অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

সাবের হোসেন চৌধুরী: (জলবায়ু) বাসটিকে ব্যবহার করার বিষয়ে আমরা চিন্তা ভাবনা করছি


বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট-এর বিশেষ বাস।
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট-এর বিশেষ বাস।

‘জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের (সিসিটিএফ) টাকা দিয়ে আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে চালু করা একটি বাস, একমাসেরও কম সময় ব্যবহার করার পর গত চার বছর ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পরে আছে।

এ বিষয়টি নিয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানান, "আমরা নানা অপশন যেগুলো আছে, সেগুলো দেখছি, শুধু বাসটিকে রান করার বিষয় নয়, এটাকে কিভাবে ব্যবহার করা যায়, এটা নিয়ে যদি নতুন ভাবে আমাদের কিছু চিন্তা করতে হয় সেটাও আমরা করবো। তবে যেহেতু একটা সম্পদে আমরা বিনিয়োগ করেছি, আমরা চাইবো যতটুকু সম্ভব সেই বিনিয়োগ থেকে আমরা যেন কিছুটা হলেও সুফল ভোগ করতে পারি।"

বাসটি চার বছর ধরে চালু রাখতে না পারায় রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় হয়েছে কিনা জানতে চাইলে, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "এটি অতীতের একটি ঘটনা, এই ঘটনা নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চান না। তবে জলবায়ু পরিবর্তন শুধু না, যেকোন ব্যাপার যখন বিনিয়োগ করা হয় তা ভেবে চিন্তে করা উচিত। বিনিযোগ পরিকল্পনাটা যেন সুষ্ঠু ভাবে হয়, পরিকল্পনাটি যেন টেকসই হয় সে বিষয় গুলো মাথায় রেখেই বিনিয়োগ করা দরকার বলে অভিমত দেন তিনি।

বাসটি কেনার মূল উদ্দেশ্যে

২০২০ সালের ১৫ মার্চ রাজধানীর আব্দুল গণি রোডের ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের সামনে তৎকালীন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন জলবায়ু বাসের উদ্বোধন করেন।

এই বাসের মাধ্যমে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে বাসটি কেনা হয়।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান ‘জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড (সিসিটিএফ) এর ব্র্যান্ডিং পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় বাস কেনার প্রকল্প নেয়া হয়।

প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট (বিসিসিটি)।

বিসিসিটি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি সংস্থা।

বিসিসিটি সূত্র জানায়, রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে মূলত একতলা এই বাসটি কেনা হয়।

এতে ব্যয় হয় দেড় কোটি টাকা।

নাম দেওয়া হয় ‘জলবায়ু বাস।

বাসের ভেতরে যন্ত্রপাতি ও উপকরণ বসাতে খরচ হয় আরও এক কোটি টাকা।

জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় ২০০৯-১০ অর্থবছরে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করা হয়।

এই তহবিলের অর্থ দিয়ে বাসটি কেনা হয়।

বাসটির ভেতর কী আছে

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসটিতে রয়েছে, ৭২ ইঞ্চির ডিজিটাল এলইডি পর্দা (স্ক্রিন) আছে, যা বাইরের দিক থেকে দেখা যায়।

এছাড়াও রয়েছে ডিজিটাল এলইডি ডিসপ্লে, মোবাইল থ্রিডি সিনেমা সিস্টেম, ইন্টার‍্যাক্টিভ কিয়স্ক, সোলার প্যানেলস ফর গ্রিন এনার্জি ও ওয়াইফাই এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক তথ্য সংবলিত আর্কাইভ।

এছাড়াও রয়েছে সচেতনতামূলক টেলিভিশন বিজ্ঞাপন, রেডিও বিজ্ঞাপন, থিম সং এবং বিভিন্ন ধরনের ডকুমেন্টারি। এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে কীভাবে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। এই পরিবর্তন ঠেকাতে আমাদের করনীয় কী? কিভাবে কার্বন নিঃসরণ কমানো যায়, কীভাবে বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন সরবরাহ বৃদ্ধি করা যায়? কথা ছিলো সে সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সচেতন করার জন্য বাসের ডিজিটাল এলইডি পর্দায় জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে জানতে পারবে শিক্ষার্থীরা।

কর্তৃপক্ষ কী বলছে?

