অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

'বেগম' থেকে 'অনন্যা'


“বেগম” পত্রিকা । (ছবি- আফরিন শাহনাজ)
“বেগম” পত্রিকা । (ছবি- আফরিন শাহনাজ)

ভারত উপমহাদেশে নারী শিক্ষার সূচনা হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনামলে। অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শেষ দিকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে নারী শিক্ষার হার বাড়তে থাকে। এ সময়টা ছিল বাংলায় নবজাগরেণর যুগ। তখন থেকেই কেবল মাত্র সাহিত্যে নয়, সাময়িকপত্র সম্পাদনার ক্ষেত্রেও নারীরা এগিয়ে আসতে শুরু করেন। অন্তপুরে থাকা নারীরা সমাজ, সংসারের রক্তচক্ষু সামলে কলম ধরতে শুরু করেন।

সেই সময়টাতে সমাজ সংস্কারে এগিয়ে এসেছিলেন রাজা রামমোহন রায়, অক্ষয় কুমার দত্ত, শিবনাথ শাস্ত্রী, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বারকানাথ ঠাকুর, ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রামতনু লাহিড়ী, প্যারীচাঁদ মিত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ আরও অনেকেই। তাদের হাত ধরেই সতীদাহসহ অনেক কুসংস্কারের বিলুপ্তি ঘটে। সাহসী নারীরা এগিয়ে আসেন পত্রপত্রিকা ও লেখালেখির জগতে।

ভারতবর্ষের প্রথম সংবাদপত্র “বেঙ্গল গেজেট” বা ক্যালকাটা জেনারেল অ্যাডভার্টাইজার প্রকাশিত হয় ১৭৮০ সালে। এটি ছিল ইংরেজি সাপ্তাহিক। দুই পাতার এই সাপ্তাহিক বের করেছিলেন জেমস অগাস্টাস হিকি।

“দিগদর্শন”কে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সাময়িকী বা পত্রিকা ধরা হয়। এ সম্পর্কে বাংলাপিডিয়ায় বলা হয়েছে, “বাংলা সংবাদ-সাময়িকপত্র প্রকাশের প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন শ্রীরামপুরের ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিরা। ১৮১৮ সালে মিশনের পক্ষে জন ক্লার্ক মার্শম্যানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় প্রথম বাংলা সাময়িকপত্র দিগদর্শন। এর ২৬টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটিতে ইংরেজি প্রবন্ধও প্রকাশিত হতো। ১৮২১ সালের পরে এটি বন্ধ হয়ে যায়।”

অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক তারিক মনজুর “বাংলা পত্রিকার ২০০ বছর” শিরোনামে গবেষণাধর্মী এক নিবন্ধে (প্রথম আলো, ২৩ নভেম্বর ২০১৮) লিখেছেন: “যদিও এই প্রশ্ন তর্কাতীত নয়, তবু ‘সমাচার দর্পণ’কে প্রথম বাংলা পত্রিকা হিসেবে ধরা হয়। ২০০ বছর আগে ১৮১৮ সালের ২৩ মে এটি বের হয় শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশন থেকে। জশুয়া মার্শম্যান এবং উইলিয়াম ওয়ার্ড ছিলেন সাপ্তাহিকটির উদ্যোক্তা; আর জন ক্লার্ক মার্শম্যান ছিলেন সম্পাদক। এর দাম ছিল চার আনা। ১৮৩৬ সালে পত্রিকার সার্কুলেশন ছিল ৪০০, যা ওই সময়ে সর্বোচ্চ। ১৮৪১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়।…

১৮১৮ সালের এপ্রিলে ‘দিগদর্শন’ নামে বাংলা মাসিকপত্র বের করে শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন। এটি বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সাময়িকী। সম্পাদক জন ক্লার্ক মার্শম্যান। পত্রিকার ২৬টি বাংলা সংস্করণ এবং ১৬টি ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ইংরেজি সংস্করণের নামপত্রে লেখা হতো ‘ম্যাগাজিন ফর ইন্ডিয়ান ইয়ুথ’। সাময়িকীতে নিবন্ধের পাশাপাশি কিছু গল্পও ছাপা হতে থাকে। ১৮২১ সালের পরে এটি বন্ধ হয়ে যায়।

বাঙালি নিয়ন্ত্রিত প্রথম বাংলা সংবাদপত্র ‘বাঙ্গাল গেজেট’ (১৮১৮)। এর কোনো কপি পাওয়া যায়নি। ফলে এর সঠিক প্রকাশ-তারিখ জানা যায় না। ‘বাঙ্গাল গেজেট’এর প্রকাশক ছিলেন গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য, আর সম্পাদক ছিলেন হরচন্দ্র রায়। পত্রিকাটি চলেছিল বছরখানেক।”

