অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

মিয়ানমারের ৫ জন মিলিটারি আমাকে ধর্ষণ করে: বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া নূরজাহান


মিয়ানমারের সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনী আর প্রতিপক্ষের হত্যা-ধর্ষণ, বাড়িঘর লুট আর জ্বালিয়ে দেয়াসহ অত্যাচার-নির্যাতনের কারণে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে এ পর্যন্ত হাজারে হাজারে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। জাতিসংঘের হিসেবে এই সংখ্যা ২ জানুয়ারি পর্যন্ত ৬৬ হাজার হলেও এই সংখ্যা এখন আরো বেড়েছে অর্থাৎ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত আছে। সীমান্তে রয়েছে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কড়া নজরদারী। কিন্তু তাদের অনুপ্রবেশ থেমে নেই।

নতুন যারা এসেছেন এই দফায় অর্থাৎ অক্টোবর থেকে আজ অবদি তাদের অধিকাংশই ঠাঁই পাননি কোনো স্থায়ী ক্যাম্পে। নতুনদের জন্য অস্থায়ী ক্যাম্প করা হয়েছে। আর এতে আশ্রয় পেয়েছেন খুব সামান্য সংখ্যক মানুষ। তবে অনেকেরই এখন অবস্থান রাস্তার পাশে বনে-জঙ্গলে,আর পাহাড়ে।

কক্সবাজার থেকে কুতুপালংয়ের পথে টিএন্ডটি এলাকায় রাস্তায় বসে থাকা ২৫ বছরের সখিনার সাথে কথা হয়। মাত্র ৪ দিন আগে তিনি এসেছেন বাংলাদেশে। সঙ্গে রয়েছে তার ছোট ছোট ৩টি সন্তান। সখিনার বাড়ি ছিল মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পিয়ারি বাজার এলাকায়।

সখিনা বললেন, "বার্মায় কোন পর্যায়ে নির্যাতন-নিপীড়ন করা হচ্ছে- তা আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারবো না। মারধর, হত্যা-খুন, বাড়িঘর লুট, জ্বালিয়ে দেয়া ওখানে নিত্যদিনের ঘটনা। আর এমনটা সহ্য করতে না পেরেই আমি চলে এসেছি। তিনি বললেন, মেয়েদের ধর্ষণ করা হয়-যা আমি ভালোভাবেই জানি, নিজে কিছুটা দেখেছিও। বিশেষ করে সুন্দরী মেয়েদের প্রতি সেনাবাহিনীসহ নির্যাতনকারীদের চোখ পড়ে বেশি। বাংলাদেশে এসেও আমরা অভাবে আছি। খেতে পাই না; আমি এখন অভুক্ত অবস্থায় আছি। আমার হাতে কোনো টাকা-পয়সা নেই। কোথায় থাকবো; আগামীকাল কি হবে তা আমি জানি না। এখানে বসে আছি আমি সাহায্যের আশায়", বললেন সখিনা।

আরও কিছুটা দূরে ৫৫ বছরের আয়েশা খাতুনের সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, "মানুষের কাছে শুনেছি রাস্তায় থাকলে নাকি খাওয়া পাওয়া যায়। সাহায্য পাওয়া যায়। কিন্তু সাহায্য তো মিলছে না। তিনি আরও বললেন, তার ৪ ছেলে এখনো মিয়ানমারে রয়ে গেছে; কি অবস্থায় আছে তার তা জানা নেই।"

কুতুপালং-এ নতুন অস্থায়ী আশ্রয় ক্যাম্প করা হয়েছে। ক্যাম্প বলতে শুধু পলিথিন দিয়ে ছোট ছোট ঘর। গাদাগাদি করে একেবারে ছোট জায়গায় রোহিঙ্গাদের বসবাস। এখানে কথা হয় রোজিয়া বেগমের সাথে। মিয়ানমারে তার স্বামীকে ধরে নিয়ে গেছে সেনাবাহিনী। বেঁচে আছে না মেরে ফেলেছে তা তার জানা নেই। দুধের শিশু কোলে নিয়ে, আরেক ছোট শিশুকে পাশে বসিয়ে ঘুপচি ঘরের মধ্যে বসেই রোজিয়া বেগম বলেন, "ইচ্ছা না করলেও থাকতে হচ্ছে এখানে। কারণ এটাই হচ্ছে নিয়তি। ওই দেশে আমাদের সব ছিল-ঘরবাড়ি, চাষাবাদের জমি। এখন কিছুই না থাকার অবস্থাকেই আমি আমার নিয়তি বলে মেনে নিয়েছি।"

