এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সিনিয়র ক্রাইসিস এ্যাডভাইজর ম্যাট এলস সম্প্রতি বলেছেন মিয়ানমারের উত্তর রাখাইনের যে সকল গ্রাম থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানরা প্রান বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে, সেসব গ্রাম বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দিয়েছে মিয়ানমার সেনা বাহিনী। সেখানে অন্য স্থাপনা তৈরীর কাজ চলছে। ম্যাট এলসকে, ভয়েস অব আমেরিকার ইরা মেলম্যানের করা সাক্ষাৎকার থেকে কিছু অংশ নিয়ে বিস্তারিত শোনাচ্ছেন সেলিম হোসেন।
সম্প্রতি মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত নিরাপত্তা কার্যক্রম বৃদ্ধি, রাখাইন রাজ্যের খালি হয়ে যাওয়া রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে সেনা ঘাটি, হেলিপ্যাড ও রাস্তাঘাট নির্মান, এবং তারপরও বাংলাদেশ মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি কেমন করে হবে এমন প্রশ্নে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সিনিয়র ক্রাইসিস এ্যাডভাইজর ম্যাট এলস বলেন, “আসলে মিয়ানমার সরকার যা বলছে এবং যা করছে তা সরাসরি বিপরীতমুখী কাজ। জনসমক্ষে মিয়ানমার সরকার বলছে তারা বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গা শরনার্থীদেরকে ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত। কিন্তু বাস্তব হচ্ছে ঐসব রোহিঙ্গাদের গ্রামে তারা স্থাপনা নির্মানের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। যে নিরাপত্তা বাহিনী রাখাইন রাজ্যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, তাদেরকেই সেখানে ঘাঁটি বানিয়ে দেয়া হচ্ছে। তারাই শতশত রোহিঙ্গা নারী ধর্ষন করেছিল। গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দিযেছিল। ফলে সেই গ্রামগুলোতে আরো অধিক পরিমানে সেনা উপস্থিতিতে সেখান থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে চাইবে বলে মনে হয়না। এটা বিশ্বাস করাই কঠিন। উপরন্তু তাদের জন্যে এখন ফিরে যাওয়াটা অসম্ভব; কারন কর্তৃপক্ষ তাদের বাড়ীঘরের ওপর স্থাপনা নির্মান করছে”।
তারপরও যদি বাংলাদেশ মিয়ামারের মধ্যে হওয়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় কিছু রোহিঙ্গা ফিরে যায় বা যেতে চায়, তাহলে তাদেরকে কোথায় রাখা হবে, এমন প্রশ্নে ম্যাট এলস বলেন, “বাংলাদেশের সঙ্গে করা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তিতে বলা হয়েছে যারা ফিরে যাবে তারা তাদেরকে তাদের নিজেদের বসত ভিটায় রাখা হবে। কিন্তু বর্তমানে রাখাইনের ঐসব গ্রামগুলোর যে অবস্থা তাতে প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে আসা মানুষগুলোর যায়গাতো হবেই না; বরং যারা সেখানে অনেক কষ্ট সহ্য করে এখনও থাকার চেষ্টা করছে, তাদেরকেও এখন সরে যেতে হচ্ছে। তারাও বাংলাদেশে পালিয়ে যাচ্ছে। গত মাসে বাংলাদেশে ঐসব শরনার্থী শিবিরে গিয়ে অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি আমি। তারা বলেছে মিয়ানমার শুধু তাদেরকে অত্যাচার করে বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। তাদের কৃষি জমিগুলোও দখল করে নিয়েছে। যারা এখনো সেখানে রয়েছে তারা ফসল চাষের জন্য যায়গা পাচ্ছে না। তাদেরকে কৌশলে দুর্ভিক্ষে ফেলে বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে; এমন মন্তব্য করেন রোহিঙ্গারা। তাছাড়া জাতিগত পরিচ্ছন্নতা অভিযান এখনো শেষ হয় নি, চলছে”।
ম্যাট বলেন ওইসব অঞ্চলে এখনো বিদেশি পর্যবেক্ষক বা সাংবাদিকদের যেতে দেয়া হচ্ছে না। সীমিত আকারে মাঝে মধ্যে কিছু কিছু লোক যেতে দেয়া হচ্ছে। তবে স্যাটেলাইটের ছবি ও ভিডিওর মাধ্যমে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সেখানকার অবস্থা জানতে পারছে নিয়মিতই।
“আমরা পরিস্কার বুঝতে পারছি সেখানে কি হচ্ছে। এখনো যারা রয়েছে সেসব রোহিঙ্গারা এখনো বিতারিড়ত হচ্ছে। রাখাইন রাজ্যকে তারা নতুন করে আকার দিচ্ছে, রিশেপ করছে। সেখানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নির্যাতন ও বৈষম্য চলছেই”।
এ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল কি করতে চায়; বা এই সংকটের সমাধান কিভাবে চায় এই প্রশ্নে ম্যাট বলেন, আমরা চাই বিশ্বের সকল রাষ্ট্র ও সমাজ, সকলেই এই অমানবিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোক।
“মিয়ানমার সেনা বাহিনী মানবতার বিরুদ্ধে গত ৭ মাস অপরাধ চালিয়ে আসেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তরফ হতে সেখানে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি করা উচিৎ। মিয়ানমারের ওপর দেয়া দরকার অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। ওখানে ঘটানো বর্বর নির্যাতন বিষয়ে প্রমান যোগাড় করে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ”।
মিয়ানমারের পুলিশ ঘাঁটিতে আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি ARSA নামের এক জঙ্গী গোষ্ঠীর হামলার পর গত বছর ২৫শে আগষ্ট মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির ওপর নির্যাতন শুরু করে। জাতিগত পরিচ্ছন্নতা লক্ষ্যে শত শত রোহিঙ্গা গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় মিয়ানমার সেনাবাহিনী, ধর্ষন করা হয় অসংখ্য নারী, হত্যা করা হয় হাজার হাজার মানুষ। সেই থেকে প্রান বাঁচাতে বাংলাদেশের কক্সবাজার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পালিয়ে আসে ৬ লক্ষ্য ৭০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে বেশ কয়েকটি শরনার্থী শিবিরে মানবেতর অবস্থায় কোনমতো বেঁচে রয়েছে রোহিঙ্গা শরনার্থীরা।