অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যাবহার না করার অনুরোধ মিয়ানমার সরকারের


সেলিম হোসেন

মিয়ানমারের নতুন এনএলডি সরকারের তরফে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের প্রতি রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যাবহার না করার অনুরোধ এবং রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্ব যাচাই প্রক্রিয়া শুরুর ঘোষণার পর নতুন করে রোহিঙ্গা মুসলমানদের মধ্যে আশংকার সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে Paul Vrieze এর তথ্য নিয়ে রয়েছে শুনুন সেলিম হোসেনের রিপোর্ট।

please wait

No media source currently available

0:00 0:05:44 0:00
সরাসরি লিংক

বাউদুফা শরনার্থী শিবিরে হাত পা গুটিয়ে বিষন্ন মুখে বসে ছিল আট সন্তানের পিতা রোহিঙ্গা শরনার্থী আইয়ুব খান। সামনে একটি টুলের ওপর বিক্ষিপ্ত পড়ে আছে কাশির সিরাপ ও ব্যাথার ওষুধসহ কিছু ওষুধ; এটিই এখন তার ফার্মেসী।

আইয়ুব খান বললেন, “এখানে আমি এই ছোট্ট ফার্মেসী চালানোর চেষ্টা করছি। সংঘাত শুরুর আগে ডাউনটাউন সিতউয়ি’তে আমাদের ৩টি ফার্মেসী ছিল। আমাদের চমৎকার একটি জীবন ছিল; এখন কিছুই নেই।”

বাউদুফা শরনার্থী শিবিরে এখন ৮ সন্তানের পরিবার নিয়ে অতি কষ্টে দিন পার করছেন আইয়ুব খান। ২০১২ সালে রাখাইন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর আইয়ুব খানের মতো ৪ হাজার ৮০০ রোহিঙ্গা মুসলমান বাস্তচ্যুত হয়ে জাতিসংঘ পরিচালিত বিভিন্ন শরনার্থী শিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

এই শরনার্থীদের আয়ের কোনো ভালো উৎস নেই। কেই ট্রিশা চালান, কেউ ফেরী করেন কেউ আবার মাছ ধরে তা বিক্রি করে কোনোমতে জীবিকা নির্বাহ করছেন। অল্প কয়েকজন ছোটখাটো দোকান করেছেন অথবা সাহায্য কর্মী হিসাবে কাজ করছেন।

গত বছর পর্যন্ত দারিদ্র পিড়িত ঐসব শরনার্থীর জীবন ছিল মানবেতর। উপরন্তু তাদের ওপর ছিল সরকারী ভ্রমন নিষেধাজ্ঞা। বিভিন্ন শরনার্থী শিবিরে বসবাসরত ১ লাখ ২০ হাজার শরনার্থীর অনেকেই পালিয়ে বিপদজনক, নৌকা ভ্রমনের মাধ্যমে মালয়েশিয়া পাড়ি জমানোর চেষ্টা করেন।

আইয়ুব খান জানান, “ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রসি NLD (National League for Democracy) দেশটির ক্ষমতায় আসার পর বিপদজনক মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রবণতা কমেছে। আমি এবং অনেকেই আশা করছেন পরিস্থিতির উন্নতি হবে; আমাদের জন্য ভালো সময় আসবে”।

আইয়ুব খানের আশাবাদী মন্তব্যের সুর ধ্ধনিত হয় রোহিঙ্গা শরনার্থী শিবিরের আরো অনেকের মন্তব্যেও।

তবে সম্প্রতি মিয়ানমার সরকারের তরফে বলা হয় রোহিঙ্গা নামে অনেক বাংগালি এদেশে আসছে; সেই কারনে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের প্রতি রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যাবহার না করার অনুরোধ করা হয়। বিষয়টি নতুন বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। মিয়ানমারে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্সিয়েল স্কট বলেছেন যুক্তরাষ্ট্র স্থানীয় সম্প্রদায়ের যে নাম, সে নামেই ডাকবে।

“নামের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বাভাবিক চর্চা হচ্ছে, যে কোনো সম্প্রদায়ের নিজস্ব নাম রাখা তাদের নিজেদের অধিকার; আর তারা যা চায়, সেই নামেই আমরা তাদেরকে সম্বোধন করবো। এটি কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয় নয়, স্বাভাবিক বিষয়”।

এছাড়া গনমাধ্যমের রিপোর্টে বলা হয় মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব যাচাইয়ের বিতর্কিত কাজ শুরু করছেন; তা নিয়ে কিছুটা শংশয় দেখা দিয়েছে।