তারিক মনজুরের ওই নিবন্ধ থেকে আরও জানা যায়, নারীদের জন্য প্রথম সাময়িকী “মাসিক পত্রিকা” (১৮৫৪) বের করেন প্যারীচাঁদ মিত্র ও রাধানাধ শিকদার।

এরও নয় বছর পরে অর্থাৎ ১৮৬৩ সালে প্রকাশিত হয় নারীদের জন্য আরেকটি পত্রিকা বামাবোধিনী।

নারী শিক্ষার আলো তখন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। এর পাশাপাশি শুরু হয় নারী জাগরণ।

বাংলাপিডিয়া থেকে জানা যায়, বাংলায় মেয়েদের স্কুল প্রথম চালু করেন মিশনারিরা। ১৮১৯ সালে ব্যাপ্টিস্ট মিশন “ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি” গঠন করে প্রথম বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। ১৮২৪ সাল নাগাদ ঢাকায় মেয়েদের একটি স্কুল চালু করা হয়। এটি অবশ্য ১৮২৬ সালে সেটি বন্ধ হয়ে যায়।

১৮২৮ সালের মধ্যে কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এ সময় শুরু হয় নারী শিক্ষা নিয়ে তর্ক বিতর্ক। ‘‘স্ত্রীলোকেরা বিদ্যাশিক্ষা করিলে বিধবা হয়” হিন্দু সমাজ থেকে এই আপত্তি ওঠে। তারপরও ক্রমশ প্রসারিত হয় নারী শিক্ষা। নারীর উন্নতি সাধনে, তাদের জন্য পত্রপত্রিকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন প্রগতিশীলরা। প্যারীচাঁদ মিত্র ও রাধানাথ শিকদার-সম্পাদিত “মাসিক পত্রিকা” (অগাস্ট ১৮৫৪), উমেশচন্দ্র দত্তের মাসিক “বামাবোধিনী পত্রিকা” (অগাস্ট ১৮৬৩) ও দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়-সম্পাদিত পাক্ষিক “অবলাবান্ধব” (২২ মে ১৮৬৯) বিশেষ উল্লেখযোগ্য নারী পত্রিকা। নারীদের দিয়ে পরিচালিত বা সম্পাদিত না হয়েও শিক্ষিত করে তুলতে এবং সমাজের কুপ্রথার বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তুলতে আরও কয়েকটি পত্রিকার আবির্ভাব ঘটেছিল। যেমন “হেমলতা” (পাক্ষিক, বাংলা ১২৮০, ইং ১৮৭৩–৭৪); “অবলা হিতৈষিণী” (বাংলা ১২৮১, ইং ১৮৭৪–৭৫); “বঙ্গবালা” (মাসিক বাংলা ১২৯২, ইং ১৮৮৫–৮৬); “অবলাবান্ধব” (পাক্ষিক ইং ১৮৬৯); “সাবিত্রী” (মাসিক বাংলা ১৩০৩, ইং ১৮৯৬–৯৭)প্রভৃতি। তবে এ সবই ছিল পুরুষ সম্পাদিত পত্রিকা। “অবলাবান্ধব” ছাড়া অন্য পত্রিকা মেয়েদের উন্নতি এবং শিক্ষা সমর্থন করলেও রক্ষণশীল মনোভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

“বঙ্গমহিলা” প্রথম নারী সম্পাদিত এবং “অনাথিনী” প্রথম নারী পরিচালিত সাময়িকপত্র। নারী সম্পাদিত বা পরিচালিত পত্রিকার মধ্যে ১৮ শ শতকেই ছিল “বঙ্গমহিলা”, “অনাথিনী”, “পরিচারিকা”, “হিন্দুললনা”, “বঙ্গবাসিনী”, “সোহাগিনী”, “বিরহিণী”, “গৃহিণী”, “মহিলা”, “ভারতমহিলা” ইত্যাদি পত্রিকা। পরে আরও অনেক নারী পত্রিকার আবির্ভাব হয় যার বেশির ভাগের স্থায়িত্ব খুব কম দিন ছিল। তবে অনেক দিন টিকে থাকার তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের “বেগম” (১৯৪৭–) ও অনন্যা (১৯৮৮–) এবং পশ্চিমবঙ্গের “সানন্দা” (১৯৮৬-) পত্রিকা।

