অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

নাৎসি গণহত্যা অস্বীকারের নিন্দা জানানোর প্রস্তাবকে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ


ফাইল ছবি–১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি–মার্চে তোলা এই ছবিতে পোল্যান্ডের আউশউইৎস-বিরকেনাউ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের প্রবেশদ্বার ও বরফে ঢাকা ক্যাম্পমুখী রেলপথ
ফাইল ছবি–১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি–মার্চে তোলা এই ছবিতে পোল্যান্ডের আউশউইৎস-বিরকেনাউ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের প্রবেশদ্বার ও বরফে ঢাকা ক্যাম্পমুখী রেলপথ

নাৎসি হত্যাকাণ্ড অস্বীকারের নিন্দা জানানো সংক্রান্ত ইসরাইলের করা প্রস্তাবকে বৃহস্পতিবার (২০ জানুয়ারি) জাতিসংঘের সাধারণ সভায় স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ইহুদিবিদ্বেষ ও নাৎসি হত্যাকাণ্ড অস্বীকার কিংবা ইতিহাস বিকৃতি প্রতিহত করতে সকল দেশ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সংস্থাগুলোকে অনুরোধ করা হয়েছে।

১৯৩ সদস্যের এই বিশ্ব সংস্থা সর্বসম্মতিক্রমে ভোট ছাড়াই এই প্রস্তাবটির অনুমোদন দেয়। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি আবদুল্লাহ শহীদ পরিষদের সভার আগে গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া কিছু মানুষের সঙ্গে দেখা করেন। ইসরাইলের প্রধান শত্রু ইরান এই প্রস্তাব থেকে নিজেদের “বিচ্ছিন্ন” রাখে।

ইতিপূর্বে দৃঢ়ভাবে প্রস্তাবটি সমর্থন করা ইসরাইল ও জার্মানির রাষ্ট্রদূত ২০ জানুয়ারি প্রস্তাবটি গ্রহণ করার ওপর বিশেষভাবে জোর দেন। ২০ জানুয়ারি ওয়ানসি সম্মেলনের ৮০তম বার্ষিকী ছিল। এই সম্মেলনেই নাৎসি নেতারা তথাকথিত “ইহুদি প্রশ্নের চূড়ান্ত সমাধান” পরিকল্পনা করেছিলেন। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্লিনের ওয়ানসি লেকের তীরে একটি ভিলায় এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় নাৎসি ডেথ ক্যাম্প স্থাপিত হয় এবং ইহুদি জনগোষ্ঠীর এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৬০ লাখ মানুষকে সেখানে হত্যা করা হয়। এছাড়াও অন্য জাতি, সংখ্যালঘু এবং নির্ধারিত কিছু গোষ্ঠীর লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল বলে প্রস্তাবটিতে উল্লেখ করা হয়।

প্রস্তাবের সমর্থন করতে গিয়ে জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত গিলাদ এরদান বলেন “আমরা এখন এমন এক যুগে বাস করছি যেখানে কল্পকাহিনি সত্য হয়ে উঠছে আর ব্যাপক গণহত্যার (হলোকাস্ট) মতো সত্য অস্পষ্ট স্মৃতিতে পরিণত হচ্ছে।” তিনি আরও বলেন “ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অপরাধটি আড়াল করার জন্য ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কল্পকাহিনি এখন তৈরি হচ্ছে”।

ব্যাপক গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া একজনের পৌত্র এরদান বলেন, এই প্রস্তাবটি ৬০ লাখ নিহতদের স্মৃতি সংরক্ষণ করবে পাশাপাশি ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের ইতিহাস বিকৃতি এবং অস্বীকার রুখে দেওয়ার শপথ হিসেবে কাজ করবে।

তিনি বলেন, ফেসবুক, টুইটার ও ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো হলোকাস্ট বিষয়ক ইতিহাস বিকৃতি এবং মিথ্যার মহামারী ছড়িয়ে দিচ্ছে।

১১৪টি দেশের সমর্থিত প্রস্তাবটিতে ওইসব দেশের প্রশংসা করা হয়, যেসব দেশ নাৎসি ডেথ ক্যাম্প এবং হলোকাস্টের স্মৃতিবিজড়িত স্থান সংরক্ষণ করেছে এবং জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রকে ভবিষ্যতে গণহত্যা কর্মকান্ড প্রতিরোধ করতে পরবর্তী প্রজন্মকে গণহত্যা সম্পর্কে জানতে শিক্ষামূলক কার্যক্রম হাতে নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