ওই ক্যাম্পে কথা হয় ৮ বছরের শিশু ওয়ারেসের সাথে। সারা গায়ে অত্যাচারের চিহ্ন। ঘাঁ হয়ে গেছে শরীরে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী লোহার রড দিয়ে পিটিয়েছে। ওই সব দগ দগে ঘাঁ-তারই। তার সামনের দাঁতও ভেঙ্গে গেছে লোহার রডের আঘাতে।

এভাবে ২৮ বছরের জকোরিয়াসহ অনেকের সাথেই দেখা হয়, কথা হয়। যাদের শরীরে আঘাত স্পষ্ট; অনেকেরই হাত-পা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে।

কুতুপালং-এর ক্যাম্প থেকে আরও বেশ কিছু দূরে রাস্তায় কথা হয় রাখাইনের নাজাবুরু হাড়িবিলের নূরজাহান বেগমের সাথে। তিনি গণধর্ষণের শিকার-এমনটাই জানালেন তিনি। তিনি বললেন, "মিলিটারিরা প্রথমে ঘরের ভেতরে ঢুকে আমাকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে আনে। বাড়িতে আগুন দেয়া হয়। এরপরে শুরু হয় গণধর্ষণ। পালাক্রমে ২ জন আমাকে চেপে ধরে রাখে। আমার মনে আছে ৫ জন আমাকে ধর্ষণ করে। এরপর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আসলে কতোজন আমাকে ধর্ষণ করেছে তা বলতে পারবো না। কারণ আমার তো জ্ঞানই ছিল না।" জ্ঞান ফিরে এলে প্রতিবেশীরা তাকে উদ্ধার করে আত্মগোপনে নিয়ে যায়। ৩ দিন পরে তারা আবার আসে আমার খোজে। কিন্তু আমি এর মধ্যে পাহাড়ের জঙ্গলে আত্মগোপনে থাকি। আমার এক আত্মীয় সুযোগ বুঝে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। বাংলাদেশে এসে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পরে তাকে জানানো হলো-তিনি অন্তসত্ত্বা ।এরপরে চিকিৎসক ওষুধ দিয়েছে। নূরজাহান বললেন, "এখন আর পেটে বাচ্চা নেই। কিন্তু এখন কষ্টটা আবার অন্য রকম। খাওয়া নেই,থাকার জায়গা নেই,জীবন চলছে- না চলার মতোই। আমি জানি না আমার ভবিষ্যৎ কি হবে?" নূরজাহান বেগমের এমনই ভাষ্য।

সব ক্যাম্পেরই একই পরিস্থিতি। টেকনাফের লেদায় নতুন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কথা হয় ৫১ বছর বয়সী আবুল হোসেনের সাথে। তিনি জানান, "এই ক্যাম্পে গত ২ মাসে ২৫ কেজি করে চাল দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই ২৫ কেজিতে তো আর চলে না। তাদের সংসারে সদস্য সংখ্যা ১০ জন। অধিকাংশ সময়ই না খেয়ে অথবা মাঝে মধ্যে ছোটখাটো কিছু কাজ করে জীবন চলে। তবে না খেয়ে থাকাটাই এখন নিত্যসঙ্গী।"

লেদা ক্যাম্পে আশ্রয় মেলেনি মংডু-র মহসেনা বিবির। ৪ বছর আগে তার ২ ছেলেকে নাসাকা বাহিনী ধরে নিয়ে গেছে। আর তারা ফিরে আসেনি? মহসেনা বললেন, "আল্লাহই জানেন তাদের কি পরিণতি হয়েছে। এ দেশে ২ মাস ধরে এসেছি, আমার নাম রেজিস্ট্রি করা হয়নি। সাহায্য নেই, সহযোগিতা নেই। কোনো ত্রাণ আমি পাইনি।"
এমন এক নিদারুন দু:খ আর সীমাহীন কষ্ট বুকে নিয়েই হাজারো নুরজাহান, আবুল হোসেন আর ওয়ারেস-রা বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। নিজ দেশ মিয়ানমারেরও ছিলেন তারা পরবাসী; আর এখানে এসেও তাদের এক অনিশ্চিত জীবন-যাপন। তাদের মতে, এটা কেমন নিয়তি? কক্সবাজার থেকে আমীর খসরু।

XS
SM
MD
LG