অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন গঠনে প্রস্তাবিত আইন নিয়ে শুরুতেই বিতর্ক


বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন লোগো। (ফাইল ফটো- রয়টার্স)
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন লোগো। (ফাইল ফটো- রয়টার্স)

বাংলাদেশের সংবিধানে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে একটি আইন প্রণয়নের কথা বলা থাকলেও তা গত ৫০ বছরেও হয়নি। প্রতিবার জাতীয় নির্বাচনের সময় হলেই সেই আইন প্রণয়নের দাবি ওঠে।

টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগও এতদিন এই আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়নি। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদের প্রায় শেষ সময়ে এসে সেই আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অনেকটা দ্রুততার সঙ্গে আইনের খসড়া মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদনের পর রবিবার (২৩ জানুয়ারি) জাতীয় সংসদে তা বিল আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে।

বিলটি যাচাই–বাছাই করে ফেরত দিতে আইন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে মাত্র এক সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছে। বিলটি উপস্থাপনের পর দিনই জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছে ওই কমিটির।

আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি বতর্মান কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে। এরআগেই নতুন কমিশন গঠন করতে হবে। এ জন্য দ্রুততার সঙ্গে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ।

কিন্তু প্রস্তাবিত আইনটি নিয়ে শুরুতেই বিতর্ক দেখা দিয়েছে।রবিবার প্রস্তাবিত আইনের বিল সংসদে উপস্থাপনের সময়ই এর বিরোধিতা করেন বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য হারুনুর রশিদ। যদিও তার আপত্তি সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভোটে টেকেনি।

বিএনপি ছাড়া অন্য দলের নেতারাও মনে করছেন প্রস্তাবিত আইনে যে ইসি গঠন হবে তা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।কারণ আইনটি প্রণয়নে কারও মতামত নেওয়া হয়নি।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, তড়িঘড়ি করে আইনটি প্রণয়নে সরকারের অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে। এ ছাড়া আইনটিকে নির্বাচন কমিশন গঠন নয়, সার্চ কমিটি গঠনের আইন বলেও মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ।

যদিও সংসদে বিল উত্থাপনের সময় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সব সমালোচনার জবাব দিয়েছেন।তিনি পরিস্কার বলেছেন, জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হিসেবে এই আইন প্রণয়ন হচ্ছে।এই আইন নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য করবে।

নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ বিভিন্ন দলের সঙ্গে যে সংলাপ করেছেন তাতেও ইসি গঠনেরআইন প্রণয়নের পক্ষে মতামত দিয়েছে বেশিরভাগ দল।

এই সংলাপ শেষ হওয়ার পরপরই নতুন আইনের খসড়া অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা।

যদিও সংলাপ শুরুর আগে সরকারের তরফে বলা হচ্ছিল সময় স্বল্পতার কারণে এবারও আগের মতোই সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে।

প্রস্তাবিত আইনে সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে আগে গঠিত সব নির্বাচন কমিশনের বৈধতাও দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।

সংসদে উত্থাপিত বিলে বলা হয়েছে, “প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগদানের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ইতিপূর্বে গঠিত অনুসন্ধান কমিটির ও তৎকর্তৃক সম্পাদিত কার্যাবলি এবং উক্ত অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবংনির্বাচন কমিশনারের নিয়োগ বৈধ ছিল বলিয়া গণ্য হইবে এবং উক্ত বিষয়ে কোনও আদালতে কোনও প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।”

খসড়া আইনে সার্চ কমিটির কাজ সম্পর্কে বলা হয়েছে, এ কমিটি স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করবে।

আইনে বেঁধে দেওয়া যোগ্যতা, অযোগ্যতা অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও সুনাম বিবেচনা করে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে।

এ অনুসন্ধান কমিটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও কমিশনারদের প্রতি পদের জন্য দুজন করে ব্যক্তির নাম সুপারিশ করবে।

কমিটি গঠনের ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে দেবে বলে বিলে উল্লেখ করা হয়েছে।

সংসদ সচিবালয় সূত্র জানিয়েছে, সোমবার দুপুরে আইন, বিচার ও সংসদ মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডাকা হয়েছে। ওই বৈঠকে বিলটি নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানানো হয়েছে।

সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইনের খসড়া মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন এবং আইনটি পাস করার জন্য সংসদে উত্থাপনের পেছনে ভিন্ন কারণ দেখছে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।

রবিবার এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়, খসড়া আইনে নাগরিক সমাজের মতামতের প্রতিফলন ঘটেনি। আইনটিতে বেশ কিছু ত্রুটি রয়েছে যেগুলো সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

এই আইনের মাধ্যমে যে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ হবে তা অতীতের দুটি নির্বাচন কমিশনের মতো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন আয়োজন করবে।

ভার্চ্যুয়াল প্ল্যাটফর্মে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন প্রশ্ন রেখে বলেন, “এই আইনের ফলে সংবিধানের ৪৮ (৩) অনুচ্ছেদের ওপর কি কোনো প্রভাব ফেলবে? আমরা কমিশনে থাকাকালে যে খসড়াটি প্রস্তাব করেছিলাম সেখানে বলা ছিল, সুপারিশকৃত নামগুলো প্রথমে সংসদের বিশেষ কমিটিতে যাবে, সেখানে আলোচনা হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে”।

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, “বর্তমান সরকার কী ধরনের সার্চ কমিটি করবে সেটা আগেথেকেই অনুমেয়। তারা সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীলদের খুঁজে পাবেন। দুজন নাগরিককে রাষ্ট্রপতি মনোনয়ন দেবেন।রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতা হঠাৎ করে কীভাবে এল তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে”। তিনি আরও বলেন, “কোন ১০ জনের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হচ্ছে আমরা জানব না হঠাৎ দেখা যাবে, ৫ জনের নামে নির্বাচন কমিশন গঠন হবে”।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও আইনটির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রস্তাবিত আইনটির বিষয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।তবে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, “ইসি গঠন নিয়ে সরকার কী করে তাতে তার দলবিএনপির কোনো আগ্রহ নেই। যে আইন হচ্ছে সেটাতো আগের বিষয়টাই বৈধতা দেওয়া হচ্ছে।মোট কথা যে ‘লাউ সেই কদু’। এই আইন লোক দেখানো এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করা ছাড়া আর কিছুই নয়”।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “সংবিধানে যেভাবে বলা আছে সেভাবে আইন করে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করার জন্য আমরা আগে থেকেই বলে আসছি। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়েও আমরা এ দাবি জানিয়েছি। আগের মতো করেই যদি ইসি আইন করা হয় তাহলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন নাও হতে পারে।গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন না হলে সেটা দিয়ে অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না”।

নতুন আইনের বিষয়ে সরকারের মিত্র ওয়ার্কাস পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ইসি গঠনের বিষয়ে তার দলের নির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব ছিল প্রেসিডেন্টের কাছে। সে প্রস্তাবগুলো এই আইনে নেই। পার্লামেন্টে আলোচনার মধ্যে এই প্রস্তাবগুলো আবারও তুলে ধরা হবে বলে তিনি জানান।

বাম দলগুলোর অন্যতম দল বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “সরকার ও সরকারি দলের অনুগত আর একটি নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্যই এই বিল পেশ করা হয়েছে।এই বিলে বস্তুত সরকারের পছন্দের সার্চ কমিটিকে আইনি পোশাক পরানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।এই বিল নির্বাচন কমিশনসহ নির্বাচনকেন্দ্রীক গভীর সংকটের কোনো সমাধান করবে না, বরং সামগ্রিক সংকট আরও ঘনীভূত করবে”।

XS
SM
MD
LG