জাতিসংঘ শরনার্থী সংস্থা UNHCR’s এর মিয়ানমার অফিসের মুখপাত্র কাসিতা রোচানাকর্ন ঐ রিপোর্টের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত করে ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেন, “মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে আমাদেরকে বলা হয়েছে যে নাগরিকত্ব যাচাই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে”।

জাতিসংঘ শরনার্থী সংস্থা সরকারের কাছে আহবান জানিয়েছে এই প্রক্রিয়া যেনো স্বচ্ছ হয় এবং এতে যেনো কারো ভোগান্তি না হয় সরকার যেনো সেদিকে নজর রাখে।

ওয়াশিংটনে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রর পররাষ্ট্র দফতরের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক উপদেষ্টা এ্যাম্বাসেডর ডেভিড এন স্যাপারষ্টিনের কাছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের অবস্থা প্রসঙ্গে মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা রোহিঙ্গা মুসলমানদের অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন। বার্মার সরকার এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে এ অবস্থা নিরসনে আলোচনা করে চলেছি আমরা। সেখানে যা ঘটছে তা ঠিক নয়; রোহিঙ্গা মুসলমানদের অধিকার নিশ্চিত করা উচিৎ। শুধু মুসলমানরাই নয়, সেখানে আরো অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ অসুবিধায় আছেন। আমি যখন বার্মায় ছিলাম তাদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখেছি। তাদের সঙ্গে এং সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেছি কিভাবে এর সমাধান করা যায় তা নিয়ে”।

মিয়ানমারের আগের সেনা শাষক; দেশের প্রায় ১০ লক্ষ গৃহহীন মুসলমানের নাগরিকত্বের যে দাবী বাতিল করে দিয়েছিল; এনএলডি সরকারের সাম্প্রতিক কিছু পদক্ষেপে মনে হচ্ছে তারা সেটি করবেন না।

প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ঐ গৃহহীনদের বেশিরভাগেরই বসবাস রাখাইনে এবং তাদের দাবী ছিল তাদেরকে রোহিঙ্গা নামে নাগরিকত্ব দেয়া হোক। আগের সেনা শাষক বলেছিল তাদের অনেকেই বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে এখানে এসেছে এবং তাদেরকে বাঙ্গালী নামে অভিহিত করা হয়েছিল। স্থানীয় শক্তিশালী ন্যাশনালিষ্ট বুদ্ধিষ্ট মুভমেন্টের মূল কথাও ছিল সোটিই।

নাগরিকত্ব যাচাই প্রক্রিয়া (controversial 1982 Citizenship Law) এবং তাদেরকে রোহিঙ্গা নামে না ডাকার সরকারী সিদ্ধান্তের কারনে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের মধ্যে এনএলডি সরকারের প্রতি যে আশার উদ্রেক হয় তাতে কিছুটা ভাটা পড়ে।

ভয়েস অব আমেরিকার পক্ষ থেকে এনএলডি এর এক জেষ্ঠ্য নেতা উইন হিতেইনের সঙ্গে যোগাযোগ করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব যাচাই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এদেশে হাজারটা সমস্যা রয়েছে, সেসব সম্পর্কে প্রশ্ন করুন, এই প্রশ্ন কেনো?”। দলের মুখপাত্র জাও মিন্ট অং’কে বহুবার টেলিফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তিনি কোনো উত্তর দেননি।

ওদিকে রাখাইন রাজ্য সরকারের তরফে সিতওয়ে’র মুসলমান এলাকার নিরাপত্তা ব্যাবস্থা কড়াকড়ি করার নির্দেশ দেয়ার পর থেকে সেখানে উত্তেজনা বিরাজ করছে। স্থাণীয়রা বলছেন সরকারী কড়াকড়ি আরোপের পর তাদের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী ঠিকমত আসছে না। খাদ্য শাকসব্জী ওষুধ এসব পেতে অসুবিধা হচ্ছে।

আইয়ুব খান আশা করেন এ অবস্থার পরিবর্তন হবে। অন্যথায় তিনি আশংকা করছেন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি আবারো নৌকায় করে বিপদজনক পথে বিদেশ পাড়ি জমানোর চেষ্টা আবারো শুরু করতে পারে; এনএলডি সরকারের প্রতি তার আহবান এমনটি যেনো না হয়।

XS
SM
MD
LG