অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

বাংলাদেশে আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট, বেড়েছে বিদ্যুতের লোডশেডিং


প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

বাংলাদেশে বিরাজমান তাপপ্রবাহ পরিস্থিতির পরিবর্তন না হওয়ায়, সোমবার (২২ এপ্রিল) থেকে আরো ৭২ ঘণ্টা ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি করেছেদেশটির আবহাওয়া বিভাগ। এর আগে গত ১৯ এপ্রিল আবহাওয়া অফিস হিট অ্যালার্ট জারি করে। আর্দ্রতা বেড়ে যাওয়ায়, অস্বস্তি তীব্রতর হতে বলে সতর্ক করেছে আবহাওয়া অফিস।

এদিকে, তাপপ্রবাহে ক্রমবর্ধমান চাহিদার বিপরীতে, সারাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহে প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে। এছাড়া তীব্র তাপদাহ প্রবণ এলাকাগুলোতে দেখা দিচ্ছে গরম জনিত রোগ-শোক। আর, খুলনার ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে দেখা দিয়েছে জলসংকট।

লোডশেডিং

ক্রমবর্ধমান চাহিদার বিপরীতে সোমবার বাংলাদেশে বিদ্যুতের প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে।পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অফ বাংলাদেশ (পিজিসিবি)-এর তথ্য অনুযায়ী, সোমবার বিকাল ৩টায় দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিলো ১৫ হাজার ২২০ মেগাওয়াট, তখন লোডশেডিং করতে হয়েছে ৯৯৬ মেগাওয়াট।

সোমবার সন্ধ্যায় বিদ্যুতের চাহিদার পূর্বাভাস ছিলো ১৫ হাজার ৬৬৬ মেগাওয়াট এবং সরবরাহের পূর্বাভাস ছিলো ১৬ হাজার ২০০ মেগাওয়াট।

সরকারি সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহরে বিদ্যুৎ বিভ্রাট এড়াতে, গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং বেড়েছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে পাওয়া সংবাদে জানা যায়, এই গ্রীষ্মে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে লোডশেডিংয়ের মাত্রা গ্রামীণ মানুষের দুর্দশা বাড়িয়ে তুলছে।

এদিকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পেট্রোবাংলার তথ্যে দেখা যায়, দৈনিক ৩ হাজার ৭৬০ মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে গ্যাস উৎপাদন হয়েছে ৩ হাজার ৪৬ মিলিয়ন ঘনফুট। এ কারণে, বেশ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র; বিশেষ করে যেগুলো প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে গ্যাস ব্যবহার করে; গ্যাস সংকটের কারণে সেগুলোতে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।

সোমবার বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ২ হাজার ৩১৬ দশমিক ৯ এমএমসিএফডি চাহিদার বিপরীতে ১ হাজার ৩৪৯ দশমিক ৯ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ পেয়েছে।

মেহেরপুরে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা

বাংলাদেশর অন্যতম প্রধান তাপপ্রবাহ প্রবন জেলা মেহেরপুর। এই জেলায় গত এক সপ্তাহ ধরে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রির বেশি রেকর্ড করা হয়েছে। প্রতিদিনই ৪২ থেকে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে ওঠানামা করছে তাপমাত্রা।

দিন ও রাতের তাপমাত্রায় খুব বেশি পার্থক্য না থাকায়, জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অসুস্থ হয়ে পড়ছে মানুষ; বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক মানুষ বেশি অসুস্থ হচ্ছে। পেটের পীড়া, ঠান্ডা জ্বর, কাশি, সর্দি, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, পানিশূন্যতা, শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। বাড়ছে হিট স্ট্রোকের রোগী।

তীব্র গরমে মেহেরপুরের হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন বাড়ছে রোগীর সংখ্যা।
তীব্র গরমে মেহেরপুরের হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন বাড়ছে রোগীর সংখ্যা।

তীব্র গরমে মেহেরপুরের হাসপাতালগুলোতেও প্রতিদিন বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে শয্যা সংকট।

রবিবার (২১ এপ্রিল) মেহেরপুর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল, গাংনী ‍ও মুজিবনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ঘুরে দেখা গেছে, বেড না পেয়ে মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন রোগীরা।

জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. সাজ্জাদ বলেন, গত এক সপ্তাহে ১ হাজার ৩১৩ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এদের মধ্যে ২২৩ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। ২১০ জন ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি ফিরেছে।

মেডিসিন ও গাইনি বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৪৫০ নারী। শিশু ওয়ার্ড ভর্তি ২৪০ জন। ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি ফিরেছে ১৫৫ জন শিশু। এছাড়া উন্নত চিকিৎসা নিতে, ১০ জনকে অন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।

আরএমও আরও জানান, এক সপ্তাহের মধ্যে পুরুষ বিভাগে ৩৫০ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। এরমধ্যে মারা গেছে ৬ জন রোগী। এছাড়া সার্জারি বিভাগে ভর্তি হয়েছে ৫০ জন। চিকিৎসা শেষে ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৩১১ জন।

গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডাক্তার আব্দুল্লাহ মারুফ বলেন, এক সপ্তাহে এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩৫২ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে শিশু ১১২ জন, নারী ১৪৬ জন ও পুরুষ ৯৪ জন। এসব রোগীরা অধিকাংশই চিকিৎসা শেষে ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। রোগীদের মধ্যে বৃদ্ধ ও শিশুর সংখ্যা বেশি।

মুজিবনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগে কর্মরত চিকিৎসক আহসান হাবিব জানান, গত এক সপ্তাহে এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৮০ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এদের মধ্যে অধিকাংশই শিশু ও বয়স্ক রোগী।

মেহেরপুর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক চিকিৎসক জমির মোহাম্মদ হাসিবুস সাত্তার বলেন, গরম বাড়ায় হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বেড়ে। রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে চিকিৎসকগণ কাজ করছেন।

এদিকে, চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জামিনুর রহমান জানান, গত কয়েকদিন থেকে চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে তীব্র তাপদাহ বয়ে যাচ্ছে। এখন তা অতি তীব্র তাপদাহে রূপ নিয়েছে। এই মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ অঞ্চলে আপাতত বৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা নেই।

খুলনায় সুপেয় পানির সংকট

খুলনার দাকোপ উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় শুষ্ক মৌসুমের শুরু থেকেই সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এর সঙ্গে চলছে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ; এতে, জন জীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে।

দ্বৈত সংকটে, বিশুদ্ধ খোলা পানি বিক্রির দোকানে এখন দীর্ঘ লাইন দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ বাধ্য হয়ে ডোবা-নালার পানি পান করছেন।আক্রান্ত হচ্ছেন ডায়রিয়াসহ নানা পানিবাহিত রোগে।

সুন্দরবন ঘেঁষা দাকোপ উপজেলা ৩টি পৃথক দ্বীপের সমন্বয় গঠিত। এর চার পাশে নদীতে লবণ পানির প্রচণ্ড চাপ থাকায় খরা মৌসুমে সুপেয় পানির চরম সংকট দেখা দেয়। প্রতি বছরের মতো এবারও ১টি পৌরসভা ও ৯টি ইউনিয়নের সর্বত্র সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে।

বর্তমানে দুই লাখেরও বেশি মানুষ সুপেয় পানির সংকট মোকাবেলা করছেন। চলতি রবি মৌসুমে এ অঞ্চলের প্রধান ফসল তরমুজ, বোরো ক্ষেতেও সেচ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। অনেক কৃষক লোকসানে পড়েছেন।

এই এলাকার গভীর নলকুপ কাজ করেনা। অগভীর নলকুপ যা আছে, তার অধিকাংশ অকেজো। কিছু নলকুপের পানিতে লবণ, আর্সেনিক এবং অতিরিক্ত আয়রন পাওয়া যাচ্ছে। এলাকার মানুষের খাবার পানির প্রধান ব্যবস্থা পুকুরের পানি ফিল্টার করে খাওয়া।

পুকুরগুলোতে পানি স্বল্পতা দেখা দেয়ায়, অনেক ফিল্টার বা পিএসএফ অকেজো হয়ে পড়েছে। এলাকার স্বচ্ছল ব্যক্তিরা বটিয়াঘাটা, খুলনাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে পানি কিনে এনে জীবন ধারণ করছেন।

কালাবগি এলাকার রবিউল ইসলামসহ অনেক বাসিন্দা জানান, প্রায় ৫ কিলোমিটার পথ নৌকায় যাওয়া আসা করে কৈলাশগঞ্জ এলাকা থেকে বিশুদ্ধ পানি এনে খেতে হচ্ছে। আর যাদের অবস্থা ভালো, টাকা পয়সা আছে, তারা পানি কিনে খায়। এলাকার গরিব মানুষ সরাসরি পুকুরের পানি পান করছেন বলে তিনি জানান।

দাকোপের হোটেল মালিক রচীন বলেন, “পানি সংকটের কারণে খরিদ্দারদের পানি দিতে পারছি না। পুকুরের পানি খাবার অনুপযোগী হওয়ায় তা দিয়ে ধোয়া-মোছার কাজ চলছে।

চালনার মেয়র সনত কুমার বিশ্বাস বলেন, সুপেয় পানি সংকট নিরসনে, পৌরসভার পানির প্রকল্পের আওতায় একটি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্টের কাজ শেষ হয়েছে। এখন পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে, কাজ সম্পন্ন হলেই পৌর এলাকায় সুপেয় পানি সংকট অনেকটা নিরসন হবে।

উপজেলা উপসহকারী জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জানান, সুপেয় পানির আধারের মধ্যে ২ হাজার ৬৬৮টি রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং ট্যাংক, ২৭টি গভীর নলকূপ, ৫০০টি অগভীর নলকূপ সচল রয়েছে।

এছাড়া কয়েকটি এনজিও কিছু পানির ট্যাংক ও কয়েকটি পানি বিশুদ্ধকরণ প্লান্ট নির্মাণ করলেও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এই এলাকার অধিকাংশ মানুষ নিরাপদ সুপেয় পানির জন্য রেইন ওয়াটার হারভেস্টিংয়ের ওপর নির্ভরশীল বলে জানান তিনি।

মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ এবং খরার কারণে পানির চাহিদা তীব্র থাকে। এবারের তীব্র তাপদাহে এই চাহিদা আরো বেড়েছে বলে জানান তিনি।

XS
SM
MD
LG