মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে কি করা যায় তা নিয়ে ডেমোক্রেটিক সেনেটর ডিক ডারবিন কথা বলেছেন ভয়েস অব আমেরিকার কন্ট্রিবিউটর গ্রেটা ভ্যান সাস্টেরিন এর সঙ্গে। সেলিম হোসেন শোনাচ্ছেন সাক্ষাৎকারের উল্লেখযোগ্য কিছু অংশের বঙ্গানুবাদ।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির ওপর চলমান নির্যাতনকে জাতীগত শুদ্ধি বলে আখ্যা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রটিক দলের সেনেটর ডিক ডারবিন। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারেরর অবস্থান কি জানতে চাইলে তিনি বলেন।
“আমি জানি না সরকারের সুস্পষ্ট অবস্থান কি। আমার সহকর্মী মেরীল্যান্ড সেনেটর বেন কার্ডিন একে গণহত্যা বলেছেন। যেটাই হোক যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের সকলেরই এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া দরকার। কংগ্রেসে আমরা অনেকেই সেটা করার জন্য তৈরী আছি”।
মিয়ানমারে যা হচ্ছে তাতে আমেরিকানদের কি আসে যায়, কেনোই বা তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ন; এ প্রশ্নে সেনেটর ডারবিন বলেন,
“মিয়ানমারের সেনা বাহিনী সেখানকার রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। তাদের ঘরবাড়ী পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। মানুষদেরকে হত্যা করা হচ্ছে, নারী ধর্ষণ করা হচ্ছে; এবং প্রাণভয়ে লাখ লাখ মানুষ পালিয়ে যাচ্ছে। নাফ নদীর ওপারে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরনার্থী শিবিরে আশ্রয় নিচ্ছে তারা এবং অসহায় ও বিপদজনক অবস্থায় বেচে রয়েছে। এটা গ্রহনযোগ্য নয়”।
১৯৮২ সালে বার্মা দেশটির বেশকিছু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নাগরিকত্ব দেয়; যাতে রোহিঙ্গাদেরকে বাদ রাখা হয়; কেনো? এ প্রশ্নে তিনি বলেন,
“তাদের বক্তব্য হচ্ছে, আমি যতোটুকু বুঝেছি; তারা বার্মা অর্থাৎ মিয়ানমারের নাগরিক নন। তারা বাংলাদেশের লোক, বাঙ্গালী। দ্বিতীয়ত; এটা লক্ষ্যনীয় যে তারা মুসলিম যারা একই স্থানে বসবাস করেন, তাদেরকে তারা ধারণ করতে চায় না”।
মিয়ানমারের অনেকেই বলেন, সেখানকার সেনা কর্তৃপক্ষ বলে যে তারা সন্ত্রাসী; আপনার মন্তব্য কি? এ প্রশ্নে সেনেটর ডারবিন বলেন,
“একটা সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছিল, আমরা যা বুঝেছি তা হচ্ছে মিয়ানমারের সেনা সদস্য ও আইন শৃংখলঅ রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরকে হত্যা করা হয়। দুই পক্ষেই হত্যার ঘটনা ঘটে। তার জের ধরে ঘটে যাওয়ার ফলে ৬ লাখ মানুষ গৃহচ্যুত হয়। এটা অমানবিক এবং পরিস্কারভাবে জাতিগত নিধন”।
২৫শে আগষ্টের পর থেকে মিয়ানমারের রাখাইনের মুসলিম গ্রামের মানুষদের ওপর শুরু হয় নির্যাতন, নারী ধর্ষন ও ঘরবাড়ী পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা সে প্রসঙ্গে সেনেটর ডারবিন বলেন,
“হ্যা ২৫শে আগষ্টের পর উত্তর রাখাইনে তা ঘটে। আমরা ডেমোক্রেট ও রিপাবলীকান ৭ জন সেনেটর এখানে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক করি। ঐসব ঘটনার ব্যাখা জানতে চাই। এক সপ্তাহ পর আবার বসবো। আমরা তাকে বলতে চেয়েছি যে আমরা এসব গভীরভাবে পর্যবেক্ষন করছি। ফলে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের যে সম্পর্ক রয়েছে তার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে সেখানকার অবস্থা কি হয় তার ওপর”।
মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যাবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে কিনা এ প্রশ্নে তিনি বলেন,
“আমি এটা বলতে পারি যে আমরা একটি প্রস্তাব নিয়ে এগুচ্ছি। সেনেটর জন ম্যাককেইন আমার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। আরো অনেকেই আসবেন। এটি হবে দ্বিপাক্ষিক। আমরা এটা পাশ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাই না। এটি একটি প্রতিকী ব্যাবস্থা। আমরা চাই দ্রুত এর ফল আসুক। এর মানে হচ্ছে, যারা দুর্ভোগে রয়েছেন তাদের দুর্ভোগ কমুক তাড়াতাড়ি। আমরা চাই অং সাং সু কি দ্রুত এ নিয়ে কথা বলবেন এবং কিছু একটা করবেন। প্রথমত: মিয়ানমারের উত্তর রাখাইনে যেনো জাতিসংঘ ও এনজিও কর্মীদেরকে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়। সেখানে আসলে কি ঘটছে তা যেনো তারা দেখতে পারেন। দ্বিতীয় মিয়ানমারের সেনা বাহিনীর মধ্যে যারা এর জন্য দায়ী, যারা ঘরবাড়ী পুড়িয়েছে এবং হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছে তাদের চিহ্নিত করা হোক। তৃতীয়ত যারা দেশত্যাগ করেছে সম্ভব হলে UNHCR এর সহায়তায় তাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হোক”।
