অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

মুক্তিযুদ্ধের সময় জনমত তৈরিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়


সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। (ছবি- দ্য ওয়াল)
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। (ছবি- দ্য ওয়াল)

চলে গেলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় অ্যাপোলো হাসপাতালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন গীতশ্রী। তার মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া নেমেছে সঙ্গীতজগতে।

৪ অক্টোবর ১৯৩১ সালে কলকাতার ঢাকুরিয়াতে জন্মেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। বাবা নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় চাকরি করতেন রেলের বড় পোস্টে। মা হেমপ্রভা দেবী গৃহবধূ। তাদের ছয় সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিলেন সন্ধ্যা। অবশ্য ছয় ভাইবোনের এক ভাই আর এক বোন খুব ছোট বয়সেই মারা যায়। বাকি চার ভাইবোন বরাবরই একে অন্যের ঘনিষ্ঠ ছিল। তবে সন্ধ্যায় সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন তার বড়দা রবীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। বড় ভাইয়ের উদ্যোগ আর ইচ্ছেতেই একসময় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিতে শুরু করেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।

খুব যে গানবাজনার পরিবারে জন্মেছিলেন সন্ধ্যা, তেমনটাও নয়। তবে তার মা হেমপ্রভা দেবী গান গাইতেন। কলকাতায় সে সময় রেডিও বা রেকর্ড প্লেয়ার কেনার সামর্থ্যও ছিল না সব মধ্যবিত্ত পরিবারের। বালিকা সন্ধ্যা ছেলেবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে বসে ঠাকুর দেবতার গান গাইতে ভালোবাসতেন। গানের প্রতি টান তার কিশোরীবেলা থেকেই। পাড়ার কোনও বাড়ি থেকে রেডিওতে গানের সুর ভেসে এলে ছুটে যেতেন সন্ধ্যা।মায়ের কাছেই খুব ছোটবেলাতেই সরগম শেখার হাতেখড়ি হয়ে গেছিল তার। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন এলেও তার ডাক পড়ত গান শোনানোর জন্য।

বোনের মধ্যে ভবিষ্যতের গায়িকা হওয়ার সম্ভাবনার আভাস পেয়েছিলেন দাদা রবীন্দ্রনাথ। দুবেণি দোলানো কিশোরী বোনকে তিনিই নিয়ে যান গানের শিক্ষক যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। সেই প্রথম শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের স্বাদ পেলেন সন্ধ্যা। অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্স বা অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সের কিশোর বিভাগে তখন থেকে অংশ নিতে শুরু করেছেন সন্ধ্যা। তার কণ্ঠের মাধুরী চমকে দিচ্ছে তখনকার স্বনামধন্য সুরকারদের, দৃষ্টি আকর্ষণ করছে প্রথিতযশা শিল্পীদের। এরই মধ্যে ১৯৪৪ সাল নাগাদ প্রথম বেসিক গানের রেকর্ড প্রকাশ পেল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের। তার বয়স তখন মাত্র ১৩ বছর। ওই বয়সেই গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে প্রকাশিত রেকর্ডে গেয়ে ফেললেন “তোমারো আকাশে ঝিলমিল করে চাঁদের আলো”।

১৯৪৬ সালে গীতশ্রী পরীক্ষায় প্রথম স্থান পেলেন সন্ধ্যা। পাশাপাশি চলছিল ক্লাসিকাল গানের চর্চাও। সেসময় উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খাঁ সাহেবের কাছে গান শেখার ইচ্ছে ছিল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের। বোনের সেই ইচ্ছে নিয়েই দাদা রবীন্দ্রনাথ ছুটে গেলেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের বাড়ি। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের মধ্যস্থতা কাজে লেগেছিল। তরুণী সন্ধ্যাকে গান শেখাতে রাজি হয়ে যান উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি। পণ্ডিতজীর ডিকসন লেনের বাড়িতেই তার কাছে নাড়া বাঁধেন কিশোরী সন্ধ্যা। তারপর দীর্ঘ দিন, মাস, বছর ধরে চলে উস্তাদ বড়ে গুলাম আলির খাঁ সাহেবের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিক্ষা ও অনুশীলন। দিনরাত কেটে যেত রাগচর্চায়, ঠুংরি, দাদরার সুরের সাধনায়। পাতিয়ালা ঘরানার সুরের ভাঁড়ার উজার করে দিয়েছিলেন উস্তাদজি তার এই অসাধারণ ছাত্রীর কাছে। উস্তাদ বড়ে গুলাম আলির প্রয়াণের পরেও গান থামেনি সন্ধ্যার। উস্তাদ বড়ে গুলাম আলির পুত্র উস্তাদ মুনাওয়ার আলি খাঁর কাছে তালিম চালিয়ে গেছেন তিনি।

১৯৪৮ সালে প্রথমবার ‘অঞ্জনগড়’ ছবির জন্য প্লেব্যাক গাইতে শোনা যায় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে। গান রেকর্ডিংয়ের আগে এক মাস ধরে সুরকার রাইচাঁদ বড়ালের তত্ত্বাবধানে অনুশীলন করতে হয়েছিল তাঁকে। সেটাই ছিল সেই সময়ের দস্তুর। ছবির সাথে যুক্ত সব শিল্পী, কলাকুশলীরা এসে হাজির হতেন রেকর্ডিংয়ের সময়। ‘সমাপিকা’ ছবির জন্য প্লেব্যাক করার সময় নায়িকা সুনন্দা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সন্দেহ ছিল এত অল্পবয়সী শিল্পীর গান তাঁর গলায় মানাবে কি না। শেষমেশ রেকর্ডিংয়ে হাজির থেকে নিশ্চিন্ত হয়ে গেছিলেন তিনি।