১৯৪৭ সনে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান হওয়ার কিছুকাল আগে কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকা বেগম ঢাকায় স্থানান্তরের পর এ দেশে নারী সম্পাদিত ও নারীদের জন্য প্রকাশিত পত্রপত্রিকার ধারার সূচনা হয়। বেগমের সঙ্গে কলাকাতায় যুক্ত ছিলেন প্রখ্যাত কবি বেগম সুফিয়া কামাল। ঢাকায় এসে ১৪ জানুয়ারি ১৯৪৯ সনে কবি জাহানারা আরজুকে নিয়ে তিনি প্রকাশ করেন “সুলতানা”। এরপর পাবনা থেকে কুমারী জ্যোৎস্নারাণী দত্ত ও অনিমা গুপ্ত সম্পাদিত সাপ্তাহিক “মানসী”, মাহফুজা খাতুন সম্পাদিত “নওবাহার”, চৌধুরী জেবুন্নেছা বেগম সম্পাদিত “মাসিকপত্র”, লায়লা সামাদ সম্পাদিত “অনন্যা” ও “খাওয়াতীন”, বেগম মুশতারি শফি সম্পাদিত “বান্ধবী”সহ আরও অনেক নারীদের পত্রিকা প্রকাশিত হয়। কিন্তু এর অধিকাংশই ছিল ক্ষণস্থায়ী। ১৯৪৭—৭১ পর্বে ১৭টি নারী পত্রিকা ছিল বলে উল্লেখ পাওয়া যায় শামসুল হকের ‘বাঙলা সাময়িকপত্র ১৯৪৭—৭১’ শীর্ষক গ্রন্থে (১৯৭৩)।

এখন জানা যাক নারীদের জন্য বের হওয়া এবং নারী সম্পাদক সম্পাদিত কয়েকটি পত্রিকার কথা।

বঙ্গমহিলা (বৈশাখ ১২৭৭/এপ্রিল–মে ১৮৭০)

“বঙ্গমহিলা” নামে তিনটি সাময়িকপত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। প্রথম পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় ১২৭৭ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ (এপ্রিল–মে ১৮৭০)। এটি ছিল একটি পাক্ষিক এবং বাংলা ভাষায় প্রথম নারী সম্পাদিত পত্রিকা। যত দূর জানা যায়, তিনি ছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (ডব্লিউ সি ব্যানার্জীর) বোন মোক্ষদায়িনী মুখোপাধ্যায়।

দ্বিতীয় “বঙ্গমহিলা” ১২৮২ বঙ্গাব্দের বৈশাখে (এপ্রিল–মে ১৮৭৫ সাল) মুক্তারাম বাবু ষ্ট্রিটে চোরবাগান বালিকা বিদ্যালয়ের বোর্ড অফ প্রিন্সিপ্যাল্স প্যারীচরণ মাসিক পত্রিকা হিসেবে রকারের নেতৃত্বে প্রকাশিত হয়। চোরবাগান বালিকা বিদ্যালয়টি নারী শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যেই প্রতিষ্ঠিত। প্যারীচরণ সরকারই এটির প্রতিষ্ঠাতা। সম্পাদক হিসেবে প্যারীচরণের ভাইয়ের ছেলে ভুবনমোহন সরকারের নাম থাকত পত্রিকায়। নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে জনমত গঠন করা এবং নারীদের বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলাই ছিল পত্রিকাটির লক্ষ্য।

প্রথম “বঙ্গমহিলা” প্রকাশের পাঁচ বছর পরে দ্বিতীয়টি প্রকাশিত হয়। ১৮৭৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্যারীচরণের মৃত্যু হলে ভুবনমোহন সরকার পত্রিকা পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন। প্রধানত নারীদের সমস্যা ও সামাজিক অবস্থান নিয়ে পত্রিকাটি লেখা প্রকাশ করত। নরমপন্থী ও রক্ষণশীল দুই মতমতই ছাপা হতো। পত্রিকাটি মাত্র দুই বছর চালু ছিল, তবে স্বল্পস্থায়ী হলেও এতে নারীদের শিক্ষা প্রসার ও বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল। বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ প্রথা পত্রিকাটিতে সমালোচিত হয়েছে।