প্রস্তাবটিতে জাতিসংঘ এবং এর সংস্থাগুলোকে গণহত্যা অস্বীকার মোকাবিলা করার লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন চালিয়ে যাওয়ার এবং গণহত্যা সম্পর্কে তথ্য প্রদানের জন্য সুশীল সমাজ এবং অন্যদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করা হয়।

ফাইল ছবি–জার্মানির বার্লিনে তুষারপাত চলাকালে মানুষ ইওরোপে হত্যাকাণ্ডের শিকার ইহুদিদের হলোকাস্ট মেমোরিয়াল স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন করছেন। ৯ ডিসেম্বর, ২০২১
ফাইল ছবি–জার্মানির বার্লিনে তুষারপাত চলাকালে মানুষ ইওরোপে হত্যাকাণ্ডের শিকার ইহুদিদের হলোকাস্ট মেমোরিয়াল স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন করছেন। ৯ ডিসেম্বর, ২০২১

বর্তমানে হলোকাস্ট সংক্রান্ত জাতিসংঘের একটি প্রচার কার্যক্রম রয়েছে এবং জাতিসংঘের শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেসকোর হলোকাস্ট শিক্ষা ও ইহুদিবিদ্বেষ প্রতিহতকরণ বিষয়ক কার্যক্রম রয়েছে।

ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়ার ল্যাপিড ও জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেছেন এবং “গণহত্যা অস্বীকার, ইতিহাস বিকৃতি ও সংশোধনবাদের নাটকীয় বৃদ্ধি” নিয়ে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক বিরোধকে হলোকাস্টের সঙ্গে তুলনা করা গভীরভাবে উদ্বেগজনক। এটি ইতিহাস বিকৃতির সমতুল্য এবং হলোকাস্ট ভুক্তভোগীদের প্রতি এটি অবিচার।

“হলোকাস্টের স্মৃতি মনে রাখা, এর থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং অনলাইন ও অফলাইন উভয় মাধ্যমে হলোকাস্ট সংশোধনবাদ, অস্বীকার এবং ইতিহাস বিকৃতির প্রচারণা বন্ধ করা আমাদের দায়িত্ব”, মন্ত্রী বলেন।

ইরান এক বিবৃতিতে ইসরাইলকে “বিশ্বের একমাত্র জাতিবিদ্বেষী দেশ” বলে অভিযুক্ত করে। ইরান বলে, ইসরাইলের মতাদর্শ হলো জাতিবিদ্বেষবাদ ও সম্প্রসারণবাদ, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত হওয়ার প্রধান কারণ ছিল। বিবৃতিতে আরও বলায় হয়, ইসরাইলের প্রতিবেশী দেশসহ আঞ্চলিক দেশগুলোর বিরুদ্ধে গত সাত দশকে সংঘটিত অপরাধ আড়াল করতে ইহুদি জনগণের দুর্ভোগের ইতিহাসকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে ইসরাইল।

নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের মতো সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব আইনগতভাবে বাধ্যবাধকতাপূর্ণ না হলেও বৈশ্বিক সিদ্ধান্তে এর প্রভাব রয়েছে।

২৭ জানুয়ারিকে ২০০৫ সালে সাধারণ পরিষদ থেকে হলোকাস্টে নিহতদের স্মরণে বার্ষিক আন্তর্জাতিক স্মরণ দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এদিন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনাবাহিনী আউশউইৎস কনসেনট্রেশন ক্যাম্প মুক্ত করেছিল। প্রস্তাবে এই দিবসটিকে ভবিষ্যতে গণহত্যা প্রতিরোধের মূল উপাদান হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

এখানে বলা হয় হলোকাস্ট অস্বীকার করা বলতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি ও তাদের সহযোগীদের হাতে ইহুদিদের নির্মূল করার লক্ষ্যে গ্যাস চেম্বার, ম্যাস শুটিং, অনাহার, এবং ইচ্ছাকৃত গণহত্যাসহ অন্য বর্বরতার ইতিহাস অস্বীকার করা বোঝায়। প্রস্তাবে আরও বলা হয়, হলোকাস্ট অস্বীকার করা বলতে নাৎসি সহযোগী এবং মিত্রদের গণহত্যায় ভূমিকা অস্বীকার করা, ইহুদীদের ওপর চালানো বর্বরতাকে ছোট করে দেখা, নিহতদের সংখ্যা কমিয়ে বলার চেষ্টা করা, ইহুদিদের নিজেদের গণহত্যার জন্য তাদের নিজেদের দায়ী করার চেষ্টা করা, হলোকাস্টকে একটি ইতিবাচক ঘটনা হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা, জাতি বা জাতিগত গোষ্ঠীর ওপর দোষ চাপিয়ে ডেথ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠার দায় এড়ানোর চেষ্টা করাকে বোঝায়।

XS
SM
MD
LG