বাস কেনার পর করোনা মহামারি শুরু, বাস চালানোর জন্য নির্দিষ্ট ড্রাইভার না থাকা এবং বাসটি চালু করার আগেই প্রজেক্টেব মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় বাসটি ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি বলে জানিযেছেন সংস্থার কর্মকর্তারা।

জলবায়ু বাসটি কেনার পরপরই দেশে করোনা মহামারি শুরু হয়।

অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়।

এ কারণে বাসটি ব্যবহার করা যায়নি।

দুই বছর করোনা থাকায় এর মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে বাসটি ব্যবহারে আর কোন আগ্রহ দেখায়নি প্রকল্পের লোকজন।

করোনার দীর্ঘদিন পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলে।

কিন্তু করোনা-পরবর্তী সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আর তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে সংস্থাটির কর্মকর্তারা।

বাসটি এখন কী অবস্থায় আছে?

এদিকে গত বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের সামনে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাসটি পরিবেশ অধিদফতরের ভেতর খোলা স্থানে গাছের নিচে রাখা হয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার না হওয়ায় বাসের বাইরে ধুলার স্তর জমেছে।

বাসের দরজায় তালা মেরে রাখা হয়েছে।

সেখানে দায়িত্বরত একাধিক নিরাপত্তা রক্ষী এবং সরকারি ড্রাইভারের সাথে কথা হয়।

তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভয়েস অফ অমেরিকাকে বলেন, বাসটি ধীর্ঘদিন ধরে এখানে পড়ে আছে।

মাঝে মাঝে একজন ড্রাইভার এসে বাসটি স্টার্ট দেয়।

যাতে বাসের ইঞ্জিনটি সচল থাকে।

কতদিন ধরে পড়ে জানতে চাইলে তারা বলেন ৩/৪ বছর হবে।

এদিকে ১৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার মহাখালিতে অবস্থিত অফিসে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের একাধিক কর্মকর্তার সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।

তাদের অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, জলবায়ু বাসটি কেনার আগে কোন ধরনের সমীক্ষা করা হয়নি।

বাসটি কতদিন চলবে, কিভাবে চলবে, বাসের কার্যক্রম পরিচালনার কোন ধরনের জনবল নিয়োগ দেয়ার কথা চিন্তা করা হয়নি।

ফলে বাসটি কে চালাবে?

ড্রাইভারের বেতন কোন খাত থেকে দেয়া হবে?

এসব বিষয়ে কোন নীতিমালা করা হযনি।

এতে করে বাসটির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

ফলে পুরো অর্থটাই জলে গেছে।

জলবায়ু বাস নামানোর উদ্দেশ্যে কতটা সফল হযেছে অথবা হয়নি জানতে চাইলে বাংলাদেশ জলবাযু পরিবর্তন ট্রাস্টের পরিচালক মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "জলবায়ু বাসটি বর্তমানে পরিবেশ অধিদপ্তরে সংরক্ষিত আছে। আমাদের অফিসে স্থান সংকুলান না হওয়ায় বাসটি পরিবেশ অধিদপ্তরে রাখা হয়েছে। আর প্রজেক্টটি অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে।"

তিনি আরও বলেন, "এই প্রজেক্টে মোট তিনজন পিডি (প্রজেক্ট ডাইরেক্টর) ছিলেন। প্রজেক্টের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে কিনা এটা আমি বলতে পারবো না। আমি কখনোই এটার দায়িত্বে ছিলাম না।"

স্থায়ী কোনো ড্রাইভার রাখা হয়নি

জলবায়ু তহবিলের আড়াই কোটি টাকা ব্যয় হলেও বাসটি চালানোর জন্য স্থায়ীভাবে কোন ড্রাইভার নিয়োগ দেয়া হয়নি।

ফলে শুরু থেকেই বাসটি অস্থাযী ড্রাইভার দিয়ে চালানো হয়েছে বলে পরিবেশ অধিদপ্তরের জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের একাধিক কর্মকর্তা ভয়েস অফ আমেরিকাকে নিশ্চিত করেছেন।

