জাপানের উদীয়মান এনবিএ (NBA) তারকা রুই হাচিমুরা পতাকা বহনকারী হিসাবে জাপানের অলিম্পিক দলের নেতৃত্ব দেন। টেনিস তারকা নাওমি ওসাকা প্রজ্বলন করেন অলিম্পিক প্রদীপ। অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাপানের মিশ্র বর্ণের এই দুই ক্রীড়াবিদ দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এবার জাপানি সমাজের বর্ণ বৈচিত্র্য উঠে আসে এবং এর অভাব যে দেশটিতে আছে তাও স্পষ্ট হয়।
ওসাকা এবং হাচিমুরা দুজনেরই বাবা অথবা মার মধ্যে কেউ একজন বিদেশী, অপরজন জাপানি। পুরোপুরি জাপানি না হওয়ায় দুএকজন উগ্র জাতীয়তাবাদি অনলাইনে সমালোচনা করা ছাড়া বেশিরভাগ লোকই তাঁদেরকে স্বাগত জানান। এতে করে বর্ণ পরিচয় নিয়ে এক ধরণের বিতর্কের সৃষ্টি হয়, প্রশ্ন ওঠে একজন জাপানি হবার অর্থ কি?
ওসাকা ও হাচিমুরার অসংখ্য ভক্ত রয়েছে। দু’জনই নিসিন কাপ নুডলসের মডেল। সম্প্রতি ওসাকা, প্যানাসনিকের সাথে একটি বিজ্ঞাপন করার চুক্তি করেছেন এবং হাচিমুরা, তাইশো ফার্মা এনার্জি ড্রিঙ্ক ও সুমিতোমো মিতসুই ব্যাংকিং কর্পের বিজ্ঞাপন করেছেন।
তাঁদের সাফল্য জাপানে অন্যান্য মিশ্র জাতি ও বর্ণের মানুষ যারা বিদেশী বিয়ে করে বা কাজ করতে গিয়ে জাপানে স্থায়ী হয়েছেন তাদের অনেকের সঙ্গে মিলে গেছে। তারপরও বর্ণ বৈচিত্রের প্রতি সহনশীলতা দেশটিতে কম।
জাপানে মিশ্র জাতিবর্ণের বাচ্চাদেরকে প্রায়শই ‘হাফু’ বা অর্ধেক বলে ডাকা হয়। প্রতি বছর দেশটিতে এ রকম ২ শতাংশ শিশু জন্ম নেয়। পুরোপুরি জাপানি না হওয়ায় তাদেরকে প্রায়শই হীনমন্যতার শিকার হতে হয়, ভিন্ন চেহারার হওয়ায় তাদের হয়রানি করা হয়।
জাপানি ও কেনিয়ান বংশোদ্ভূত মেলিসা লুনা ইসোমোতো বড়ো হয়েছেন জাপানে। ২৩শে জুলাইয়ের অলিম্পিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মশাল বহনকারী ওসাকা তাঁর রোল মডেল। ওসাকাকে দেখে তিনি খুব খুশি। কিন্তু তাঁর কষ্ট হয় যখন পুরো জাপানি না হওয়ার কারণে ওসাকাকে অনলাইনে সমালোচনা করা হয়।
ইয়োকোহামার বাড়ি থেকে জাপানি ভাষায় দেয়া সাক্ষাৎকারে ইসোমোতো বলেন, “নাওমিকে যারা গালাগালি করছে, তারা আমাকে এবং অন্য যারা মিশ্র বর্ণের তাদেরকেও গালি দিচ্ছে। এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক এবং যথা সম্ভব ওগুলো না পড়ার চেষ্টা করি”।
টুইটারে একজন লিখেছেন, “সে জাপানি ভাষা প্রায় বলতেই পারে না, সেতো খাঁটি জাপানিই নয়”।
আরেকজন লিখেছেন, “তাঁকে আমরা চাই না, আমরা চাই পুরোপুরি জাপানি কাউকে, অথবা রুই হাচিমুরার মতো অন্তত ‘হাফু’ জাপানি বলতে পারে এমন কাউকে”।
