অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

পোটোম্যাক থেকে পদ্মা-গঙ্গা- অজানা পৃথিবী এখন মুঠোফোনের বন্দী খাঁচায়


ছোটোবেলায়, সেই পঞ্চাশের দশকের বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন শুরুর আগে পরের সময়টায়, ঢাকা-নারায়নগঞ্জ ট্রেন সার্ভীসে- নারায়নগঞ্জ-গোয়ালন্দ স্টীমার যাত্রায় অথবা পশ্চিম বঙ্গে হাওড়া-বর্ধমান লোকাল ট্রেনে যাত্রিদের দেখতাম খবরের কাগজের পাতায় চোখ রেখে যাত্রাকালীন সময় কাটাতেন।

ছোটোবেলায়, সেই পঞ্চাশের দশকের বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন শুরুর আগে পরের সময়টায়, ঢাকা-নারায়নগঞ্জ ট্রেন সার্ভীসে- নারায়নগঞ্জ-গোয়ালন্দ স্টীমার যাত্রায় অথবা পশ্চিম বঙ্গে হাওড়া-বর্ধমান লোকাল ট্রেনে যাত্রিদের দেখতাম খবরের কাগজের পাতায় চোখ রেখে যাত্রাকালীন সময় কাটাতেন। কখনো কখনো দেখেছি পুরোনো কাগজের তৈরি ঠোঙ্গা থেকে সিঙাড়াটা গলাধ:করনের পর কাগজটা সোজা ক’রে নিয়ে সেটা পড়তেন- দেখেছি, একজনের কেনা খবরের কাগজের পাতাগুলো যাত্রিদের মধ্যে থেকে অন্যান্যেরাও চেয়ে নিয়ে পড়তেন।

ঐ দৃশ্যটা পরবর্তীতে ইতিহাস হয়ে যায় – আমরাও, আমি বিশেষ ক’রে আমি তো বটেই, কয়েকবারই বিষয়টি বয়:কনিষ্ঠদের শুনিয়ে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ ক’রতাম পুরোনো দিনের সেই চমৎকার স্মৃতির ক্ষণগুলো। আশির দশকে যখন প্রথম স্থায়িভাবে বাস করার জন্যে, কাজের ধান্দায় ওয়াশিংটনে আসি, তখনও দেখেছি পাতাল রেলের কামরায় লোকজন হয় খবরের কাগজ নয় তো কোনো গল্প-উপন্যাসের বই নিয়ে তাতে মনোযোগ নিবদ্ধ রেখেছেন যাত্রার সময়টাতে। পরবর্তীকালে, দু’হাজার তিন সালে ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা পরিবার ত্বরিৎ চোখ বোলানোর খবর নিয়ে – সংক্ষিপ্ত সংষ্করণের অনেকটাই সেই মাসিক মোহাম্মদী আকৃতির এক্সপ্রেস পত্রিকা সংখ্যা শুরু ক’রলেন দু’ হাজার তিন সালে। সর্ব সাম্প্রতিক খবরাখবর এবং সেই সঙ্গে চটকদার কিছু সমাচার, সংষ্কৃতি অঙ্গনের ইতিবৃত্ত, চলচ্চিত্র সমালোচনা, স্বাস্থ সংবাদ- রন্ধন প্রণালী – সব কিছু মিলিয়ে দৈনিক পত্রিকার সংক্ষিপ্ত সংষ্করণ বের করতে শুরু ক’রলেন এবং পাতাল রেল যাত্রিদের জন্যে তা বিলি করা শুরু হ’লো বিনে পয়সায়। কিছু কিছু বিজ্ঞাপান তাতে অবশ্য থাকতোই – আন্দাজ ক’রি তাতেই পত্রিকা ছাপানোর খরচখরচা উঠে যেতো সম্ভবত:।

চলছিলো ভালোই- গন্তব্য পৌঁছোনোর আগেই, বিশ্ব সংবাদের সঙ্গে মোটাদাগে দৈনিক পরিচয় হয়েই যেতো। বাংলাদেশের বন্যার খবর- বা কোলকাতায় উড়াল সেতূ ভেঙ্গে পড়ে প্রাণহানির খবরাখবরো ছাপা হ’তো। হ’তো ব’ললাম এ কারণে যে ঐ এক্সপ্রেস এখন আর ছাপা হয় না। দৈনিক দু’লক্ষ কপি ঐ এক্সপ্রেস বিতরন করা হ’তো বিনে পয়সায় – একটানা, সপ্তাহে পাঁচদিন সোমবার থেকে নিয়ে শুক্রবার ঐ এক্সপ্রেস পাওয়া যেতো পাতাল রেলের স্টেশানগুলোতে। লোকে পড়তেনও তা গোগ্রাসে- সফরকালে, নামার সময় ট্র্যাশক্যানে ফেলে দিতেন যথারিতি। এটা শুরু হয়েছিলো দু’হাজার তিন সালে যখন কিনা আইনফোন নামের বস্তুটার প্রচন্ড প্রতাপ, এখনকার মতো ছিলোই না প্রায়। ঐ দু’হাজার তিন সালেরও এক বছর পর হার্ভাডের ছাত্রেরা শুরু ক’রলো ফেইসবুক নামের সামাজিক নেটওয়ার্কের ব্যবহার। ব্যস শুরু হয়ে গেলো ছন্দপতন। দেখতে না দেখতেই এক্সপ্রসের যায়গা দখল আরম্ভ হ’লো – গ্যাঁট হয়ে বসতে আরম্ভ করলো আই ফোন। একজন দু’জন ক’রে যাত্রিদের হাতে হাতে দেখা যেতে লাগলো মুঠোফোনের হিড়িক- ট্রেনে ওটার সময়ও চোখ নিবদ্ধ ঐ মুঠোফোনপানে, দাঁড়িয়ে অথবা বসে বসেও নজর অন্য কোথাও নয় আর – খবর শোনা, ছবি দেখা প্রেয়সীর ছবির দিকে নজর প্রক্ষেপন, আগের দিন প্রথম সন্তানের জন্মদিন পালনের ছবি দেখা – অথবা কাউকে গালমন্দ ক’রতে ছোট্র ম্যাসেজ লেখা অথবা কাউকে প্রেম নিবেদন ক’রতে কিছু বলা-শব্দের পর শব্দের মালা গেঁথে, অথবা ব্যাঙ্ক একাউন্ট চেক করা বা কোনো বকেয়া আদায় করা ইত্যকার সব কাজে।