যুক্তরাষ্ট্রে রোহিঙ্গা শরনার্থী আছে কিনা বা তাদের মনোভাব কি এমন প্রশ্নে সেনেটর ডারবিন বলেন,
“শিকাগোয় বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ সহয়েছে। শিকাগোয় এক হাজারেরও বেশী রোহিঙ্গা আছে। তাদতের নিজস্ব সেন্টার আছে। গত সপ্তাহে আমি সেখানে গিয়েছি। তারা শরনার্থী শিবিরের ছবি দেখিয়েছে। সেখানকার অবস্থা মারাত্মক খারাপ। খাবারর জন্য লম্বা লাইন। কোনো স্বাস্থ্যসেবা নেই। পানি নেই। নানা রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। এসবের জন্যই আমাদেরকে দ্রুত ব্যাবস্থা নিতে হবে”।
নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সাং সুচির ভূমিকা নিয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে সেনেটর ডারবিন বলেন,
“আমি তাকে সম্মান করি। তিনি এক দশকেরও বেশী সময় গৃহবন্দী ছিলেন। তিনি দেশে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন। তিনি যে কোনো নেতার চেয়ে শক্তিশালি। দেশটি সেনা শাষণ থেকে গনতন্ত্রের পথে রয়েছে। কিন্তু এই অবস্থা নিরসনে তার আরো শক্ত পদক্ষেপ নেয়া দরকার”।
তিনি কি করতে পারেন, এ প্রশ্নে বলেন,
“আমি জানি না তার নিজ দেশে তার কোথায় সীমাবদ্ধতা। তবে যা ঘটছে তা স্বীকার করা উচিৎ। তিনি একটি দুর্বল বক্তব্য দিয়েছেন। তা গ্রহনযোগ্য নয়। তার শক্তভাবে বলা উচিৎ রোহিঙ্গাদেরকে ফিরিয়ে নেয়ার কথা। বলা উচিৎ তাদেরকে নাগরিকত্ব দেয়া হবে। সেসব করলে পশ্চইমা সহায়তাও তিনি পাবেন বলে আমার ধারনা”।
যুক্তরাষ্ট্রেও অভিবাসন সমস্যা রয়েছে; মিয়ানমারের সঙ্গে পার্থক্য হচ্ছে এখানে তাদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে না। এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে বলেন,
“এ বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে নাটকীয় পার্থক্য রয়েছে। এখানকার সমস্যার জন্য আমি দুখিত। কিন্তু আমি ড্রিম এ্যাক্ট স্পন্সর করেছি। সমন্বিত অভিবাসন সংস্কার বিল সমর্থন করেছি। আমার মাও এই দেশে অভিবা্সি ছিলেন। আমরা এখানকার অভিবাসন সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করে চলেছি। আর শরনার্থী সংকট বিশ্বব্যাপী এখন একটি বড় সংকট যা নিরসনে আমরা কাজ করছি। কিন্তু মিয়ানমারে তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চলছে”।
মিয়ানমারে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা কাজ করবে কিনা বা আর কি করা যায় এমন প্রশ্নে তিনি বলেন,
“যদি মিয়ানমারে কোনো তৃতীয় পক্ষকে যেতে না দেয়া হয়; রোহিঙ্গাদের বাস্তব অবস্থা যদি প্রত্যক্ষ করতে না দেয়া হয় তাহলে কেনো আমেরিকান ডলার সেখানে পাঠানো হবে”।
যুক্তরাষ্ট্রে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত কি বললেন এ বিষয়ে তিনি বলেন,
“তিনি খুব খোলামেলাভাবেই কথা বললেন এবং স্বীকার করলেন সেখানকার অবস্থা। তিনি আমাদের বক্তব্য শুনেছেন এবং বলেছেন তার সরকারের সঙ্গে কথা বলে আমা্দেরকে জানাবেন”।
মিয়ানমারের পক্ষ থেকে যদি কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ না আসে তাহলে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা যায় কিনা এবং তাতে মিয়ানমারের মতো দরিদ্র দেশে কতোটা প্রভাব পড়বে এ প্রশ্নে তিনি বলেন,
“সেটাই গুরুত্বপূর্ন। তারা যদি এগিয়ে না আসে; আমি বলেছি নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে। নিশ্চয় তার প্রভাব পড়বে”।
এই প্রস্তাবে প্রেসিডেন্টের সমর্থন পাওয়া যাবে কিনা এ প্রশ্নে সেনেটর ডারবিন বলেন,
“আমি আশা করি পাওয়া যাবে। তবে নিশ্চিত করে জানি না তিনি কতোটা এগিয়ে আসবেন”।
ভাইস প্রেসিডেন্ট পেন্স কতোটা এগিয়ে আসবেন সে প্রসঙ্গে রতিনি বলেন তিনি একজন ঝানু রাজনীতিক এবং তাকে রাজী করানোটা অতো কঠিন নয়।
মিয়ানমারে কারেনস এবং অন্যান্য খ্রিষ্টান সম্প্রদায় রয়েছে। রোহিঙ্গা মুসলিমদের মতো মারাত্মকভাবে না হলেও তারাও অনেক সময় অনেক ধরনের নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন, তাদেরকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কি চিন্তা ভাবনা রয়েছে সে বিষয়ে বলেন,
“অবশ্যই। আমি এখন রোহিঙ্গা বিষয়ে জোর দিচ্ছি এই মুহুর্তে তাদের সেবা প্রয়োজন। অন্যাণ্য সম্প্রদায়ের বেলাতেও একই কথা একই অবস্থান আমাদের। গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে সকল ধর্ম বর্ণ জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে।