিবালি যে গত জানুয়ারীতে এক ভয়ংকর গুলির ঘটনা ঘটায়, তারও বড় আপরাধ ঘটানোর কোনো আতীত ছিল না।

প্যারিস হামলায় জড়িত ওই দুই ভাই কি তাহলে সুচতুরভাবে জঙ্গীদের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে গোপনে কাজকর্ম চালাচ্ছিল নাকি যে ইউরোপীয়নরা তাদের জিহাদী আদর্শ গ্রহণ করেছে, তারা ধর্মপ্রান হলো কি হলো না; ইসলামিক ষ্টেট সে বিষয়ে গুরুত্ব দেয় না? অথবা এমনও কি হতে পারে যে ওই তরুণরা জিহাদি হওয়াকে শ্রেফ লাইফষ্টাইল হিসাবে নিয়েছে বা তাদের অন্তরে থাকা রাগ প্রশমনের পথ হিসাবে বেছে নিয়েছে?

ব্রাসেলসের থিংক-ট্যাংক প্রতিষ্ঠান Egmont Institute এর সিনিয়র ফেলো অধ্যাপক রিক কুলসায়েত বললেন ইউরোপের তরুন জিহাদিষ্টদেরকে, তাদের আগে যারা জিহাদী হয়েছিলেন তাদের মতো ধর্মভীরু বা চরমপন্থী বলে মনে হয় না।

“আংশিকভাবে এসব ঘটছে ক্রোধের কারনে। আশি এবং নব্বইয়ের দশকে পাকিস্তান আফগানিস্তান বা ইরাকে যারা যে বয়সে জিহাদে অংশ নিতে যেতো তাদের তুলনায় এই প্রজন্মের জিহাদিষ্টদের বয়স অনেক কম। এখনকার এইসব জিহাদিস্টদের সামাজিক মাধ্যমের পোস্ট পড়ে বোঝা যায় তাদের বিদ্রোহী তারুন্যের অস্থিরতার সঙ্গে আত্মমগ্নতা মিলে অন্য এক ধরনের চেতনা তাদের মনে কাজ করে।

তাদেরকে তিনি পপ-জিহাদিষ্ট আখ্যা দেন। ইউরোপে Radicalization বিষয়ক বিশেষজ্ঞ রিক আরো বলেন: “আমি পুরোনো ধরনের জিহাদিস্ট হলে এই নতুন তরুন জিহাদিস্টদের গননার মধ্যেই ধরতাম না”।

খুচরো সন্ত্রাসী দল, কিশোর অপরাধ অথবা মাদক চোরাচালানীর মত এখন সিরিয়ায় গিয়ে ইসলামিক ষ্টেটে যোগদানের বিষয়টি তরুণদের কাছে ফ্যাশনের মতো হয়ে গেছে।

রিক মনে করেন ইসলামিক ষ্টেটে নতুন যারা যোগ দিচ্ছে তারা সালাফি জিহাদিস্ট কিনা তার পরোয়া করে না তারা। ইসলামিক ষ্টেটের মূল লক্ষ্য হচ্ছে তরুন জিহাদিষ্টরা ধর্ম মানুক না মানুক সালাফিবাদ মানুক বা না মানুক তাতে তাদের কিছু যায় আসেনা। শূল লক্ষ্য ইউরোপ আক্রমণ ঘটাতে তাদরেক কিভাবে সর্বোচ্চ ব্যাবহার নিশ্চিত করা যায়। সমাজের দুর্বল অসহায় তরুনদরকে দলে ভেড়ানোর টার্গেট তাদের।

প্যারিস হামলার ঘটনায় জড়িতদের অনেকেই এমন ছিল এ প্রমান মিলেছে ইতিমধ্যেই। ১৩ই নভেম্বরর সন্ত্রাসী ঘটনার অন্যতম প্রধান নেতা আবদেলহামিদ এ্যাবাটেডের চাচাতো বোন হাসনা আইত বৌলাচেনের পোষাক দেখে তেমনটা আঁচ করা যায়। তার পরনে ছিল কাউবয় হ্যাট, বুট, জিন্স এবং নিকাব। সেইন্ট ডেনিসের ৭ ঘন্টার গোলাগুলির সময় মারা যাওয়া এই তরুনী মাত্র ৬ মাস আগে থেকে এই জিহাদিষ্ট কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল।

তার পরিবার ও স্বজনরা জানায় ২৬ বছর বয়সী হাসনা মাত্র কয়েকমাস আগে মে মাসে সালাফিবাদী জিহাদী দলে যোগ দেয়ার আগেও ছিল পার্টি গার্ল। সিগারেট টানতো, ভদকা পান করতো এবং ছিল মাদকাসক্তও। অস্থির কৈশর ও তারুন্যের সময় সে তার নিজের জগতে একান্তে বাস করতো।

প্যারিস হামলায় জড়িত সর্বকনিষ্ঠ ফ্রান্সে জন্মগ্রহনকারী তরুন বিলাল হাদফীও মাত্র কমাস আগে এই সালাফী আদর্শে উজ্জীবিত হয়। চলতি বছর জানুয়ারীতে প্যারিসে শার্লী এবদোহ হামলার পর সে বদলাতে থাকে। ঐ হামলার পর তার শিক্ষক বেলজিয়ামের রেডিও ওয়ানের এক সাক্ষাৎকারে হাদফীর বক্তব্য সম্পর্কে বলেন, “সে বলেছিল ঐ ম্যাগাজিনে হামলা করাটা ঠিক হয়েছে, কারন সেটি তার ধর্ম নিয়ে কটাক্ষ করেছে”।

২০ বছর বয়সী এই তরুন সম্পর্কে তার মায়ের বক্তব্য হচ্ছে, সে একটি টাইম বোমা, ফেব্রুয়ারীতে সে সিরিয়ায় চলে যায় জিহাদে অংশ নিতে। ইউরোপে ফিরে প্যারিসে স্টেডিয়ামের বাইরে সে আত্মঘাতি বোমা হামলা চালায়।

ইসলামিক জঙ্গীবাদ নিয়ে গবেষণা করেন পিটার ওষ্টায়েন। তিনি বললেন, “এইসব তরুনেরা অতি দ্রুত, মাস বা কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই জঙ্গীবাদী আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে পড়ছে”। এর অনেকগুলো কারন তিনি উল্লেখ করেন। “বখে যাওয়া তরুন তরুনীরা ধর্মগ্রন্থের উদ্ধৃতি থেকে অনেক সময় আকৃষ্ট হয়। তার সঙ্গে ইসলামিক ষ্টেটের নৃশংস বর্বরতাকে তারা বীরত্ব হিসাবে নেয়”। সামাজিক বৈসম্য, নানা অসঙ্গতি, ধর্ম জাতিগত বৈষম্য এসবও তাদরকে জঙ্গীবাদে আকৃষ্ট করে।

বেলজিয়াম এবং ফ্রান্সে ISIS এর রয়েছে শক্ত অনলাইন নেটওয়ার্ক। রয়েছে ফ্রান ক্লাব। তরুন তরুনীদরেক বয়োসন্ধিকালের অস্থিরতাকে কাজে লাগিয়ে জিহাদের প্রতি আকৃষ্ট করে জঙ্গীরা। ধর্ম সামাজিক বৈসম্য পুঁজিবাদ ইত্যাদি নানা আদর্শের কথা বলে তারা তাদেরক দলে নেয়। উপরন্তু অর্থ বিত্ত ও পরকালের পুন্যের লোভ দেখানো হয়। রিক বলেন, “এখন এটি একটি প্রজন্মগত সংঘাত।

XS
SM
MD
LG