পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজায়ীর সঙ্গে এ বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ভারতের শিশু শ্রম বিরোধী প্রচারক কৈলাশ সত্যার্থি গত তিন দশকে ৮০ হাজার শিশুকে শিশুশ্রমের কবল থেকে মুক্ত করেছেন। বহু বছর আগে সত্যার্থির সংগঠনের মাধ্যমে শিশুশ্রম থেকে মুক্তি পাওয়া এমন দুজন যুবকের সঙ্গে কথা বলে রিপোর্ট করেছেন আঞ্জনা পাসরিচা। সেলিম হোসেন শোনাচ্ছেন রিপোর্টটি:
ভারতের অন্যতম প্রধান অনুন্নত রাজ্য ঝাড়খন্দের এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান মানান আনসারি’র ছেলেবেলায় খনিতে কাজ করার ভয়াবহ সময়ের কথা এখনো মনে আছে। ছয় বছর বয়স থেকেই সকাল ৮টায় তার দিন শুরু হতো অভ্র খনিতে আকরিক সংগ্রহের মাধ্যমে। ঐ গ্রামের অধিবাসিদের সকলেই শিশুসহ খনিতে কাজ করাটাই ছিল স্বাভাবিক নিয়ম।
“আনসারি বলছে তাকে খনির নীচে নামতে হতো, যা ছিল ভয়ংকর, আমি পড়ে যাওয়ার ভয় পেতাম; ঘেমে ভিজে যেতাম; হয়ত অক্সিজেনেরে অভাবেই, এবং কোনো কোনো সময় পাথরের আঘাতে আমার হাত কেজটে যেতো”।
নয় ঘন্টার কর্মদিন শেষে সেই ক্ষুদ্র হাতে যোগাড় করা আকরিকের বিনিময়ে তাকে ৫ থেকে ১০ সেন্ট মূল্য পরিশোধ করা হতো।
নোবেল বিজয়ী কৈলাশ সত্যার্থি প্রতিষ্ঠিত সংগঠন বাচপান বাঁচাও আান্দালন অর্থাৎ সেভ দা চাইল্ডহুড মুভমেন্ট আনসারির জীবনে নাটকীয় মোড়ে এনে দেয়। ঔ সংগঠনের কর্মীরা তাকে সেখান থেকে নিয়ে যায় তাদের পূনর্বাসন কেন্দ্রে। এখন সে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে। আনসারির স্বপ্ন ডাক্তার হওয়া।
কার্পেট, চুড়ি, ইট তৈরী কিংবা খনিতে শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুদেরকে উদ্ধার করে উন্নত জীবন দেয়ার লক্ষ্যে ৩ দশক ধরে কাজ করছেন কৈলাশ সত্যার্থি। নয়াদিল্লিতে তার ছোট্ট একটি অফিস থাকলেও ভারতে খুব বেশী পরিচিত নন তিনি। বস্তুত: তাঁর সঙ্গে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া পাকিস্তানী ষোড়শী মালালা ইউসুফজায়ি যখন ঘরে ঘরে পরিচিত নাম তখন অনেক তরুণ সাংবাদিকসহ বহু লোকের প্রশ্ন ‘কে এই সত্যার্থি?’
শিশুশ্রম নিরসনে নিরবে নিভৃতে কাজ করেছেন সত্যার্থি। তিনি বলেন লক্ষ লক্ষ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ বেকার; অথচ এখনো শিশুশ্রমে নিয়োজিত রয়েছে যে বিপুল সংখ্যক শিশু। এইসব শিশুদের কাজের স্থল বয়স্করা নিতে পারেন।
“এইসব বেকার মানুষদের বেশিরভাগই ঔসব শিশুদের পিতামাতা। মজুরী কম বলে শিশুদেরকে কাজে পাঠানো হয় এবং তারা বেকার থাকেন। আর তাই শিশুশ্রম বন্ধ হলে বয়স্কদের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে”।
সত্যার্থির সংগঠনের পক্ষ থেকে শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুদের উদ্ধারে সরাসরি পদক্ষেপ নেয়া হয়।। প্রথমে কর্মীরা শ্রমে নিযুক্ত শিশুদের তথ্য সংগ্রহ করেন। এরপর আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় হঠাৎ সেখানে হানা দিয়ে শিশুদেরকে উদ্ধার করেন। কাজটি সহজ নয়। সত্যার্থিসহ সংগঠনের বহু কর্মীকে প্রায়ই মার খেতে হয়েছে, খারাপ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছে আর হুমকীতো হরহামেশাই আসছে।
উদ্ধারকৃত শিশুদের ঠিকমত গড়ে তোলা, শিক্ষিত করা এবং স্বাধীনভাবে চলার মতো করে তোলার ওপর নজর রাখেন সত্যার্থি।
২২ বছর বয়সী সুমন কুমার মাহতো ঔসব শিশুদের একজন যিনি এখন সেভ দা চাইল্ডহুড মুভমেন্টে গ্রাফিক ডিজাইনার হিসাবে কাজ করেন। মাসে বেতন ২৫০ আমেরিকান ডলার। ১৩ বছর পরও শিশুকালে ৮ বছর বয়সে বিহারে মায়ের সঙ্গে এক বাড়ীতে কাজ করার ভয়াবহ স্মৃতির কথা তার পরিস্কার মনে আছে। মা অসুস্থ হওয়ার তার স্থলে কিভাবে তাকে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল বর্ণনা করেন সেই স্মৃতি।
“মা চলে যাবার পর ঘর পরিস্কার ঝাড়ুসহ সব কাজ তাকেই করতে হতো। না পারলে তাকে বকাঝকা করা হতো; মারও দেয়া হতো। সে তার মনিবের সন্তানদের স্কুলে যেতে দেখতো, মন খারাপ হতো এই ভেতে যে সে কেনো স্কুলে যেতে পারে না”।
সত্যার্থির সমংগঠন তাকে উদ্ধার করে। পুনর্বাসন কেন্দ্রে আনসারিসহ বহু শিশুর ন্যায় মাহতোও বেড়ে ওঠে শিক্ষিত হয়ে। অথচ লক্ষ লক্ষ শিশু এখনো শ্রমে নিযুক্ত।
যদিও ১৪ বছরের কম বয়সীদের জন্য ভারতে ঝুঁকিপূর্ন কাজ করানো বেআইনী- শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো আইন নেই। সংসদের এ সংক্রান্ত একটি আইন নিয়ে আলোচনা চলছে। সত্যার্থি আশা করেন শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে কর্মকান্ড নতুন সরকারের সমর্থন পাবে। তিনি বলেন এই সরকার এমন একজনের নেতৃত্বের সরকার যিনি সদালাপী এবং যার এমন নিরহংকারী অতীত রয়েছে যিনি তার বাবার চায়ের দোকানে তাকে সহায়তা করতেন।
“একজন টি-বয় দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এখন তার সময় এসেছে এটি নিশ্চিত করা যে কেউ আর শিশুশ্রমে নিয়োজিত থাকবে না। অবশ্যই সব শিশুই প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না, তবে অন্তত তারা যেনো স্কুলে যেতে পারে, ভালো শিক্ষা পায় এটা নিশ্চিত করা”।
এটা নিশ্চিত হতে হয়তো আরো বহু সময় লাগবে। তবে শিশুশ্রম নিরসনের ন্যায় চমৎকার কাজ করে নোবেল পাওয়া এই মানুষটি সমগ্র দেশ, তথা গোটা বিশ্বের সব মানুষের কাছে যেটি আশা করেন তা হচ্ছে শিশুশ্রমের অবসানে সবাই যেনো সচেতন হোন।