অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

একতরফা প্রেম


ভালোবাসার প্রতীক হয়ে ওঠা হার্ট বা হৃদয়ের প্রতীকী ছবি।
ভালোবাসার প্রতীক হয়ে ওঠা হার্ট বা হৃদয়ের প্রতীকী ছবি।

“ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে

আমার নামটি লিখো—তোমার

মনের মন্দিরে।...”

প্রেমের এ আকুতি চিরকালের। প্রেম মানে না কোনো বাধা। কিন্তু সখী যদি তার মনে ঠাঁই না দেয়, সাড়া না দেয় আকুতির, তবে কী জীবন বৃথা হয়ে যাবে? জগৎ সংসার ছেড়ে ছুড়ে বিবাগী হয়ে যাবেন? কখনোই না। ভুল দরজায় নক করেছেন সেটা বুঝে সরে আসতে হবে আর করতে হবে সঠিক দরজার সন্ধান।

একতরফা প্রেম বা প্রতিদানহীন প্রেম ঠিক এমনই এক অনুভূতি। এ ধরনের প্রেমে এক পক্ষের থাকে প্রেমের স্বীকৃতি পাওয়ার হাহাকার আর আরেক পক্ষ থাকে নির্বিকার। তার মনে থাকে না অপর পক্ষের জন্য কোন অনুরাগ। অর্থাৎ যে ধরনের প্রেমের সম্পর্কে দুজন মানুষের মনে একই রকম অনুভূতি কাজ করে না, দুজন পরস্পরের প্রতি অনুরক্ত নয় কিংবা দুজন মানুষের কোনো একজন আরেকজনের অনুরাগ সম্পর্কে জানেনই না কিংবা এড়িয়ে চলেন সে ধরনের সম্পর্ক বা ব্যক্তির মানসিক অবস্থাকে আমরা একতরফা প্রেম হিসেবে ধরে নিতে পারি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলোজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ফারাহ দীবার মতে, অনেক মানুষের মধ্যে প্রত্যাখ্যানকে গ্রহণ করবার ক্ষমতা থাকে না। আমাদের সমাজে শিশুর সমাজিকরণ প্রক্রিয়ার যে মাধ্যমসমূহ রয়েছে সেগুলোর কোথাও কোনো অনুরোধ করা বা অনুরোধ না রাখার বিষয়ে কোনো চর্চা করা হয় না। বিদ্যালয় বা পরিবার কোথাও এই শিক্ষা দেওয়া হয় না। সাধারণত ছেলেদের ক্ষেত্রে যেটি হয় যে, পরিবারে বা সমাজে ‘ছেলে-প্রাধান্য’ বিষয়টি এত বেশি চর্চিত যে, ছেলেরা তারা যা প্রত্যাশা করে তা পেয়ে যাবে, এমন একটি বিশ্বাসেই অভ্যস্থ হয়ে যায়। তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ছেলেরা প্রেম বা ভালোবাসার প্রত্যাখ্যান মেনে নেওয়ার মানসিকতা নিয়ে গড়ে ওঠে না। আবার কারও কারও ক্ষেত্রে এমন হয় যে, তারা অপর পক্ষকে তার মনের কথা জানাতে পারেন না। মনের কথা প্রকাশ করাতেই তাদের অনেক উদ্বেগ থাকে। অনেক সময় অবশ্য অনেকে তার ও তার মনে মনে ভালোবাসার মানুষটির মাঝে সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে বা সেগুলোকে বিবেচনা করে সে মনের কথা জানাতে অপারগ হয়। সে ক্ষেত্রে সে নিজেকে এই চিন্তা থেকে বের করতে পারে না, আবার যাকে পছন্দ করে তাকে তা বলতেও পারছে না। অথচ সারাক্ষণই একই চিন্তা করতে থাকে যা বারংবার ভাবনায় ফিরে আসে বা তার একটি অবসেশনে পরিণত হয়।”