জলবায়ু বাসটি ড্রাইভারের অভাবে চালানো সম্ভব হয়নি এটা কতটা সত্য জানতে চাইলে জলবাযু পরিবর্তন ট্রাস্টের পরিচালক মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান বলেন, "বাস চালানোর জন্য একজন ড্রাইভার প্রয়োজন। এখন এক্সিকিউট প্ল্যানে সেটা আছে কিনা আমি সেটা বলতে পারছি না। পিপিতে সেটা সাধারণত রাখতে হয়। এক্সিকিউটিভ প্ল্যানে কী কী রাখা দরকার সেখানে একজন বাস চালক বেতন সহ রাখা দরকার ছিল, তবে আমার জানা মতে এই মুহূর্তে কোন চালক নাই। প্রজেক্ট যতদিন ছিল ততদিন চালক ছিল। বোর্ড অব ট্রাস্ট সাধারণত দুই বছরের জন্য প্রজেক্ট দেয় এবং পরবর্তীতে প্রয়োজন হলে সময় বৃদ্ধি করে। কিন্তু এই প্রজেক্টের সময় কতটা বৃদ্ধি হয়েছিল এটা আমার জানা নেই।"

বাসটি চালানোর জন্য ড্রাইভার নেয়ার বিষয়টি কেন পরিকল্পনায় রাখা হলো না, এই বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, "একটি পরিকল্পনা যখন আমরা গ্রহণ করি তখন এটার সার্বিক বিষয় নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে, এটা এককালীন একটা বিনিয়োগ না। আমি শুধু একটা বাস কিনলাম বা কোন একটা কিছু ক্রয় করলাম, পরবর্তীতে সেই ক্র‍য় থেকে আমরা যেন সর্বোচ্চ সুবিধাটা পায় এবং পরিচালনার বিষয়টি যেন টেকসই হয় সেই বিষয় গুলোর দিকে নজর দিতে হবে।"

তিনি আরও বলেন, "বর্তমানে আমাদের যে জলবায়ু পরিবর্তনের ট্রাস্ট তহবিল আছে সেটা যেন সঠিক ভাবে ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ যারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে যারা আছে, যারা সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের বর্তমানে যে চ্যালেঞ্জগুলো আছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের যে বিষয়টা সেটা মোকাবিলা করার জন্যেই যেন তহবিলটা ব্যবহার করা হয়, সেটার জন্য আমরা একটি নতুন নীতিমালা করেছি এবং অধিকতর স্বচ্ছতার জন্য যে সমস্ত আবেদন আমরা পাবো সেগুলো কে আমরা একটি নান্দনিক সিস্টেম বা ম্যাট্রিক্স এর মধ্যে নিয়ে এসেছি। সুতরাং আমি আশা করবো যে আগামীতে আমরা যে প্রকল্পগুলো বাছাই করবো সেগুলো অবশ্যই যেন জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের যে আইন আছে, সে আইনের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যগুলোর সাথে যেন সংগতিপূর্ণ হয়।"

এই মুহুর্তে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের ১৭০-১৮০ টি প্রকল্প চলমান আছে

জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টে বর্তমানে কতটি প্রজেক্ট চলমান রয়েছে, সবচেয়ে সফল প্রজেক্ট কি জানতে চাইলে , জলবাযু পরিবর্তন ট্রাস্টের পরিচালক মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান বলেন, "আমাদের একটি প্রজেক্ট ছিল ভাসমান সবজি প্রকল্প, যেসব এলাকায় জলবদ্ধতা সমস্যা রয়েছে সেখানে বেড় তৈরি করে যে ভাসমান উপায়ে সবজি চাষ করা হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এটা বাস্তবায়ন করেছিল এবং এটার জন্য আমারা বিদেশ থেকে পুরষ্কারও পেয়েছি। তিনি বলেন, এই মুহুর্তে আমাদের ১৭০-১৮০ টি প্রকল্প চলমান আছে এবং আমরা এসকল প্রকল্পে অর্থায়ন করে থাকি।"

জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট এর প্রধান কাজ হল জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় জনগণের সক্ষমতা বৃদ্ধি।

তাদের জীবন জীবিকার মান উন্নয়ন এবং এ সংক্রান্ত পরিকল্পনা গ্রহণ।

এই ট্রাস্টটি গঠন হয়েছিল ২০১৩ সালের ২৪ শে জানুয়ারি। তবে ২০১০ সাল থেকেই একটি প্রকল্প হিসেবে এর কার্যক্রম শুরু করা হয়েছিল।

XS
SM
MD
LG