অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি এসে নতুন বছরের সংকল্প রক্ষায় ব্যর্থ হন বেশিরভাগ মানুষ 


ক্যালেন্ডার ও কলম। (ছবি- অ্যাডোবি স্টক)
ক্যালেন্ডার ও কলম। (ছবি- অ্যাডোবি স্টক)

একটি বছরের বিদায় ও শুরু কেবল শুধু আনন্দ–বেদনার নয়। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাবের মধ্যে বিদায় নেয় একটি বছর আর শুরু হয় নতুন আরেকটি বছরের। নতুন বছরের গুরুত্ব সবার কাছেই কম–বেশি থাকে এবং চিন্তাভাবনা ও পর্যালোচনার একটা উপলক্ষও বৈকি।

মানুষ অতীতের গ্লানি ও অক্ষমতা ঝেড়ে ফেলে নতুন বছরের কাঙ্খিত অর্জনের জন্য আবার নতুন করে সংকল্প (রেজুল্যুশন) করেন। পুরাতনকে ভুলে নতুন প্রত্যয় ও উদ্যমে এগিয়ে চলার সংকল্প করেন। এই সংকল্পকে সঙ্গী করেই মূলত নতুন বছরের কর্মকাণ্ড রচিত হয় নতুন মাত্রায়। অর্ধাৎ বিগত বছর আমরা কীভাবে কাটিয়েছি। এ বছর কীভাবে কাটাব এবং আমাদের লক্ষ্য কী কী?

নতুন বছর মানেই কিছু নতুন সংকল্প, প্রতিজ্ঞা বা শপথ। যেমন কেউ কেউ অঙ্গীকার করেন নিজেকে পাল্টে ফেলার। কেউ শপথ নেন ওজন কমানোর, কেউ স্বাস্থসম্মত খাবার খাওয়ার, কেউ ধুমপান ছাড়ার, কেউ ব্যায়াম করার। কেউ কেউ বছরের প্রথম দিন থেকেই সকালে হাঁটতে বের হয়ে যান। এমনি আরও অনেক ভালো কাজের প্রতিজ্ঞা করেন। যাকে বলা যায়, মনের দৃঢ় ইচ্ছা ও প্রত্যয় এবং স্থিরীকৃত কাজ বা মানসকর্ম। আর এগুলোই হলো নতুন বছরের রেজুল্যুশন বা সংকল্প।

বছরের শুরুতেই আমরা অমুক করব, তমুক করব ইত্যাদি কাজের ঘোষণা দিয়ে দিই। নিজেকে আমূল পাল্টে ফেলার জন্য কয়েক দিন কোমর বেঁধে নেমেও পড়ি। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই দেখা যায় সমস্ত সংকল্প হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। বলা হয় নতুন বছরের সংকল্প করাই হয় তা ভাঙ্গার জন্য।

এই যে বছরের শুরুতে সংকল্প করা হয় তার উৎপত্তি কীভাবে?

চার হাজার বছর আগে ব্যাবিলনে নববর্ষ পালনের কথা জানা যায়। যা “আকিতু উৎসব” নামে পরিচিত ছিল। মার্চের মাঝামাঝি নতুন ফসল বোনা দিয়ে শুরু হতো এ উৎসব। ১২ দিন ধরে পালন করা সে উৎসবে নির্বাচিত নতুন রাজার কাছে ব্যবিলনীয়রা আনুগত্যের শপথ নিতেন। এ ছাড়াও ঈশ্বরের কাছে শপথ নিতেন নতুন বছরে সব ধার দেনা শোধ করে দেওয়ার।

প্রাচীন রোমেও একই রকম একটা রীতির প্রচলন ছিল। রোমানরা বিশ্বাস করতেন দেবী জানুসের দুটি মাথা। একটি মাথা পেছন দিকে তাকিয়ে থাকে অর্থাৎ বিগত বছরের স্মৃতিচারণ, আর একটি মাথা সামনের দিকে অর্থাৎ নতুন বছরের প্রতি প্রত্যাশা। রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার দেবী জানুসের নামেই জানুয়ারি মাসের নামকরণ করেন। তো এই দেবী জানুসের কাছেই প্রাচীন রোমানরা শপথ নিত আগত বছরে আগের বছরের চেয়ে ভালো হয়ে থাকার।

মিসরীয়দের মধ্যেও ছিল নতুন বছরে নীলনদের দেবীর কাছে শপথ নেওয়ার রীতি। মধ্যযুগে ক্রিসমাস শেষে নাইটরা ময়ুরের গায়ে হাত রেখে “ময়ুর শপথ” গ্রহণ করত।