ড. ফারাহ দীবা আরও বলেন, “এই যে প্রত্যাখ্যানকে গ্রহণ করা এবং তার মধ্য থেকে বের হয়ে এসে অন্য কোনো কাজে বা সম্পর্কে নিজেকে জড়ানো এটা সম্পূর্ণটাই একটা সামাজিক শিক্ষা। এই শিক্ষা যাদের অসম্পূর্ণ থাকে তাদের মধ্যেই এ ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। এই সামাজিক আচরণ ও শিক্ষার ক্ষেত্রে পরিবারের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। আমাদের পারিবারিক পরিমন্ডলে ছেলেমেয়ের সম্পর্ক, কিশোর বয়সের ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে তাদের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি কৌতূহল, আচরণ, বন্ধুত্ব, সম্পর্ক তৈরি, সম্পর্ক ধরে রাখা, সম্পর্ক কী করে সবসময় রোমাঞ্চকর রাখা যায়, কেমন করে সম্পর্কের বিশ্বস্ত্বতা বা সম্মান বজায় রাখতে হয়, সে জায়গাগুলো নিয়ে আলোচনা খুব কম হয়। সারা জীবনই আমাদের বেশির ভাগ মানুষের এ সম্পর্কিত শিক্ষার ঘাটতি থেকে যায়। যেহেতু এগুলো নিয়ে পরিবারে খোলাখুলি আলোচনার সুযোগ নেই, সেহেতু বিপরীত লিঙ্গের কাউকে ভালো লাগলেই যে তাকে পাওয়া যাবে বা সেই ব্যক্তিরও সমান ভালো লাগতে হবে, এসব ভূল ভাবনাটাই অনেকে ধারণ করে। আবার কারও কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হলে জীবন সেখানেই শেষ হয়ে গেল, সেই ভুলের ভেতরেও বসবাস করে। ছেলেরা এ ধরনের অবস্থায় কেউ কেউ খুব প্রতিহিংসাপ্রবণ বা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে এবং যে মেয়েটি তার প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য লেগে যায় বা নিজেকে ক্ষতি করতে থাকে। কিন্তু পরিবারে যদি এসব নিয়ে বাবা বা মা কারও সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করার পরিবেশ থাকে তাহলে একটি মানুষ তার শৈশব থেকে সঙ্গী কেন হয়, কীভাবে সঠিক সঙ্গী নির্বাচন করা যাবে, কারও প্রতি ভালো লাগাকে কীভাবে প্রকাশ করা যাবে, অন্যের অনীহাকে কীভাবে সহজভাবে ও শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করা যাবে বা অন্যের প্রস্তাবকে কীভাবে আঘাত না করে প্রত্যাখ্যান করতে হবে, এ সকল সামাজিক আচরণ ছোটবেলা থেকেই শেখা যায়। এ শিক্ষাগুলোর অভাবের কারণেই অনেক সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। প্রত্যাখ্যানকে গ্রহণ করে নেওয়ার মানসিক শক্তি তৈরি না হওয়ার ফলে প্রত্যাখাত হওয়ার পর অনেকে ভেঙে পড়ে, মানসিক অবসাদগ্রস্থ হয়, মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, কাজে মনোযোগ দেয় না, লেখাপড়া ছেড়ে দেয়, অনেকে আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়। ইদানিংকালে এ ধরনের আত্মহননের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।”

এই একতরফা প্রেম কিন্তু হতে পারে কোনো সেলিব্রেটি বা মিডিয়া জগতের তারকার প্রতিও। এ ধরনের আসক্তি সাধারণত দেখা যায় কিশোর বয়সী বিশেষ করে টিন এজারদের মধ্যে। বর্তমান ইন্টারনেট ও সামাজিক মাধ্যমের যুগে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটারে তারকাদের ফলোয়ার হয়ে তাদের নিয়মিত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকা খুব একটা কঠিন কিছু নয়। ফলে তারকাদের পোস্টে ক্রমাগত কমেন্ট করা, মেসেজ দেওয়া, ইত্যাদি একটা অবসেশনে পরিণত হয়। যদিও অপর পক্ষ থেকে কখনোই এসবের প্রত্যুত্তর সাধারণত পাওয়া যায় না।

