রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা, ভোটারদের একটি অংশকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করাসহ গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে— এমন সিদ্ধান্ত এড়িয়ে চলতে বাংলাদেশকে পরামর্শ দিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা।
গত বছর (২০২৪) বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ভয়ানক ঘটনার বিষয়ে বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই সুপারিশ করা হয়।
প্রতিবেদনে জাতিসংঘ বলেছে, রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা 'সত্যিকারের বহুদলীয় গণতন্ত্র’ পুনপ্রতিষ্ঠাকে ক্ষুণ্ন করবে এবং বাংলাদেশের ভোটারদের একটি বড় অংশকে কার্যকরভাবে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করবে।
এ ছাড়াও, সব রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে নির্বাচনের আগে বিশেষ ব্যবস্থাসহ অবাধ ও প্রকৃত নির্বাচনের জন্য নিরাপদ ও অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিতের সুপারিশও করা হয় প্রতিবেদনে।
সাংবাদিক, আওয়ামী লীগ সমর্থক, সংখ্যালঘু নেতা, মানবাধিকার কর্মী এবং নাগরিক বা রাজনৈতিক ভিন্নমত প্রকাশকারী অন্যরা যাতে নির্বিচারে গ্রেফতার, অপ্রমাণিত ফৌজদারি মামলা বা অন্য ধরনের ভীতি প্রদর্শনের শিকার না হন—তা নিশ্চিত করার গুরুত্ব তুলে ধরেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “প্রতিশোধমূলক সহিংসতা থেকে তাদের কার্যকরভাবে রক্ষা করতে পদক্ষেপ নিন এবং এই ধরনের হামলায় জড়িত অপরাধীদের বিষয়ে তদন্ত ও বিচার করুন। পাশাপাশি ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে হামলাসহ নাগরিকদের ক্ষতিপূরণের দাবিও সহজতর করুন।”
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার পরামর্শ এসেছে এমন সময়ে যখন মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভেতর থেকে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কথা বলা হচ্ছে।
স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ৭ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বাসসের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে সরকার শীঘ্রই পদক্ষেপ নেবে। তিনি দাবী করেন যে, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যে "ঐকমত্য" হয়েছে।
র্যাব বিলুপ্তির পরামর্শ
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) যেসব সদস্য গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত নয় তাদের নিজ ইউনিটে ফিরিয়ে নিয়ে র্যাব বাহিনীকে বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র্যাবের সাবেক সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট ও পররাষ্ট্র দফতর পৃথকভাবে এই নিষেধাজ্ঞা দেয়।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর) তাদের তথ্য-অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জবাবদিহিতা ও বিচার, পুলিশ ও নিরাপত্তাসহ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সুপারিশ তুলে ধরেছে। এর মধ্যে রয়েছে- নাগরিকদের সুযোগ, রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক সুশাসন।
‘বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই ও অগাস্টের বিক্ষোভ সম্পর্কিত মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতন’ শীর্ষক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং প্রতিবেদনে সাংবাদিক, রাজনৈতিক দলের কর্মী, সংখ্যালঘু নেতা ও অধিকার কর্মীদের সুরক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।
শাসন ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাবের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করারও সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ।
দেশের নাগরিকদের নিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের (নাগরিক) সরাসরি অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা যাতে মানবাধিকারের নীতির প্রতি সম্মান দেখায়—তা নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিস্তৃত আলোচনা শুরুরও সুপারিশও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে প্রয়োজনীয় ও উপযুক্ত ক্ষেত্রে অস্থায়ী বিশেষ ব্যবস্থাসহ রাজনৈতিক ও অন্য ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে প্রকৃত সমতা নিশ্চিতে আইন ও বিধিবিধান কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও প্রতিশোধমূলক সহিংসতার জন্য ন্যায্য ও কার্যকর ফৌজদারি বিচারের সুপারিশ করা হয়েছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে সরকার, বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজসহ স্বতন্ত্র সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত একটি জাতীয় পুলিশ কমিশনের মাধ্যমে একটি নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও মেধাভিত্তিক পুলিশ নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও অপসারণ প্রক্রিয়া গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।