উঠে গেলো সপ্তাহের পাঁচদিনের নিত্য সহযাত্রি এক্সপ্রেস আমারও জীবন থেকে। ইতিহাস হ’যে গেলো এক্সপ্রেস বারো সেপ্টেম্বর দু’ হাজার উনিশে পৌঁছিয়ে। মনে পড়ে এমনি ক’রেই চুরাশি সালের একদিন পত্রিকার পাতায় একটা ছবি দেখেছিলাম-কম্পিউটারের – প্রায় একখানা পিল্লাই পিয়ানোর সাইজের। ঐ সময়টাতেই একটা গল্প শুনেছিলাম অথবা হয়তো কোথাও পড়েই ছিলাম – ঠিক মনে পড়ছে না। যাইহোক গল্প-কাহিনী বা সত্য ঘটনা যেটাই হোক শেয়ার ক’রছি আপনাদের সঙ্গে।

এক সিঙ্গল মাদার – বা পিতার অনুপস্থিতিতেই সন্তান পালন ক’রছেন এমনি এক অশ্বেতাঙ্গ মাকে তার বছর দশেকের হাইস্কুলগামি পুত্র বায়না ধরেছিলো একটা কম্পিউটারের জন্যে। মা প্রথম মাসে সামনের মাসে কিনে দেবার প্রতিশ্রূতি দিয়েছিলেন, দ্বিতিয় মাসে আবার কথা দিয়েছিলেন পরের মাসে কেনার আশ্বাস দিয়ে, তৃতীয় মাসেও কম্পিউটার না পেয়ে ছেলে যখন কান্নাভরা চোখে অনুনয় ক’রেছিলো আঁটোশাঁটো সাংসারিক ব্যয়ের যন্ত্রনায় জর্জরিত সিঙ্গল মাদারের কাছে মাও তখন ঐ কান্নাজড়ানো কন্ঠেই অভিযোগ নয় যেন আর্জিই পেশ ক’রেছিলেন ছেলের কাছে – ঐ চৌকোনো বাক্সটার ভেরতর কি আছেযে তোর আর তার জন্যে তর সইছে না! ছেলে নিরুপায় মায়ের সামনে মাথাটা নুইয়ে দিয়ে ব’লেছিলো – ঐ বাক্সটার ভেতরেই ওরা সারা জগৎ সংসারটাকে ভরে দিয়েছে মা’ তুমি কি চাও তোমার ছেলে ঐ জগতের বাইরে রয়ে যাবে। মা কি ব’লেছিলেন জবাবে জানি না – বোধ’য় মার মনে হয়েছিলো এবং এখন আমারো মনে হ’লো ওরা সবাই মিলে এখন আগের সেই আদিগন্ত বিস্তৃত- সাগর যেখানে গিয়ে মিসেছে, সেই সেখান অবধি তার বিশাল জলধারা নিয়ে আকাশের সঙ্গে গলাগলি ক’রেছে, তারও ওধারে যে স্বপ্নের- কল্পনার পৃথিবীটা অনেকের আজন্ম লালিত দ্মৃতির মনিকোঠায় সাঁঝের বেলার জনাক আলোর মতো টিপ টিপ ক’রে অজানালোকে নিয়ে হাজির করতো এ পৃথিবী গ্রহের মানুষকে, এখন সবাই মিলে ঐ অনেক কাছের, অনেক দূরের, অনেক চেনা, অনেক অজানা পৃথিবীটাকে পুরে দিয়েছে মুঠোর ভেতর- মুঠোফোনের বন্দী খাঁচায়। আর ঐ মা যেন ব’লে উঠছেন – আর কারো কারো মতোই- এতো সংকীর্ণ গন্ডিঘেরা দুনিয়ায় মন প্রাণ যেন হাঁপিয়ে ওঠে- মনে যেন গেয়ে ওঠে- পাখির ডানায় ভর ক’রেছি দেখবো এবার জগৎটারে -ভোরের বেলায় রবির করে দিনের শেষে অস্তরাগেদেখবো মানুষ আছে কেমন – এ ভূবনের গুলিস্তানে।

এবার এই একটি মাত্র, গল্প নয় – ইতিহাস কথা কয় –এ স্মৃতিচারন দিয়েই শেষ ক’রছি এবারকার পোটোম্যাক থেকে পদ্মা গঙ্গার পরিবেশনা।


XS
SM
MD
LG