এরই মাঝে বেশ কিছু হিন্দি ছবির জন্য গান রেকর্ড করেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ১৯৫০ সালে 'পহেলা আদমি', ১৯৫১ সালে শচীন দেববর্মণের সুরে 'সাজা', সেই বছরেই অনিল বিশ্বাসের সুরে লতা মঙ্গেশকরের সাথে ডুয়েট “বোল পপিহে বোল”, ১৯৫৩ সালে মদনমোহনের সুরে ‘বাগী’, অনিল বিশ্বাসের সুরে ‘ফরেব’ তাকে এনে দেয় দেশজোড়া খ্যাতি। এমনই কোনও এক রেকর্ডিংয়ে তার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে অভিনেতা, পরিচালক রাজ কাপুর তাঁকে অনুরোধ করেন তাঁর ডাবল ভার্সন ছবি ‘জাগতে রাহে'তে গাওয়ার জন্য।

জাগতে রাহো ছবিতে সলিল চৌধুরীর সুরে তার গাওয়া “ম্যায়নে জো লি অঙ্গরায়ি” আজও অমলিন গানপাগল মানুষের স্মৃতিতে। রাইচাঁদ বড়াল থেকে শুরু করে রবিন চট্টোপাধ্যায়, অনুপম ঘটক, সলিল চৌধুরী, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, নচিকেতা ঘোষ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় - সমসাময়িক প্রায় সব দিকপাল সুরকারের সঙ্গেই সেসময় কাজ করেছেন সন্ধ্যা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের জুটি তো অমর হয়ে আছে উত্তম-সুচিত্রার লিপে একের পর এক কালজয়ীও গানে...।

প্লেব্যাক গানের বাইরে বেসিক গানের দুনিয়াতেও তখন বেকছত্র সম্রাজ্ঞী ছিলেন সন্ধ্যা। “হয়ত কিছুই নাহি পাবো”, “মধুর মধুর বংশী বাজে", “তারা ঝিলমিল স্বপ্ন মিছিল”, “গুন গুন মন ভ্রমরা”, “আয় বৃষ্টি ঝেপে, ধান দেবো মেপে”র মতো কালজয়ী সব গান। “মায়াবতি মেঘে এলো তন্দ্রা”, “ওগো সিঁদুর রাঙা মেঘ”, “ও বক বক বকুম বকুম পায়রা”, “শঙ্খ বাজিয়ে মাকে ঘরে এনেছি”, "কি মিষ্টি দেখো মিষ্টি”, “কে তুমি আমারে ডাকো”, “চম্পা চামেলি গোলাপেরই বাগে”- তাঁর কণ্ঠে একের পর এক গানে সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা গানের ভুবন।

১৯৬৫ সালে ‘সন্ধ্যাদীপের শিখা' ছবির জন্য বি এফ জে এ পুরস্কার পান সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ১৯৭১ সালে ‘জয় জয়ন্তী’ ছবিতে 'আমাদের ছুটি ছুটি' আর নিশিপদ্ম ছবিতে 'ওরে সকল সোনা মলিন হল' গান দুটির জন্য শ্রেষ্ঠ গায়িকা হিসেবে পেলেন জাতীয় পুরস্কার। ১৯৯৯ সালে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্টের জন্য ভারত নির্মাণ সম্মান পান। তারপর ২০১১ সালে বঙ্গবিভূষণ- একের পর এক সম্মাননা এসেছে তাঁর জীবনে। কিন্তু তাঁর চোখে স্বীকৃতির অনেক উপরে ছিল শিক্ষা আর চর্চা। আমৃত্যু সঙ্গীতকেই আঁকড়ে বেঁচেছেন সন্ধ্যা। তাই মৃত্যুর কিছুদিন আগে হেলায় ফিরিয়ে দিয়েছেন 'পদ্মশ্রী'র গৌরব। দুবার ভাবেননি।

সাধনার মধ্যে থাকলেও সামাজিক কর্তব্যকে অস্বীকার করেননি সন্ধ্যা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে সক্রিয়ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন জনজাগরনের কাজে। হাজারে হাজারে শরণার্থী তখন প্রাণ বাঁচাতে ছুটে আসছে পশ্চিমবঙ্গে। তাদের জন্য অর্থ সাহায্য তোলার কাজে হাত বাড়িয়ে দেন সন্ধ্যা। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক স্তরে এই ঘটনার দিকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাংলাদেশের শিল্পী, সুরকার সমর দাসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কলকাতায় 'স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র' গড়ে তুলেছিলেন সন্ধ্যা। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান যখন দেশে ফিরে যান, সেই সময় স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতির উদ্দেশ্যে তিনি গান, 'বঙ্গবন্ধু তুমি ফিরে এলে' গানটি। সারা জীবনে পৃথিবীর নানা প্রান্তে গেছেন তিনি সঙ্গীত পরিবেশন করতে। গেয়েছেন বাংলা হিন্দি সহ একাধিক ভাষার গান।

কিন্নরকণ্ঠী বলতে যা বোঝায় বাস্তবে ঠিক তাই ছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ২০২২ এর জানুয়ারির শেষ দিক থেকেই শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। ২৬ জানুয়ারি রাতে আচমকা কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। জ্বর বাড়লে চিকিৎসকদের পরামর্শে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় শিল্পিকে। ২৬ জানুয়ারি থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি- ২০ দিনের দীর্ঘ লড়াইয়ের পর নিভে গেল সন্ধ্যাদীপের শিখা।

XS
SM
MD
LG