সে সময় এই শপথগুলো ছিল নৈতিক। ক্রমেই তা গুরুত্ব হারিয়েছে। ১৮১৩ সালে বস্টনের সংবাদপত্রে প্রথম “নিউ ইয়ার রেজুল্যুশন” (New year Resolution) বাগধারাটি দেখা যায়।

স্ট্যাটিসটার (Statista) গ্লোবাল কনজিউমার সার্ভে অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ৩৯ শতাংশ মানুষ ২০২২ সালের জন্য নতুন বছরের সংকল্প বা নিউ ইয়ার রেজুল্যুশন করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে কমন সংকল্প হলো স্বাস্থ্যকর জীবন। এদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক মানুষ বলেছে তারা এ বছর ব্যায়াম করতে চায়। স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া ও ওজন কমানোও তাদের পছন্দের তালিকায় আছে। স্ট্যাটিসটার সমীক্ষা অনুযায়ী ৪৮ শতাংশ মানুষ এ বছর ব্যায়াম করতে, ৪৪ শতাংশ স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে, ৩৪ শতাংশ পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে এবং ২১ শতাংশ মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুব কম সময় কাটাতে চায়। এ ছাড়াও আরও আছে মিতব্যায়ী হওয়া, কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপ কমানো, ধুমপান না করা ইত্যাদি।

যুক্তরাষ্ট্রের সাময়িকী ফোবর্স YouGovAmerica-এর সমীক্ষা অনুযায়ী জানাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের এক চতুর্থাংশ নাগরিককে ২০২২ সালের নতুন বছরের সংকল্প করতে বলা হয়। এর মধ্যে ২০ শতাংশ মানুষ মনে করেন যে, তারা সেটা সম্পন্ন করতে পারবেন। নববর্ষের জনপ্রিয় সংকল্পের মধ্যে আছে, আত্মোন্নয়নের বিষয়গুলো। যেমন, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, ওজন হ্রাস করা, সুখী হওয়া, ব্যায়াম করা, ধুমপান বন্ধ ও মদ্যপান হ্রাস করা ইত্যাদি। University of Scranton–এর গবেষণা অনুযায়ী মাত্র ৮ শতাংশ মানুষ তাদের নতুন বছরের রেজুল্যুশন অর্জন করতে পারবে।

কেন ভাঙ্গে সংকল্প?

২০২১ সালে সাইক নিউজ ডেইলি (psych news daily) তাদের একটি সমীক্ষায় দেখিয়েছে, যুক্তরাজ্যের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ এক মাসের মধ্যে তাদের নতুন বছরের সংকল্প ভঙ্গ করেন। তাদের গবেষণায় আরও দেখা যায়, বেশিরভাগ সংকল্পে ডায়েট বা ব্যায়াম জড়িত থাকে। মানুষ বছরের পর বছর একই ধরনের প্রতিজ্ঞা করে থাকে এবং তা এক সময় ছেড়ে দেন। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রায় ১৮০ জন অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যের নাগরিক ছিলেন। তারা দুই মাসের মধ্যে চারবার অনলাইন জরিপে অংশ নেন।

২০১৯ সালে ফিটনেস অ্যাপ স্ট্রাভা (Strava) একটি গবেষণা কার্যক্রম চালায় যাতে দেখা যায়, ১৯ জানুয়ারির মধ্যেই বেশিরভাগ মানুষ তাদের নতুন বছরের সংকল্প ভঙ্গ করেন। স্ট্রাভা অ্যাপে আপলোড করা ৯৮ দশমিক ৩ মিলিয়ন ব্যায়াম কার্যক্রমের তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষণার ফলাফল প্রদান করে। যারা টিকে থাকেন তাদের বেশির ভাগ ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি এসে ব্যর্থ হন। এদিকে N!CK’S–এর হয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ানপোল (OnePoll) একটি সমীক্ষা করে। এতে ২০০০ আমেরিকান অংশ নেন। সমীক্ষা অনুযায়ী দেখা যায়, ২০২২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই বেশির ভাগ মানুষের সংকল্প ভাঙ্গার সম্ভাবনা রয়েছে।

যদিও সাধারণভাবে আমরা মনে করি, একমাত্র ইচ্ছাশক্তির অভাবে আমরা সংকল্প ধরে রাখতে পারি না। তবে সবসময় তা ঠিক নয়। বেশির ভাগ সময়ই এই প্রতিজ্ঞাগুলো খুব একঘেঁয়ে, লক্ষ্যহীন ও পরিকল্পনাহীন হয়। যেমন, মানুষ ওজন কমাতে চায়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এর জন্য কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকে না। ফলে এক সপ্তাহ বা দুই সপ্তাহ পরেই সেই উদ্যোগ থিতিয়ে যায় বা সেখান থেকে সরে আসে। ওয়ানপোলের সমীক্ষায় আরও দেখা যায়, ৭৫ শতাংশ ব্যক্তি চলমান মহামারীতে নববর্ষের সংকল্প পালন করা নিয়ে কম উদ্বিগ্ন। বরং এরকম পরিস্থিতিতে কী করে সুখী থাকা যায় তাই নিয়েই তারা ভাবছেন।

কীভাবে সংকল্প ধরে রাখা যায়?

