অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

কোক স্টুডিও বাংলার প্রথম গান গেয়ে সাড়া ফেললেন অনিমেষ রায় 


অনিমেষ রায়। (সৌজন্যেঃ ফেসবুকঃ অনিমেষ রায়)
অনিমেষ রায়। (সৌজন্যেঃ ফেসবুকঃ অনিমেষ রায়)

কোক স্টুডিও বাংলার প্রথম গান গেয়েই আলোচনায় চলে এসেছেন অনিমেষ রায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের সার্চ ইঞ্জিনে এই নামটি এখন বাংলাদেশের 'পপুলার' ক্যাটাগরিতে অবস্থান করছে। অর্থাৎ অনিমেষকে খুঁজছে ফেসবুক দুনিয়ার মানুষ।

অনিমেষকে খুঁজবে এটাই তো স্বাভাবিক। কোক স্টুডিও বাংলার প্রথম গানেই বাজিমাত করেছেন হাজং সম্প্রদায়ের অনিমেষ। শুধু তাই নয় গানটির একটি অংশ হাজং ভাষার। অনিমেষের সঙ্গে কথা বলতেই কণ্ঠে উচ্ছ্বাস পাওয়া গেল। জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তির দিন উল্লেখ করে অনিমেষ বললেন, "আমি আসলে এখনো কল্পনা করতে পারছি না, কোক স্টুডিওর প্রথম গানটাই আমি গেয়েছি, তাও আমার ভাষায়- আমার সম্প্রদায়কে আমি সমস্ত বাংলাভাষাভাষী মানুষের কাছে তুলে ধরতে পেরেছি। এ অনুভূতি প্রকাশ করার মতো নয়।"

গানের গল্প

গানের কথাও লিখেছেন অনিমেষ। এই গানের সঙ্গে পান্থ কানাইয়ের কণ্ঠে 'দোল দোল দুলুনি' কয়েক লাইন ব্যবহার করা হয়েছে। যার প্রকৃত গায়ক আব্দুল আলিম। অনিমেষের কাছে জানতে চাওয়া হয় পুরো গানের কথার অর্থ। অনিমেষ বিষয়টি বেশ ভালোভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। তার ভাষায়, "আমাদের শেরপুর, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ এলাকায় হাজংরা বসবাস করেন। এই সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি উৎসব হয়। উৎসবটিতে মূলত গ্রামের যিনি মুরব্বী, আমরা পঞ্চায়েত প্রধান বলি, তিনি তুলনামূলক ধনী হন। তো ধান কাটার সময় , বা ফসল তোলার সময় তিনি সকলকে ডাকেন, বলেন তোমরা আমরা আমার ধান কেটে দাও মাড়িয়ে দাও, তোমাদেরকে টাকা দিতে পারবো না কিন্তু খাওয়াবো। তার কথায় সকলে রাজি হয়। এই পুরো প্রক্রিয়াটা একটি উৎসবের মতো। উৎসবের একটি অংশের নাম 'কর্ম সংগীত পর্যায়।' এই পর্যায়ে সকলেই মাতোয়ারা হয়ে কণ্ঠ মেলায়। যার ফলে আমার 'নাসেক নাসেক' শব্দ দুটি এসেছে। এটিই উৎসবকে মূলত প্রকাশ করে। এই উৎসব নিয়েই আমার নাসেক নাসেক গান।"

অনিমেষ জানান গানটি রচনা করেছেন ২০১৮ সালে। এরপর এখানে সেখানে গেয়েছেন। একটি বেসরকারি টেলিভিশনেও গেয়েছেন। নিজের ফেসবুকেও নানা ধরনের গান গেয়ে পোস্ট করেন। তবে কোক স্টুডিওর হিসেব অনিমেষকে পুরো আলাদা করে দিল। কেননা পুরো বাংলাদেশ ও সারা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষীদের চোখ এখন কোক স্টুডিওর ওপর।

যেভাবে কোক স্টুডিওতে অনিমেষ

অনিমেষ জানালেন খুব বেশিদিন আগের ঘটনা নয়,খুব অল্প সময়ের মধ্যে কোক স্টুডিওর সঙ্গে যোগাযোগ হয়। ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে অনিমেষ বলেন, “৩ থেকে ৪ মাস আগের ঘটনা। বিজ্ঞাপনী সংস্থা গ্রে'র পক্ষ থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন জিহাদ ভাই। তিনি কোক স্টুডিওর পরিকল্পনার কথা জানালেন। এরপরে অর্ণব ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো। অর্ণব ভাই আ ফেসবুক পেজে আমার গান শুনেছেন। কিন্তু এই হাজং গানটি শোনেনি। আমি যে হাজং এটা জানালাম। অর্ণব ভাই (শায়ান চৌধুরী অর্ণব) বললেন- দারুণ। তারপরে এই হাজং ভাষার গান করার পরিকল্পনা হয়। অদিত ভাইয়া (অদিত রহমান) পুরো মিউজিক করলেন। তারপর তো গান প্রচার হলো, সবাই শুনছে, দেখছে।"

"বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি সেই সঙ্গে গান করি"

অনিমেষ একজন শিক্ষার্থী। পারিবারিকভাবে গানের ধাঁচ পেয়ে সেই স্রোতেই গাঁ ভাসিয়ে দিয়েছেন। এখনও সে স্রোতেই রয়েছেন। জন্ম ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়া উপজেলার বগাঝড়া গ্রামে। পরিবার থেকে পেয়েছেন যে সুর, সেই সুরের চর্চার পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। এখন ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিষয়ে মাস্টার্স করছেন। বাবা অরবিন্দ রায় পল্লী চিকিৎসক ছিলেন মা কল্যাণী রায় এখনও পরিবার সামলাচ্ছেন। পরিবারে তিন ভাই রয়েছেন। রয়েছেন বোন, বিয়ে হয়ে গেছেন। সব ভাইদের সহযোগিতায় পরিবার চলছে।

পরিবার সম্পর্কে বলতে গিয়ে অনিমেষ বলেন, "আসলে আমার পরিবার আমাকে একজন গানের মানুষ বানিয়েছে। আমার বাবা-মা, আমার চাচা, ভাইয়েরা আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন বলে আমি এখনো সংগীতের চর্চা করে যাচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি সেই সঙ্গে গান করি। এভাবে কিছু উপার্জনও করি। পরিবারের সমর্থন সবসময়ই ছিল।“

কোক স্টুডিওতে গাওয়া একটা বড় মাইলফলক উল্লেখ করে অনিমেষ বলেন, "আমার জীবনে এটা বড় একটি মাইল ফলক হয়ে থাকবে। বড় মানুষেরা যে কতটা বিনয়ী হয় তা আমি কোক স্টুডিওতে গিয়ে নতুন করে শিখেছি। অর্ণব ভাই, অদিত ভাইসহ সকলেই এতো বিনয়ী এটা আমি শিখেছি, এটা আমার বড় শিক্ষা।"

নাসেক নাসেক গানের কল্যাণে অনিমেষ এখন দেশীয় সংগীত ইন্ডাস্ট্রিতে আলোচিত ব্যক্তি। অনেকেই ফোন করে জানাচ্ছেন তাদের অভিব্যক্তি। এদের মধ্যে যেমন গায়ক, সুরকার, গীতিকার রয়েছেন তেমনি রয়েছেন দেশ বরেণ্য কয়েকজন। তবে অনিমেষের প্রাপ্তি অন্যখানে। বললেন, “আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আমার গানের, গায়কীর, সব মিলিয়ে এই গানের প্রশংসা করেছেন, আমাকে জানিয়েছেন সেসব কথা। এটাই আমার পরম পাওয়া। এছাড়া পরিবারের কথা তো আলাদা করে বলার নেই।"

অনিমেষকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল

কোক স্টুডিওতে গানটি প্রচারের পর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অনিমেষকে নিয়ে মিছিল হয়েছে। গানের সংগীত আয়োজক অদিত রহমান বলছিলেন, "আমি কাল যখন অনিমেষকে ফোন দিচ্ছিলাম। তখন মিছিলের স্লোগান শুনছিলাম। বলতে গেলে একটু অবাকই হয়েছিলাম। কেননা কারণ বুঝে উঠতে পারছিলাম না। পরে অনিমেষই স্বীকার করলো তাকে নিয়েই মিছিল।"

কোক স্টুডিওর এই গানের কিউরেটোর ও প্রযোজক ছিলেন শায়ান চৌধুরী অর্ণব। গানের সংগীত আয়োজক ছিলেন অদিত। এই গানের বিষয়ে অদিত বলেন, "এই গানটি ঠিক আমার সন্তানের মতো হয়ে উঠেছিল। সংগীত আয়োজন হলো, ভয়েস দেওয়া হলো। ফাইনালি যখন এটা আমাদের হাতে এলো, তখন আমরা আনন্দ পেয়েছি। কিন্তু এখন মানুষের এতো এতো সাড়া পাচ্ছি, এতো এতো ফোন কল, মেসেজ- মনে হচ্ছে ভালো একটা কাজ হয়েছে। ভাষার মাসে, আমাদের দেশের আরেকটি সম্প্রদায়ের ভাষাকে আমরা যথার্থ সম্মান জানাতে পেরেছি।"

XS
SM
MD
LG