প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সাবেক ব্যাক্তিগত আইনজীবি ও ঘনিষ্ঠ সহযোগী মাইকেল কোয়েন প্রতিনিধি পরিষদে যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তাতে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি অঙ্গনে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্পর্কে মাইকেল কোয়েনের মন্তব্য অনেককে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে ৪৫ বছর আগে, সত্তুরের দশকে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের বিরুদ্ধে তাঁর ব্যাক্তিগত সহকারীর দেয়া একই ধরনের স্বাক্ষ্যের সময়ে। সেই স্বাক্ষের সূত্র ধরেই প্রেসিডন্ট নিক্সন পদত্যাগ করেছিলেন। সেই ঘটনার আলোকে আমাদের জাতীয় সংবাদদাতা জিম মেলোন তাঁর রিপোর্ট তুলে ধরেছেন বর্তমান অবস্থার কথা।
গত সপ্তাহে প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যদের সামনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আইনজীবি মাইকেল কোয়েনের শুনানীতে নানা চমকপ্রদ বিষয় বেরিয়ে আসে। একদা, যে মানুষটির জন্য ‘প্রান দিতে পারি’ বলতেন মাইকেল কোয়েন; কংগ্রেসে স্বাক্ষ্য দেয়ার সময় তা পুরোপুরি উল্টে গেলো। স্পষ্টভাবে পরিস্কার করে বললেন ট্রাম্পকে রক্ষার জন্য কোনো কথা আর বলবেন না তিনি।
কোয়েন বলেন, “ট্রাম্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে সকলের প্রতিদিনের দায়িত্ব হচ্ছে তাঁকে রক্ষা করা। আমরা সবাই জানি আমরা আসছি যাচ্ছি এবং তার জন্যে মিথ্যাচার করে চলেছি। এটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশেও এটাই ঘটছে সর্বত্র”।
মাইকেল কোয়েন বললেন ডনাল্ড ট্রাম্প ব্যক্তিগত স্বার্থে কাজ করছেন; দেশের জন্যে নয়, “ডনাল্ড ট্রাম্প এমন একজন মানুষ যিনি নিজের নাম ও ব্র্যান্ড প্রচার করছেন; দেশকে নয়। এই দেশ ও জাতীর নেতৃত্ব দেয়ার কোনো ইচ্ছা তার নেই; তিনি যা করছেন তা সবই তার নিজের প্রচার প্রসার এবং সম্পদ ও ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে”।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অপরাধমুলক কর্মকান্ডের উল্লেখ করেছেন মাইকেল কোয়েন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবশ্য বরাবরই তা অস্বীকার করেছেন।
রাশিয়া বিষয়ক তদন্তে নিযুক্ত বিশেষ কৌশুলী রবার্ট মুলার সম্পর্কেও নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন ডনাল্ড ট্রাম্প, “কোনো ধরনের কোনো গন্ডগোল নেই; গোপন আঁতাত নেই; সবই ভাওতা। এটা একটি অসম্মান। আমাদের দেশের অপমান”।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্পর্কে কোয়েনের বক্তব্য ও মন্তব্য আমেরিকানদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে ১৯৭০ এর দশকে যখন তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের বিরুদ্ধে ওয়াটারগেট কেলেংকারী নিয়ে কথা শুরু হয়। আর প্রেসিডেন্ট নিক্সনের বিরুদ্ধে তখন অভিযোগ তোলেন তাঁরই সাবেক সহকারী জন ডীন।
“আমি বুঝতে পারছি এটি প্রায় অসম্ভব একটি কাজ; এটা অস্বস্তিকর ব্যাপার। আমি যা জানি তাই বলতে চাই এবং যা যা সত্য তার সব আমি কংগ্রেশনাল কমিটিকে জানাচ্ছি”।
ডীনের সেই স্বাক্ষ্যই পরবর্তীতে ওয়াটারগেট বিয়টিকে সামনে নিয়ে আসে। কংগ্রেস, প্রেসিডেন্ট নিক্সনের বিরুদ্ধে ইম্পিচমেন্ট প্রক্রিয়া শুরু করে যার ফলে তিনি পদত্যাগ করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রেসিডেন্ট নিক্সনই একমাত্র প্রেসিডেন্ট যিনি ইম্পিচমেন্টের মুখে পদত্যাগ করেন। সে সময়ে দেয়া বক্তব্যে ফুটে ওঠে তার পদত্যগের কষ্টের কথা: “আমি থেমে যাওয়ার লোক নই। মেয়াদ শেষ হবার আগে দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার বিষয়টি জটিল ও ন্যাক্কারজনক; অস্বস্তিকর। তবে প্রেসিডেন্ট হিসাবে আমি অবশ্যই আমার দেশের স্বার্থকে সবার আগে দেখি”।
এদিকে মাইকেল কোয়েনের স্বাক্ষ্যের পর পরই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে হাউজ জুডিশিয়ারি কমিটির তদন্ত শুরুর ঘোষণা দিয়েছে। সেই ঘোষনা যেনো একটি আকশ্মিক বিদ্যুতের চমক। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ বিষয়ক তদন্ত এবং বানিজ্য সংক্রান্ত বিষয়ে সোমবার প্রতিনিধি পরিষদের ডেমোক্রেটদের শুরু করা প্রয়াসে সহযোগীতা করার আশ্বাস দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প।
