অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর নির্দেশে টিটিই সাময়িক বরখাস্ত: জবাবদিহিতা ও আইনের ব্যত্যয়


রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন
রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন

বাংলাদেশের রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর নির্দেশে সেই মন্ত্রণালয়ের অধীনে কর্মরত টিকেট পরিদর্শক শফিকুল ইসলামের বরখাস্ত হওয়ার খবর প্রকাশের পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। বাংলাদেশ সময় গত ৪ মে (বুধবার) রাতে আন্তঃনগর ‘সুন্দরবন এক্সপ্রেস’ ট্রেনে ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশন স্টেশন থেকে তিনজন যাত্রী বিনা টিকেটে এসি কেবিনে ভ্রমণ করছিলেন। ওই তিনজন ব্যক্তির একজন রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর মামাতো বোনের ছেলে। ট্রেনটি খুলনা থেকে ঈশ্বরদী হয়ে ঢাকা আসছিল। বিনা টিকেটে ভ্রমণের জন্য ওই তিনজন যাত্রীকে জরিমানা করেন কর্তব্যরত টিটিই। পরদিন বৃহস্পতিবার সংশ্লিষ্ট টিটিইকে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ দেওয়া হয়। এরপরই শুরু হয় সমালোচনা।

এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে রবিবার (৯ মে) রেলমন্ত্রী মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম সুজন টিটিই শফিকুল ইসলামের বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার হওয়ার খবর জানান।

এই ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে সর্বত্র সরকারি পদধারী ব্যক্তি ও তার পরিবারের সদস্য পরিচয়ে অনৈতিক সুবিধা, দায়িত্বপালনে বাধাসহ নানা অভিযোগের কথা ওঠে। কেউ কেউ বলছেন, এই ঘটনা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঠিক দায়িত্ব পালনে অনীহা তৈরি করতে পারে। এইসব বিষয়ে ভয়েস অফ আমেরিকা কথা বলে সাবেক আমলা, সুশাসন নিয়ে কাজ করছেন এমন ব্যক্তি, আইনজীবী ও রাজনীতিবিদের সঙ্গে।

তারা বলছেন সরকারি বিধি অনুযায়ী একজন সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ এলে, সেটি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। যদি গুরুতর অপরাধের অভিযোগ হয় তাহলে তদন্তের আগেই সাময়িক বরখাস্ত করা যেতে পারে। যদি তা না হয়, সেক্ষেত্রে তদন্তের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করেই ব্যবস্থা নিতে হবে। তাই রেলের টিটিই-কে বরখাস্তের ক্ষেত্রে এই রীতি অনুসরন করা হয়নি। এখানে জবাবদিহি ও আইনের ব্যত্যয় হয়েছে বলে মনে করছেন তারা।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান

দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর নির্দেশে রেলের একজন টিটিই-কে সাময়িক বরখাস্ত করা হল, এরপরে জনমতের চাপে ও সমালোচনার মুখে মন্ত্রী তার বক্তব্য বদলে নিলেন। সাময়িক বরখাস্তকৃত রেলকর্মীর চাকরি পুনর্বহাল করা হয়েছে। এটাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায়, যার আদেশে চাকরি থেকে সাময়িক বহিস্কার করা হল তাকে, যার বা যাদের ক্ষমতার অপপ্রয়োগে এটা হল তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। এটা কেবল একটি ঘটনা হিসেবেই দেখলে চলবে না। কারণ, এর সাথে জবাবদিহি, সুশাসন ও গণতন্ত্র জড়িত।”

ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া

রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর নির্দেশে রেলের এক টিটিই-কে সাময়িক বরখাস্ত করার বিষয়টি আইনগত দিক থেকে কীভাবে বিবেচনা করা যায় তা জানতে যোগাযোগ করা হয় ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া'র সঙ্গে। বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্টের এই আইনজীবী বলেন, “প্রথমেই আমরা যদি সহজভাবে দেখি, আমরা কিন্তু প্রায়ই একটি মামলা দায়ের করার খবর পাই। সেটি হচ্ছে- সরকারি কাজে বাধাপ্রদান, দায়িত্বপালনে চাপসৃষ্টি। এসব মামলায় সাধারণত সবসময়ই সরকারের বিরোধীদের আটক করা বা মামলার প্রতিপক্ষ বানানো হয়। বাংলাদেশের দণ্ডবিধিতে ফৌজদারি অপরাধের যে ধারা রয়েছে, তাতে এইসব বিষয়ে বিস্তারিত বলা আছে। এখন টিটিই-কে যেভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে, বরখাস্ত করতে যে বা যারা চাপ দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা চাইলে নেওয়া যায়। আবার এই টিটিই যিনি সাময়িক বরখাস্তের শিকার হলেন আবার তা প্রত্যাহার করা হল। তিনি যদি কোনো আইন বিরোধী কাজ করতেন বা তার চাকরিবিধিতে নেই এমন কাজ করতেন তাহলে বলা যেত তিনি আইনের অপব্যবহার করেছেন। তিনি তার যে ক্ষমতা- জরিমানা করে টিকিট কেটে দেওয়া সেটুকু করেছেন। এখন এরজন্য তাকে সাময়িক বরখাস্তের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তিনি এখন চাইলে প্রচলিত আইনে পেশাগত দায়িত্বপালন করতে গিয়ে এমন পরিস্থিতির শিকার হওয়ায় বিচার দাবি করতে পারেন।”

সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার
সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার

আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব। দীর্ঘদিন তিনি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজনৈতিক দলের দ্বারা প্রভাবিত হওয়া ও নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে ভয়েস অফ আমেরিকার সঙ্গে কথা হয় তার। মন্ত্রীর স্ত্রীর ফোনে একজনের সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার বিষয়টিকে তিনি কীভাবে দেখছেন, জানতে চাইলে বলেন, “রেলের একজন টিটিই’র ক্ষেত্রে যা হয়েছে, এখন যেভাবে এর সমাপ্তি হল, আমি বলবো এটি মন্দের ভালো। অর্থাৎ, তাকে চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে, মন্ত্রীর বোধোদয় হয়েছে।”

মন্ত্রীর স্ত্রীর কথাতে এভাবে কারও চাকরিচ্যুত হওয়ার বিষয়টিকে সামগ্রিকভাবে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন, জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, “আমরা সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে দেখেছি, যদি কেউ অসাধু পথ অবলম্বন করে, ঘুষ গ্রহণে হাতেনাতে ধরা পড়ে, শৃঙ্খলাভঙ্গ করে বা চরম নৈতিক স্খলনজনিত এমন কিছু করে তখন কাউকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। সাময়িক বরখাস্তের ফলে একজন লোক পারিবারিক, সামাজিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ে। তাই পেশাগত দায়িত্বপালন করতে গিয়ে রেলের টিটিই যেভাবে এই পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন তা তার জন্য হওয়ার কথা ছিল না। অর্থাৎ, উপরের মহলের চাপ কীভাবে আসে, কোন পরিস্থিতিতে আসে তা আগেভাগে বলা যায় না।”

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ

রেলমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র সমালোচনা শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম সুজনের বিষয়ে কথা হয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের সাথে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “রেল মন্ত্রণালয়ের যে ঘটনাটি ঘটেছে প্রথমেই বলবো, এই ধরনের ঘটনা অনাকাঙ্খিত ও অনভিপ্রেত। এটা কাম্য নয়। তবে এখন যা হয়েছে, একটি ভুল হয়েছিল, এখন সেই ভুলটির সমাপ্তি হয়েছে। টিটিই-কে বরখাস্ত করা হয়েছিল, তাকে ইতমধ্যে স্বপদে বহাল রাখার কথা বলা হয়েছে। শেষ খবর যতোটুকু, তিনি ইতিমধ্যে আগের দায়িত্বে ফিরেছেন। ”

রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর এমন কাণ্ডে দলীয় ফোরামে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের এই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, “এটাতো দলীয় কোনো ঘটনা নয়। এটা রেলমন্ত্রীর স্ত্রী ঘটিয়েছেন। মন্ত্রী পুরো ঘটনার জন্য 'অনুতপ্ত' বলেছেন। আবার ভুক্তভোগী টিটিই-কে চাকরিতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তাই এটা যেহেতু দলীয় কোনো বিষয় নয়, তাই এখনই এটা নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সামনেরটা এখনই বলা যাবে না।”

মন্ত্রীর স্ত্রীর আবদার রাখতে গিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, “এখানে আমি বলবো যে প্রথমে ভুল হয়েছিল। কিন্তু রেলের যে ঊর্ধ্বতন কর্তা টিটিই-কে বরখাস্ত করলেন, তার বিরুদ্ধেও পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ। কারণ একজন ফোন করে বলল আর বরখাস্ত করে দিল, এটা তো হতে পারে না। ওই কর্মকর্তার উচিৎ ছিল মন্ত্রীকে ফোনে বিষয়টি জানানো। তা না করে তিনি চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন।”

অনেকেই রেলমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি তুলেছেন। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হানিফ বলেন, “মন্ত্রীর পদত্যাগ কেন করতে হবে! ইতিমধ্যে বিষয়টি সুরাহা হয়েছে। এখন যারা পদত্যাগের দাবি তুলেছে তারা সবসময়ই অভিযোগ নিয়ে বসে থাকেন। এসব কথা গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নাই।”

XS
SM
MD
LG