সংকল্প ধরে রাখা ও তাতে সফল হওয়ার জন্য কিছু নির্দিষ্ট পদক্ষেপ জরুরি। কাঙ্খিত লক্ষ্য পূরণ করতে চাইলে কিছু সুনির্দিষ্ট অভ্যাস গড়ে তোলা প্রয়োজন। যে অভ্যাস আপনার সংকল্পকে সফল করবে।

১. নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করুন। ধরুন আপনি ওজন কমাতে চান। তাহলে আপনাকে ঠিক করতে হবে আপনি ঠিক কত দিনে কত পাউন্ড ওজন কমাতে চাচ্ছেন। কিংবা আপনি আপনার ব্যবসা বাড়াতে চান। তাহলে আপনার মাসিক লক্ষ্য নির্ধারণ করুন। অর্থাৎ যখন লক্ষ্য ও স্পষ্ট দিক নির্দেশনা থাকে তখনই সফল হওয়া সম্ভব হয়।

২. ছোট ছোট লক্ষ্য স্থির করুন। নিজেকে সাপ্তাহিক বা মাসিক লক্ষ্য (টার্গেট) দিন। যেমন আপনি ঠিক করলেন, এক মাসে এক পাউন্ড ওজন কমাবেন। এভাবেই একটা বড় লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।

৩. কাজের দক্ষতা ও অভ্যাস গড়ে তুলুন। এটাই আপনাকে লক্ষ্যে পৌঁছতে সাহায্য করবে।

৪. নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করুন। সে অনুযায়ী এগিয়ে যান।

৫. নিজেকে অনুপ্রেরণা দিন। ধরুন সকাল ৬টায় হাঁটতে যাওয়া কিংবা নিকোটিন ছেড়ে দেওয়ার ফলে হওয়া মাথাব্যথা যখন আপনাকে লক্ষ্য থেকে সরিয়ে আনতে চাইবে, আপনাকে তখন নিজেকে মনে করিয়ে দিতে হবে কেন আপনি কাজটি করছেন।

৬. একটি নোট খাতা রাখুন। কী কী করলেন, ছোট ছোট কী কী সফলতা পেলেন তা লিখে রাখুন। এই কাজটি আপনাকে বড় লক্ষ্যে পৌঁছাতে অনুপ্রাণিত করবে।

৭. আপনি যখন আশাবাদী ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির হবেন তখন তা আপনার কাজকে আরও বেশি অনুপ্রাণিত করবে। ইতিবাচক কাজ মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার ক্ষেত্রেও অবদান রাখে।

৮. দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিন। আপনার সংকল্প যেমন আপনার আত্নোন্নয়নের বিষয় তেমনি তা আপনার আশেপাশের মানুষগুলোকেও প্রভাবিত করে। যেমন, কেউ তিন মাসে ১০ কেজি ওজন কমিয়ে ফেললে আমরা তাকে এবং তার নিয়মিত রুটিনকে অনুসরণ করতে শুরু করি। তাই আত্নোন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্বও নিন।

সময় কারও জন্য থেমে থাকে না। এই না সেদিনই এল ২০২১! চোখের পলকে একে একে ১২টি মাস পেরিয়ে আবার আমরা পা দিয়ে ফেলেছি ২০২২ সালে। এই নতুন বছরের একটি মাসও ইতিমধ্যে অতিক্রান্ত। তাই আগের বছরের মতো নিজেকে পাল্টে ফেলা টাইপ কথা বলে মুখে ফেনা না তুলে নতুন বছরে নতুনভাবে সংকল্প করে এগিয়ে যাই। ভালো কাজ করার দৃঢ় সংকল্প থাকা দরকার। সংকল্প না করলে জীবনে কারও উন্নতি হয় না।

মানুষেরই কিছু সংকল্প, আশা, প্রত্যাশা ও স্বপ্ন থাকে। এসব নিয়েই মানষকে এগোতে হয় এবং তা এক সময় লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়!

XS
SM
MD
LG