ড. ফারাহ দীবা বলেন, “এ ধরনের অবসেশন হয় বাস্তবতার সঙ্গে নিজের চাহিদার সংগতি বা সামঞ্জস্য বোঝার জ্ঞানীয় দক্ষতা তৈরি করতে না পারার কারণে। টিন-এজ বয়সে মানসিক পরিপক্কতা পুরোপুরি তৈরি হয় না। তাই তারা এ ধরনের আবেগকে প্রাধান্য দেয়। এ ক্ষেত্রে ‍তাকে বোঝাতে হবে, একজন তারকার প্রতি তার যে আবেগ তা খুবই স্বাভাবিক। তবে তা তার মতো আরও অনেক ভক্তেরই একই রকম আবেগ রয়েছে। কিন্তু সেই তারকা তার অবস্থানে থেকে এসব আবেগে কখনো সাড়া দেবেন বা ওই ভক্তকে তার নিজের জীবনে জড়াবেন এরকমটা সাধারণত বাস্তবসম্মত নয়।”

প্রেমে উভয়পক্ষের সম্মতি না থাকলে, প্রেমের প্রতিদান পাওয়া না গেলে সেই সম্পর্ককে ধরে রাখার চেষ্টা করা মানে নিজের ক্ষতি করা, নিজের জীবনের অমূল্য সময় নষ্ট করা, মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া, সর্বোপরি নিজের পরিবারকে ক্ষতিগ্রস্ত করা। একতরফা প্রেম নিয়ে ক্রমাগত ভাবতে থাকলে নিজেকে সমাজের একজন উপযুক্ত সদস্য করে প্রস্তুত করার যেসব কাজ রয়েছে তা থেকে ক্রমশ সরে আসতে থাকে একজন ব্যক্তি। এভাবে একসময় তার আত্মবিশ্বাস নষ্ট হতে পারে, শারীরিক, মানসিক ভারসাম্যেরও ক্ষতি হতে পারে। তাই এ ধরনের সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে যা যা করতে পারা যায়, চলুন, সেগুলো জেনে নেওয়া যাক-

১. সবার আগে নিজেকে ভালোবাসুন। আপনার ভালো থাকা, আপনার আত্মসম্মানকে প্রাধান্য দিয়ে এ ধরনের আবেগ থেকে বের হয়ে আসার সংকল্প করুন।

২. পরিবারের সদস্য ও বন্ধুবান্ধবের সাহায্য নিন যাতে তারা আপনাকে সময় দেন এবং এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে আপনাকে বের করে আনতে পারেন।

৩. প্রয়োজনে সেই মানুষটার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রাখুন। তাতে শুধু নিজেকেই নয় অন্য মানুষটিও আপনার প্রতি সম্মান বোধ করবেন। যেমন, সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার সঙ্গে সম্পৃক্ততা কমিয়ে বা বন্ধ করে দিতে পারেন। কারণ দুরত্বই এ ধরনের সম্পর্ক থেকে বের হওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায়।

৪. নিজেকে সময় দিন। বেড়াতে বের হন। নিজের প্রিয় ও পছন্দের কাজগুলো করুন। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করুন। নিজেকে সময় দিলে অনেকসময় অনেক কিছুতে সফলতা অর্জন করা সহজ হয়। আর একজন সফল মানুষকে অনেককেই সঙ্গী হিসেবে চায়।

৫. ব্যায়াম ও মেডিটেশন মানসিক চাপ দূর করে, মনকে প্রফুল্ল রাখে।

৬. কোনো অবস্থাতেই আত্মবিশ্বাস হারাবেন না। প্রত্যাখ্যানকে সহজভাবে গ্রহণ করুন।

৭. হতাশাকে জীবনে চেপে বসতে দিবেন না। নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার কাজে মন দিন।

৮. এসব কিছুর পরেও বের হয়ে আসতে না পারলে অবশ্যই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

XS
SM
MD
LG