তৃতীয় “বঙ্গমহিলার” আত্মপ্রকাশ ঘটে বৈশাখ ১২৯০ বঙ্গাব্দে (ইং ১৮৮৩–৮৪), নগেন্দ্রনাথ ঘোষালের সম্পাদনায়। উদ্দেশ্য সেই একই; নারীদের শিক্ষা ও জ্ঞানের প্রসার। খুব বেশি নারীরা তখনো শিক্ষার সুযোগ পায়নি। স্বভাবতই এ ধরনের পত্রিকার পাঠক সংখ্যা ছিল খুবই কম। অর্থাভাবেই পত্রিকাটি দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়নি।

অনাথিনী (জুলাই ১৮৭৫)

প্রকৃতপক্ষে নারী সম্পাদিত প্রথম মাসিক পত্রিকা “অনাথিনী”। সম্পাদিকা থাকমনি দেবী। তার সম্পর্কেও বেশি কিছু জানা যায়নি। তিনি “সহোদর” সম্পাদক অনুকূলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা। পত্রিকাটি আজিমগঞ্জে বিশ্ববিনোদ যন্ত্রে মুদ্রিত। নারী শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের কাছে পত্রিকাটি আদরণীয় হয়েছিল। সাহিত্যিক ও সাংবাদিক ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মেয়ের জামাই সাব রেজিস্টার অনুকুলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কর্মস্থল ছিল ধুলিয়ান। সেখান থেকেই অনাথিনী পত্রিকা জুলাই ১৮৭৫ সালে প্রকাশিত হয়।

অন্তপুর (মাঘ ১৩০৫)

১৩০৫ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে (জানুয়ারি–ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯) প্রথম প্রকাশ হয় “অন্তপুর” নামের মাসিক নারী পত্রিকা। পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন বনলতা দেবী। ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের মতো ছোটবেলা থেকেই তিনি সাংস্কৃতিক পরিবেশে মানুষ হননি। কিন্তু তারপরও বনলতা দেবীর পত্রিকা প্রকাশনা ও সম্পাদনা ছিল নিঃসন্দেহে একটি অসামান্য প্রচেষ্টা।

১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দের ২০ ডিসেম্বর (৫ পৌষ ১২৮৭) নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে বনলতার জন্ম। বাবার উৎসাহেই বনলতা সৎ ও সমাজকল্যাণমূলক কাজ করতেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে বাবার প্রতিষ্ঠিত বরাহনগর বিধবাশ্রমে নারীদের নিয়ে “সুমতি সমিতি” নামে একটি ছোট্ট দল গঠন করেন। অনেক নারী এই সমিতিতে যোগ দিয়ে কল্যাণমূলক কাজে অংশ নিতেন। ১৭ বছর বয়সে বনলতা প্রকাশ করেন মাসিক পত্রিকা “অন্তপুর”। বিয়ের এক বছর পরেই বনলতা দেবী অসুস্থ হয়ে পড়েন। রুগ্ন শরীর নিয়েই তিনি বাইরের এবং সংসারের কাজ নিখুঁতভাবে করে গিয়েছেন। ১৯০০ সালের ১১ মার্চ (২৬ ফাল্গুন ১৩০৬) রাতে বনলতা মারা যান।

জয়শ্রী (১৯৩১)

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী (১৯২১ সাল) লীলাবতী নাগের(১৯০০—১৯৭০। তিনি লীলা নাগ নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। বিয়ের পর তার নাম হয় লীলা রায়) সম্পাদনায় ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে (এপ্রিল–মে ১৯৩১) “জয়শ্রী” প্রকাশিত হয়। জয়শ্রীর প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যাতে লেখা হয়: “নববর্ষে এই নূতন প্রচেষ্টা আরম্ভ করিলাম। বাংলার মহিলাদের মুখপত্র স্বরূপ কোন পত্রিকা এ পর্যন্ত ছিল না। এই অভাব দূর করিবার প্রয়াসে জয়শ্রী প্রকাশিত হইল।” লীলা নাগ ১৯৫০ সালে দাঙ্গা পীড়িত হয়ে দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। তার প্রকাশিত জয়শ্রী পত্রিকা কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। জয়শ্রী আগাগোড়া নারীদের হাতেই পরিচালিত হয়েছিল। লীলা নাগের পরে বিভিন্ন সময়ে যারা এই পত্রিকাটির পরিচালনা করেছেন তাদের মধ্যে শকুন্তলা দেবী, বীণাপাণি দেবী, উষারাণী রায় প্রমুখ বিদুষী নারী উল্লেখযোগ্য।

আন্নেসা (১৯২১)