কেমন তদন্ত হবে সে বিষয়ে হাউজ জুডিশিয়ারি কমিটির চেয়ারম্যান জেরি নাডলার বলেন, “প্রমান যোগাড় করার জন্যে আমরা যথাসম্ভব চেষ্টা চালিয়ে যাবো। আমরা তদন্ত শুরু করছি”।
হাউজ জুডিশিয়ারি কমিটি তদন্তে ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যে থেকে এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাবেক ব্যক্তিগত আইনজীবি মাইকেল কোয়েন, দুই পুত্র এরিক ও ডন জুনিয়র এবং জামাই জারেড কুশনারসহ পরিবারের বিভিন্ন সদস্য ও বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কাছে নানা ধরণের কাগজপত্র ও দলিল পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। বিচারকার্যে বাধা প্রদান, দুর্নিতী ও ক্ষমতার অপব্যবহার সহ নানা অভিযোগ তদন্ত যুক্ত হচ্ছে এর সঙ্গে।
হাউজ জুডিশিয়ারি কমিটি একটি শক্তিশালি কমিটি যার হাতে রয়েছে ইম্পিচমেন্ট প্রক্রিয়ার ক্ষমতা। প্রেসিডেন্ট নিক্সন এবং প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়ায় বাধা প্রদান ও ক্ষমতার অপব্যবহার তদন্ত করেছিল হাউজ জুডিশিয়ারি কমিটি। তবে এবারের এই তদন্ত ইম্পিচমেন্টের প্রক্রিয়ার জন্যে নয়।
Center of American Progress এর বিশ্লেষক জেরেমি ভেনুকের মতে: “যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের একমাত্র ঘটনা ছিল ওয়াটারগেট কেলেংকারী যাতে প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল; প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে নিয়ে এইসব অভিযোগ সেই তুলনায় তেমন কিছু না হলেও যেসব শুনানী এটিকে ঘিরে চলছে- তা শেষ না হওয়া অব্দি কিছু বলা কঠিন”।
এখন মাইকেল কোয়েনের স্বাক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্পর্কে করা মন্তব্য এবং প্রেসিডেন্ট নিক্সন সম্পর্কে জন ডীনের বক্তব্যের মধ্যে বেশ কিছু সমান্তরাল বিষয় রয়েছে বলে মন্তব্য করলেন ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক জন হাডাক: “মূলত মাইকেল কোয়েন এবং জন ডীন সেই স্বাক্ষ্য দিয়েছেন যা তারা বিশ্বাস করেছেন যে প্রেসিডেন্ট আইন ভঙ্গ করছেন। কোয়েনের বক্তব্য ব্যাতিক্রমী এবং আমার বিশ্বাস বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন কংগ্রেস সদস্যরা তা নিয়ে আন্তরিকভাবে চিন্তা করবেন”।
ইম্পটিচমেন্টের আগেই নিক্সন পদত্যাগ করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইম্পিচমেন্ট তদন্তের মুখোমুখী হবেন কিনা তা এখনো পর্যন্ত সবার কাছে একটি খোলা প্রশ্ন; বললেন জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিশেষজ্ঞ সুজান লো ব্লক: “ইম্পিচমেন্টের সাধারন অভিযোগগুলো হচ্ছে রাজদ্রোহ ঘুষ বা অন্যান্য বড় ধরনের অপরাধ এবং বিধিবহির্ভূত কাজকর্ম। কোনো তদন্ত প্রক্রিয়ায় বাঁধা সৃষ্টি করাও এর মধ্যে পড়ে”।
নিক্সনের ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার ঘটনাটি একটি বড় উদাহরণ। অনেকেই বলেন সেই ঘটনা প্রমান করে যে নানা রকমের জটিলতা ও বাছ বিচার স্বত্তেও আমেরিকান গনতান্ত্রিক পদ্ধতি কাজ করে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তদন্তের নানা ক্ষেত্রে নানা ঘটনার বরাত দিয়ে বিশ্লেষক সুজান ব্লক বলেন; যুক্তরাষ্ট্রের গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এখনো তেমন করে কাজ করে কিনা তা দেখার সময় এসেছে আবারও।
“পদ্ধতির পরীক্ষা চলছে; এবং আমার মনে হয় সংবিধান প্রনেতারা এতে গর্ব বোধ করবেন। আমি বিশ্বাস করি তারা বলবেন আমরা তোমাদেরকে একটি কাঠামো দিয়ে রেখেছি যাতে কক্ষমতাকে নিরাপদ রাখার জন্যে চেক এ্যান্ড ব্যালেন্স রাখা হয়েছে। এখনো পর্যন্ত ভালোই চলছে”।
ওয়াটারগেট কেলেংকারীর ৪৫ বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের আরেক প্রেসিডেন্টের বিষয়ে কড়া তদন্ত চলছে। প্রশ্ন উঠেছে তাঁকে নিয়ে। তাই অনেকের মনে প্রশ্ন উঠেছে ওয়াটারগেটের অষ্পষ্ট একটি লক্ষণ কি দেখা যাচ্ছে?