অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

বাংলাদেশে মাদকের বিস্তার রোধে মদ সহজলভ্য করার চিন্তাভাবনা


মাদকের বিস্তার ঠেকাতে মদ আরও সহজলভ্য করা যায় কিনা তা নিয়ে বাংলাদেশের আইনপ্রণেতারা আলাপ-আলোচনা শুরু করেছেন। তবে কোনো সিদ্ধান্তে তারা পৌঁছাতে পারেননি। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির এক বৈঠকে এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। এই বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সংসদ সদস্যগণ, আইজিপি, র‍্যাব প্রধান, বিজিবি প্রধান ও মাদক অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু।

বাংলাদেশে মদ নিষিদ্ধ। মদ খেতে হলে লাইসেন্সের প্রয়োজন হয়। ২০২০ সাল পর্যন্ত ৯০ হাজার ব্যক্তিকে মদপানের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। সারা দেশে ১৮৯টি মদের বার বা দোকান রয়েছে। বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা অনেক বেশি। বলা হয়েছে, ঢাকা শহরে ৮৪টি মদের বার রয়েছে। অথচ কয়েক হাজার অননুমোদিত দোকানে মদ বিক্রি হয়। ক্লাবগুলো বেআইনিভাবে মদ বিক্রি করে। এতে করে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হয়। বাংলা মদের ব্যবহার এই হিসাবের বাইরে।

প্রতিবছরই বিষাক্ত বাংলা মদ পানে মানুষের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। ১৯৯৯ সালের মে মাসে নরসিংদীতে বিষাক্ত মদপানে ১১৭ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ১৯৯৮ সালে গাইবান্ধায় পয়লা বৈশাখের সময় বিষাক্ত মদপান করে ৭১ জনের প্রাণহানি হয়।

স্থায়ী কমিটির বৈঠকে কেউ কেউ যুক্তি দেন মদের ব্যবহার বাড়ানো হলে কিংবা সহজলভ্য হলে মাদক সেবন কমতে পারে। তাদের যুক্তি- ড্রাগ আর এলকোহল আলাদা দুটো জিনিস। মদ, বিয়ার ইত্যাদির ভেতর যদি ৫% এর নিচে এলকোহল থাকে তাহলে তা বৈধ করার পক্ষেও কেউ কেউ মত দেন। আবার কেউ কেউ যেসব মাদক হালকা ক্ষতিকর সেগুলোর ব্যবহার উন্মুক্ত করার পক্ষে যুক্তি দেন। তারা বলেন, আমেরিকা ও কানাডায় গাঁজাকে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। যদিও বৈঠকে বলা হয়েছে, এলকোহল সেবন বাংলাদেশে খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। এটাকে ঘিরে যেকোনো সময় জনবিশৃঙ্খলা হতে পারে। বাংলাদেশে ইয়াবা, এলএসডি, আইস, হেরোইন ও সিসার রমরমা বাজার।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী দেশে ১৫ ধরনের মাদক সেবন করা হয় । তবে র‌্যাব-পুলিশের হিসাবে এই সংখ্যাটা ছয় থেকে ১০ এর মধ্যে রয়েছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ অনুযায়ী ইয়াবা, সিসা, কোকেন, হেরোইন ও পেথিড্রিন জাতীয় মাদকের ব্যবহার, সেবন, বহন, আমদানি ও রপ্তানি বা বাজারজাত করার সর্বোচ্চ শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

তারপরও কমছে না মাদকের ব্যবহার। মাদকের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতিও জারি রয়েছে। বর্তমানে ৬৯ হাজার ৪৯০টি মামলা চলমান রয়েছে। এতে আসামি করা হয়েছে ৯১ হাজার ৩৬১ জনকে।

উল্লেখ্য যে, মাদক মামলায় গাইবান্ধায় রবি দাস নামের এক যুবককে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে তাকে এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়। বাংলাদেশে মাদক মামলায় এটাই প্রথম মৃত্যুদণ্ডের রায়।

এছাড়া দেশের বিভিন্নস্থানে মাদক মামলায় অনেকের যাবজ্জীবন জেল, জরিমানাও করা হয়েছে।

দেশে মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা নিয়ে কোনো সঠিক তথ্য নেই। ২০১৮ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট পরিচালিত প্রথম এক সমীক্ষায় দেখা যায়, দেশে মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩৬ লাখ। এর মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষের মধ্যে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৩৫ লাখ ৩৫ হাজার ৩০০ জন। আর ৭ বছরের বেশি কিন্তু ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু-কিশোর ও তরুণদের মধ্যে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৫৬ হাজার। মহিলাদের মধ্যেও মাদক সেবনের প্রবণতা অনেক বেড়েছে।

হাইকোর্টের রুল

ওদিকে মাদকদ্রব্য আইনে মদকে শ্রেণিভুক্ত করা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এই মর্মে একটি রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। ১৩ ডিসেম্বর বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খন্দকার দিলীরুজ্জামানের ডিভিশন বেঞ্চ এ রুল জারি করেন। রুলে আইন সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, অর্থ সচিব ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালককে চার সপ্তাহের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে। মদকে মাদক দ্রব্যের বাইরে রাখতে নির্দেশনা চেয়ে আদালতে রিট দায়ের করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের আর জে টাওয়ার হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট লিমিটেড ও ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ ফারুক।

রিটের পক্ষে আদালতে এডভোকেট আহসানুল করিম বলেন, "মদ ও অন্যান্য মাদক দ্রব্যকে একই সংজ্ঞায় ফেলা হয়েছে। অনেক মাদকদ্রব্য আছে যেগুলো আমদানিযোগ্য না, যেগুলো বহন করা অপরাধ। এলকোহল আমদানি, রপ্তানিযোগ্য পণ্য। কিন্তু ইয়াবা, আইসসহ আরও অনেক মাদকদ্রব্য আছে যেগুলো নিষিদ্ধ পণ্য। এগুলো আমদানি বা রপ্তানিযোগ্য নয়। পানযোগ্য এলকোহল এবং নিষিদ্ধ মাদককে একই সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করায় নানাবিধ সমস্যা হচ্ছে। যারা এসবের ব্যবসা করেন তারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সুতরাং এই আইনকে একই সংজ্ঞায় শ্রেণিভুক্ত করা কেন সংবিধানের ৩১ ও ৪০ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না জানতে চেয়ে আদালত এই রুল জারি করেছেন।"

এ সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, "মদ ও এলকোহলকে মাদক হিসেবে চিহ্নিত করা আছে। যেহেতু বিষয়টি নিয়ে আদালত থেকে নির্দেশনা এসেছে এখন তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবো। কীভাবে লিকারকে আলাদাভাবে দেখা যায় তা বিস্তারিত আলোচনা করে জানাবো।"

XS
SM
MD
LG