এপ্রিল ১৯২১, বাংলা ১৩২৮ সালে বাঙালি মুসলিম নারী সম্পাদিত প্রথম নারী মাসিক পত্রিকা “আন্নেসা”র যাত্রা শুরু হয়। মাত্র এক বছর পত্রিকাটির মাত্র ১২টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। চট্টগ্রামের মোহাম্মদ আবদুর রশিদ সিদ্দিকীর সাধনা কার্যালয় থেকে আন্নেসা প্রকাশ করেছিলেন। ছাপা হয়েছিল চন্দ্রকুমার মজুমদার কর্তৃক সরস্বতী প্রেস থেকে। প্রতি সংখ্যা ১২ পৃষ্ঠা, মুদ্রণ সংখ্যা ৫০০ এবং দাম ছিল বার্ষিক আড়াই টাকা। বাংলা ও উর্দু ভাষায় বেশ দখলসম্পন্ন সফিয়া খাতুন আন্নেসা পত্রিকার সম্পাদিকা ছিলেন। তার স্বামী চট্টগ্রামের সাহিত্য উদ্যোগী ও সাংবাদিক মোহাম্মদ আবদুর রশিদ সিদ্দিকী মুসলিম বাংলার আদি ও প্রথম মাসিক নারী সম্পর্কিত সাময়িকপত্র আন্নেসা প্রকাশ করেছিলেন।

বেগম (১৯৪৭–)

“বেগম” পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই কলকাতার ১২ ওয়েলেসলি স্ট্রিট থেকে। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন প্রতিষ্ঠাতা কর্ণধার ছিলেন এবং কবি সুফিয়া কামাল প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। প্রথম বর্ষ ১২ সংখ্যা থেকে অর্থাৎ ২ অক্টোবর ১৯৪৭ সাল থেকে নুরজাহান বেগম (৪ জুন ১৯২৫—২৩ মে ২০১৬) সম্পাদিকা হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বেগম পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। সহ সম্পাদিকা ছিলেন লায়লা সামাদ। ১৯৫০ সালে কলকাতা থেকে পত্রিকাটির প্রকাশনা স্থানান্তরিত হয় ঢাকার ৫৫ লয়াল স্ট্রিটে এবং ঢাকা থেকে প্রকাশিত হতে থাকে। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হওয়া বেগম পত্রিকার বর্তমান সম্পাদক ফ্লোরা নাসরীন খান ও সহকারী সম্পাদক মুনিয়া খান। বেগমের প্রথম সংখ্যা ছাপা হয়েছিল ৫০০ কপি। দাম ছিল ৪ আনা। বেগমের প্রথম সংখ্যায় লিখেছিলেন সেলিনা পন্নি, রাবেয়া মাহমুদ, ওয়াহিদা আজিজ, সুফিয়া কামাল ও নুরজাহান বেগম।

খাওয়াতীন (১৯৫২)

লেখিকা ও শিক্ষাবিদ এবং শহীদ জননী হিসেবে খ্যাত জাহানারা ইমাম সম্পাদিত খাওয়াতীন পত্রিকা ১৯৫২ সালের মে মাসে (বৈশাখ, ১৩৫৯) ঢাকা শহরের ওয়াইজঘাট থেকে প্রকাশিত হয়। সাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন ছিলেন সহ সম্পাদিকা। তিনি তখন সিদ্ধেশ্বরী স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। ক্রাউন সাইজের চৌষট্টি পৃষ্ঠার পত্রিকাটির দাম ছিল বারো আনা। লেখক জাহানারা ইমাম তখন দৈনিক বাংলা পত্রিকায় লিখতেন। তার ইচ্ছা ছিল পত্রিকার প্রচ্ছদে একজন তরুণীর ছবি থাকবে। সেই সময়ে সেটা ছিল প্রায় অসম্ভব। শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের ছবি প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদে ছাপালেন। পত্রিকার জন্য নারীদের লেখা পাওয়া যেত অল্প। সুফিয়া কামাল, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, জাহানারা আরজু, যোবায়দা মীর্জা, লায়লা সামাদ প্রমুখ নিয়মিত লিখতেন। পরে পুরুষদের লেখা ছাপানোর স্বিদ্ধান্ত হয়। নারীবিষয়ক পুরুষদের অনেক লেখা ছাপানো হয়। বিজ্ঞাপনের অভাবে অর্থাৎ অর্থাভাবে পত্রিকাটি বেশিদিন চালু থাকেনি। প্রেসের মালিক ছাপার খরচ নিতেন না। তবু ৫টি সংখ্যার পরে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়।

বান্ধবী (১৯৬৪)

