অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশী সিলেটে: নারী ও শিশুর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সাংবাদিক কর্মশালা, প্রতিবেদন ৪


জন্মের সময় শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হার দেশের অন্যান্য জেলার চাইতে সবচেয়ে বেশী সিলেটে। এর কারন অনেক। বিভিন্ন সময় আমরা টিভিতে নিউজ করতে গিয়ে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেছি একধরনের কুসংস্কারই এই মৃত্যুর জন্য অনেকটা দায়ী। সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মৃত্যুর হার বেশী । এর মধ্যে সিলেটের গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট এলাকায় মৃত্যুর সংখ্যা বেশী । তাছাড়া অন্যান্য উপজেলায় কিছু কিছু এলাকায় এই মৃত্যুর ঘটনা ঘটে থাকে। প্রথমতঃ হচ্ছে, গ্রামাঞ্চলে একশ্রেনীর মানুষ মনে করে ধাইমা থাকতে পরপুরুষ (অর্থাত্ চিকিত্সককে পরপুরুষ বা মহিলা চিকিত্সককেও বোঝানো হয়েছে) কেনো সন্তানসসম্ভবা নারীকে দেখানো হবে। এতে নাকি গোনাহ হবে এবং সমাজে এ নিয়ে নানা কথা উঠবে। মূলতঃ এসব কারনে চিকিত্সকের কাছে সন্তানসম্ভবা মহিলাকে আনা হয়না। ফলে অনভিজ্ঞ ধাত্রী দিয়ে প্রসব ঘটানো হয়। তারাই বাচ্চার নাড়ী কাটেন বাঁশের পাতলা ধারালো সবুজ অংশ দিয়ে (সিলেটি ভাষায় ঠল বলে)। ফলে ধনুস্টংকার, জন্ডিসসহ বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি থাকে। তাছাড়া গ্রামাঞ্চলের মানুষের জন্য দূরে হাসপাতাল থাকা এবং অপ্রতুল যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দরিদ্রতা প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিছু কিছু এনজিও কাজ করলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা এখনো কম। মোট কথা জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং কুসংস্কারের কবল থেকে বেরুতে না পারলে এই মৃত্যু হার কমানো কিছুটা কঠিন। তবে সিলেটের সীমান্তবর্তী উল্লেখিত উপজেলাগুলোতে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর জন্য আরেকটি বিষয়কে দায়ী করা হয়। তা হচ্ছে এসব উপজেলায় হাজার হাজার পাথর শ্রমিক কাজ করেন। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তারা এসব এলাকায় আসেন। অভাবের কারন এবং সচেতন না থাকায় এদের পরিবারে মায়ের মৃত্যুর হার বেড়ে যায় ।

মে মাসের শেষ সপ্তাহে একদিন সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সিলেটের একটি অভিজাত হোটেলে কর্মশালায় অংশ নিই। কর্মশালার অংশ হিসেবে সিলেট থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে জৈন্তাপুর উপজেলায় যাই সড়ক পথে। সেখানে গিয়ে উপজেলা সদরে এক সরকারী হাসপাতালে নবজাতক বিশেষ সেবা ইউনিট পরিদর্শন করি। সেখানে গিয়ে দেখা গেলো অত্যাধুনিক এই বিশেষ সেবা কেন্দ্র বাংলাদেশের আর কোথাও নেই। ৪ শয্যার এই সেবা কেন্দ্রে দুপুরে যাই। সেখানে পাঁচ ওয়ারমারে ৫টি শিশুকে দেখতে পাই। এদের বয়স ২ দিন থেকে ৫, ৪, ২১ এবং ২৪ দিন । মূলতঃ শ্বাস কষ্ট, সময়ের আগে জন্ম হওয়া শিশু, কম ওজন এবং জন্ডিস রোগের আক্রান্ত শিশুরা এখানে আসে । শূণ্য থেকে ২৮ দিনের শিশুকে এখানে ভর্তি করা হয়। এখানে দেখা গেলো ২ থেকে ১০ দিনের কোনো শিশু যদি জন্ডিসে আক্রান্ত হয় তবে এখানকার অত্যাধুনিক ওপেন ইনকিউবেটরে ফটো থেরাপী দেয়া হয়, ৪৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে রেডিয়েন্ট ওয়ারমার আছে। ফলে বাচ্চা জন্ডিসমুক্ত হয়ে যায়। এই সুবিধার ফলে এখানকার শিশুরা অনেক উপকৃত হচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে ৩টি বাচ্চা এখানে চিকিত্সা সেবা পাচ্ছে। ২০১৩ সালের মার্চ মাস থেকে ২০১৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত এখানে ১০৯৫টি শিশুকে চিকিত্সা দেয়া হয়েছে । শিশুদের বিনা খরচে এই চিকিত্সা দেয়া হয় এবং এখানকার সরকারী জৈন্তা হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসারের তত্বাবধানে এই কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

সিলেট কর্মশালায় অংশ নিয়ে আমরা শিশু ও মাতৃমৃত্যু সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম। এধরনের কর্মশালা যদি প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে করা যায় তাহলে মানুষের মধ্যে সচেতনতা আরো বাড়বে। একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ আর তা হচ্ছে, মফস্বল এবং গ্রামাঞ্চলের মসজিদগুলোতে যদি প্রতি শুক্রবারে ইমাম সাহেবরা শিশু জন্মের আগে মায়েদের হাসপাতালে গিয়ে চিকিত্সকের কাছে যাওয়া এবং ধাত্রী দিয়ে প্রসব না করানোর বিষয়টি মুসল্লীদের অবহিত করেন তাহলে জনসচেতনতা বাড়বে এবং কুসংস্কার কমে যাবে। তবে এ জন্যে গ্রামাঞ্চলের ইমামদের আগে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এ কাজে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি এবং গ্রামের মুরুব্বীদের একত্রিত করে এসব কাজে সম্পৃক্ত করা দরকার।

শাহ মুজিবুর রহমান জকন

সিলেট প্রতিনিধি, এটিএনবাংলা

XS
SM
MD
LG