এতে পুলিশ পর্যবেক্ষণ ইউনিটের পরিবর্তে স্বরাষ্ট্র/বাংলাদেশ পুলিশ চেইন অফ কমান্ডের বাইরে একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছ, “এটি নাগরিক সমাজসহ স্বাধীন সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত হওয়া উচিত। জনসাধারণের অভিযোগ দেওয়ার সংস্থা হিসেবে কাজ করার জন্য বিশেষায়িত কর্মী, ক্ষমতা ও আইনি ক্ষমতাও থাকতে হবে।”
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা বলেছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যেকোনো পুলিশ সদস্যের অন্য গুরুতর অসদাচরণের বিষয়ে তাদের নিজস্ব কার্যকর তদন্তসহ অভিযোগগুলোর বিচার হওয়া উচিৎ।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করতে হবে : সারজিস
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম।
বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় নিজের ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে এ দাবি জানান তিনি।
সারজিস বলেন, “গাজীপুরে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলায় আহত আমাদের সহযোদ্ধা আবুল কাশেম শহীদ হয়েছেন! প্রতিবিপ্লবের প্রথম শহীদ আমার এই ভাই।”
ওই পোস্টে হ্যাশট্যাগ আওয়ামী লীগ জুড়ে দিয়ে তিনি আরও বলেন, “খুনির দল আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করো, করতে হবে”
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি হাসনাতের
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুকে এক পোস্টে কাশেমকে ‘প্রতিবিপ্লবের প্রথম শহীদ’ উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, “গাজীপুরে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলায় আহত কাশেম শহীদ হয়ে গেছেন। প্রতিবিপ্লবের প্রথম শহীদ আমার এই ভাই। ইন্টেরিম, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করো, করতে হবে।”
আরেক পোস্টে তিনি লেখেন, “আয়নাঘর, হাসিনার হত্যা, প্রতিবিপ্লবে আমার ভাই কাশেম শহীদ হয়েছে। যথেষ্ট হয়েছে। এখন আর পেছনে ফেরার পথ নেই। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতেই হবে।”
উল্লেখ্য, ৭ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) রাতে গাজীপুর শহরে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হকের বাড়িতে ভাঙচুর চালাতে গেলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বিক্ষুদ্ধ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের ওপর চড়াও হয় এবং মারধর করে। এই ঘটনায় কাশেমসহ আহত হন অন্তত ১৪ জন।
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে শিগগিরই পদক্ষেপ নেবে সরকার: উপদেষ্টা আসিফ
এদিকে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সম্প্রতি বলেছেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে বর্তমান সরকার শিগগিরই পদক্ষেপ নেবে।
৭ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) বার্তা সংস্থা বাসসকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।
আসিফ মাহমুদ বলেন, "প্রথমত এটা অত্যন্ত ইতিবাচক যে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও একধরনের ‘ঐকমত্য’ তৈরি হচ্ছে। দেশের মানুষ তৎকালীন ক্ষমতাসীন ওই দলের অগণতান্ত্রিক এবং একগুঁয়েমি মনোভাব ও কার্যকলাপ মেনে নিতে পারেনি বলেই ৫ অগাস্টের আগে ও পরে তাদের মধ্যে দলটি নিষিদ্ধ করার বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এমন ঐকমত্য তৈরি হলে সরকারের জন্য যেকোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সহজ হবে।"
তিনি বলেন, "বিচারিক প্রক্রিয়া ছাড়াও ৪টি আইন রয়েছে, যেখানে সরকার নির্বাহী আদেশে যেকোনো দলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে এটার লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কটা (আইনি কাঠামো) কী হবে, এ বিষয়ে সরকার এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। তিনি বলেন, বিচারিক প্রক্রিয়ায় স্বাভাবিকভাবেই জুলাই–অগাস্টের গণহত্যার সঙ্গে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হওয়ার কথা। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে দলীয়ভাবে নিষিদ্ধ করা, নিবন্ধন বাতিল করাসহ যেকোনো ব্যবস্থা সরকার গ্রহণ করতে পারে। তবে বিষয়টি যেহেতু আইনের বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত, সে ক্ষেত্রে সরকার প্রয়োজনীয় সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার বিষয়ে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসবে।"