চারদিন পর ওসাকা, খেলার সময় তৃতীয় রাউনডে চেক রিপাবলিকের মারকেটা ভন্দ্রসোভার কাছে হেরে যাবার পর জাপানে অনেকেই খুশি হয়ে তাঁর হারকে উদযাপন করেছেন।
অনেক সমালোচক অনলাইনে লিখেছেন, “তারাই জাপানি যাদের পিতা মাতা দুজনই জাপানি এবং পরিষ্কার ভাষায় জাপানি বলে”।
হাচিমুরার মতো যারা জাপানে বড়ো হয়েছে, অনেকেই তাদেরকে জাপানি বলে মানলেও ওসাকার মতো যারা যুক্তরাষ্ট্রে বা অন্য দেশে বড়ো হয়েছেন এবং ভালভাবে জাপানি ভাষায় কথা বলতে পারেন না তাদেরকে তারা জাপানি-আমেরিকান বলতে চায়।
ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনে ওসাকা বর্ণবাদ বিরোধীদের সমর্থন করেছিলেন এবং মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন বলে অনেকেই তাঁর বিরোধিতা করেন।
আফ্রিকান বংশোদ্ভূত ইসোমোতোকে প্রায়শই শুনতে হয় সে দেখতে অন্য রকম।
তিনি বলেন, “আমাকে প্রায়ই বিদেশী বলা হয়, বলা হয় কেনিয়ায় চলে যাও। কখনো কখনো গরিলাও ডাকে। এ রকম হয়রানি এবং বর্ণ বিদ্বেষের কারণে মাঝে মাঝে আমার নিজের শেকড়ের প্রতি অস্বস্তি বোধ করি, মনে হয় জাপানি হলেই ভালো হতো”।
তিনি যখন উচ্চ বিদ্যালয়ে বহু জাতিক কিংবা ভিন্ন সাংস্কৃতিক পটভূমির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিলিত হন তখন আত্মবিশ্বাস খুঁজে পান এবং তাঁর আফ্রিকান অতীত সম্পর্কে জানতে শুরু করেন। তার পরও একাত্ম হবার চাপটা এতো বেশি যে তিনি অন্যান্য জাপানি শিক্ষার্থীর মতো নিজের চুল সোজা করে ফেলেন।
ওসাকা সিটি ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানী জুলিয়ান কিয়ান বলেন জাপানের সমাজে এই ধরণের অসহিষ্ণুতা লিঙ্গ ভেদে সংখ্যালঘু ও কোরিয়ান এবং চীনা সম্প্রদায়ের মানুষদের ওপরও প্রভাব ফেলে। তাদের শারিরীক গঠনের জন্য হয়রানির শিকার না হলেও, ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক কারণে তারা বৈষম্যের শিকার হন। তিনি বলেন, “নাওমি ওসাকার মশাল প্রজ্বলন এটা দেখিয়ে দিয়েছে যে জাপানের যখন প্রয়োজন হয় তখন বর্ণ বৈচিত্র্যকে সামনে আনে”।
তিনি বলেন জাপানে মিশ্র জাতি বর্ণের লোকদেরকে মানব সম্পদ বিবেচনা করা হয়। বিদেশীদের একমাত্র তখনই স্বীকৃতি মেলে যখন তারা জাপানিদের কোন কিছুতে প্রভাব না ফেলতে পারে বা জাপানিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ হবার অগ্রাধিকারে বিঘ্ন না ঘটাতে পারে।
বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল বয়স্ক মানুষের দেশ হবার পথে জাপান। দেশটিতে বিদেশ থেকে অদক্ষ লোক কাজ করতে যাবার অনুমতি দিয়ে তাঁদের অভিবাসন নীতি তৈরি করেছে। শর্ত হচ্ছে তারা কেউ পরিবার নিয়ে জাপান যেতে পারবে না এবং চুক্তি শেষ হলে ফিরে যাবে।
‘পিওর জাপানিজ’ বা খাঁটি জাপানি শব্দটি সাধারণত জাপানিরা তাদের মধ্যেকার ঐক্য জোরদার করার জন্যে এবং জাতীয় পরিচয় তুলে ধরতে ব্যবহার করে। অন্যদেরকে টার্গেট করা বা বাদ রাখারও এক ধরণের উপায় এটি। জাপানের বিনোদন ও ক্রীড়া খাতে মিশ্র জাতি- বর্ণের উপস্থিতি বাড়ছে। যখন প্রয়োজন, জাপান তখন তাদেরকে সেইমতো ব্যবহার করছে।
জাপানের ৫৮০ সদস্যেরও বেশি অলিম্পিক দলে অন্তত ৩০ জন মিশ্র জাতি বর্ণের খেলোয়াড় রয়েছে। এর মধ্যে আছে টোকিওতে জন্ম নেয়া জাপানি মা ও ঘানার পিতার সন্তান স্প্রিণ্টার আব্দুল হাকিম সানি ব্রাউন এবং অলিম্পিক জুডো স্বর্ণ পদক বিজয়ী টোকিওতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা আমেরিকান জাপানি অ্যারোন উল্ফ।
অতীতেও জাপানে অনেক মিশ্র জাতি বর্ণের তারকা ছিলেন। জাপানে বড়ো হওয়া চীনা নাগরিক হোম রান কিং সাদাহারু ওহ তাঁদের মধ্যে একজন।
জাপানি মা এবং আফ্রিকান আমেরিকান সেনা সদস্যের সন্তান বেসবল তারকা সাচিও কিনুগাসাকে জাপানিরা জাপানি হিসাবেই মেনে নিয়েছেন। তিনি জাপান সরকারের সম্মানজনক পিপলস অনার এওয়ার্ডও পেয়েছেন। শিশু বয়সে বিদেশী হিসাবে হয়রানির সম্মুখীন হওয়া কানাগুসা ২০১৮ সালে মারা যান।
ওহ গতমাসে অলিম্পিক উদ্বোধনীতে টর্চ রিলেতে অংশ নেন।
তারপরও যে দেশটিতে জাতীয়তাবাদের ওপর এতোটা জোর দেয়া হয়, সেখানে জীবন মাঝে মধ্যে কঠিন হয়ে ওঠে।
মে মাসে হাচিমুরার ছোট ভাই অ্যালেন, যিনি কলেজের ফুটবল দলে খেলেন, সাম্প্রতিক সময়ে তাদেরকে লক্ষ করে এক বাজে মন্তব্যের সূত্র ধরে টুইটারের বলেন, “লোকে বলে জাপানে বর্ণবাদ নেই, কিন্তু কেউ কেউ এমন বাজে বর্ণবাদী মন্তব্য করেন। আমি মনে করি না সেসব প্রকাশ করলে কোন পরিবর্তন আসবে। আমি শুধু বর্ণবাদ সমস্যার কথা জানানোর জন্যে এটা বললাম”
হাচিমুরা লেখেন, “এ ধরণের বার্তা প্রায় প্রতিদিনই আসে”।
ইসোমোতো বলেন তিনি এখন আর তাঁর মিশ্র বংশ নিয়ে শঙ্কিত নন। তাঁর রোল মডেল ওসাকার মতো যারা এখনো এ নিয়ে সমস্যায় আছেন তাদেরকে সাহায্য করতে চান।
ইসোমোতো বলেন, “আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয় আমি জাপানি না কেনিয়ান, আমি কোনোটাই বলি না। আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা জাপানে, এবং আমি উভয় সংস্কৃতি ধারণ করি। আমি যে কোনও একটার কথা বলতে পারি না। আমি বলি, আমি আমারই”।