নারী আন্দোলন ও মানবাধিকার আন্দোলনের নেত্রী, সাহিত্যিক, মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখা শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফী ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রামে বান্ধবী সংঘ নামে একটি নারী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এ সংগঠন থেকে তিনি মাসিক বান্ধবী নামে নারীদের নিয়মিত পত্রিকা প্রকাশ করেন ১৯৬৪ সালে এবং চালু করেন নারী পরিচালিত ছাপাখানা “মেয়েদের প্রেস”। কম্পোজ করা থেকে শুরু করে মেশিন চালানো, বাঁধাই সব কাজই বান্ধবীর সদস্যরাই করতেন। মুশতারী শফির বাড়ির নিচের গ্যারেজের জায়গাতে ছাপাখানা বসানো হয়। ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত মুশতারী শফী সম্পাদিত বান্ধবী প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকাটির নিয়মিত বিভাগগুলো ছিল—প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, শিশুপালন, মহিয়সী নারীদের জীবনী, সংবাদ বিচিত্রা, রম্যরচনা, সেলাই, রান্না ইত্যাদি। মূলত চট্টগ্রামের লেখিকাদের লেখা দিয়েই বান্ধবী পূর্ণ থাকত। লিখেছেন—বেগম উমরতুল ফজল, নুরুন নাহার জহুর, বেলা মাহমুদা, কৃষ্ণা কানুনগো, ফাহমিদা আমিন, বেগম উম্মে কুলসুম, বেগম মুশতারী শফি প্রমুখ। চট্টগ্রামের বাইরের লেখক ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল, রাজিয়া মাহবুব, মকবুলা মনজুর প্রমুখ। পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক শাসনের দমননীতির ফলে সমাজ—সংস্কৃতি—রাজনীতির চর্চা বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। সেই পরিস্থিতিতে বান্ধবী নারী প্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে সচেষ্ট ছিল।

সানন্দা (১৯৮৬–)

নারীদের জন্য বাংলা পাক্ষিক পত্রিকা সানন্দা (ছবি- আফরিন শাহনাজ)
নারীদের জন্য বাংলা পাক্ষিক পত্রিকা সানন্দা (ছবি- আফরিন শাহনাজ)

নারীদের জন্য একটি বাংলা পাক্ষিক পত্রিকা। ১৯৮৬ সালের ৩১ জুলাই পত্রিকাটির প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যা প্রকাশ হয়। কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রতি মাসের ১৫ ও ৩০ তারিখে পত্রিকাটি প্রকাশ হয়। শুরুতে সানন্দার সম্পাদনা করেন বিখ্যাত অভিনেত্রী অপর্ণা সেন। ২০০৫ সাল থেকে মধুমিতা চট্টোপাধ্যায় পত্রিকাটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পত্রিকাটি খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। প্রথমে ৩০ হাজার কপি ছাপা হয়েছিল। কিন্তু এর দ্রুত পাঠকপ্রিয়তার কারণে পুনর্মুদ্রণ করা হয়। প্রথম সংখ্যাটি মোট ৭৫ হাজার কপি বিক্রি হয়। বর্তমানে পত্রিকার সম্পাদক পায়েল সেনগুপ্ত। এখনো পর্যন্ত পত্রিকাটি জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে।

অনন্যা (১৯৮৮–)

ঢাকা থেকে প্রকাশিত নারীদের জন্য পাক্ষিক পত্রিকা অনন্যা (ছবি- আফরিন শাহনাজ)
ঢাকা থেকে প্রকাশিত নারীদের জন্য পাক্ষিক পত্রিকা অনন্যা (ছবি- আফরিন শাহনাজ)

ঢাকা থেকে প্রকাশিত নারীদের জন্য পাক্ষিক পত্রিকা। সম্পাদক তাসমিমা হোসেন। সাবেক সংসদ সদস্য ও নারীনেত্রী। ১৯৮৮ সালের অক্টোবর মাসে এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে এখন পর্যন্ত। নারী অধিকার, নারী উন্নয়নে সচেতনতা তৈরি, সাহিত্য ও নানান বিষয়ে পত্রিকাটিতে সংবাদ, লেখা ছাপানো হয়। এ পত্রিকার পক্ষ থেকে বাংলাদেশে সামাজিকভাবে বিভিন্ন সফল নারীদের ১৯৯৩ সাল থেকে “অনন্যা শীর্ষ দশ পুরস্কার” শীর্ষক বার্ষিক পুরস্কার দেওয়া হয়। এখনো অনন্যা প্রকাশিত হচ্ছে।

XS
SM
MD
LG