অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

প্রত্যক্ষদর্শীর গানে ও কবিতায় ৭ই মার্চ


ইউসুফ মিয়া, একাত্তরের সাতই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনেছিলেন।
ইউসুফ মিয়া, একাত্তরের সাতই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনেছিলেন।

একাত্তরের সাতই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে নতুন নাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনেছিলেন ইউসুফ মিয়া।

এরও আগে সত্তরের নির্বাচনের সময়ে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিয়েছেন ইউসুফ মিয়া। এই নির্বাচনী প্রচারনায় গিয়েই তিনি নতুন এক বিষয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। নির্বাচনী প্রচারে তখন নানা ধরনের গান গাওয়া হতো। প্রার্থীদের পক্ষে এভাবে তিনিও গান গাইতে শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি রচনা করেন অনেক কবিতা ও গান। বাংলাদেশের জন্মলগ্নের উত্তাল সময়ে তরুণ ইউসুফ মিয়া একাত্তরের সাত মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরবর্তীতে রচনা করেন বেশকিছু গান ও কবিতা।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি সিরিজ বই প্রকাশ করে। তার মধ্যে একটি বই হচ্ছে—“সাধক কবিদের রচনায় বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি”। বইটি লিখেছেন ফোকলোর গবেষক সাইমন জাকারিয়া।

তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন সাধক কবি ইউসুফ মিয়া। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি গান ও কবিতা রচনা করেছেন। এইসব বাংলাদেশের ইতিহাস চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হবে। সুফিসংগীতের ধারায় তিনি সংগীত রচনার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বেশ কিছু গান লিখেছেন। তার চিত্তের গভীরের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের আবেগ এমনভাবে সঞ্চারিত হয়েছিল, যা থেকে তিনি অদ্যাবধি বঙ্গবন্ধুকে ধ্যানে ও জ্ঞানে উজ্জ্বল দেখতে পান।”

১৯৭১ সালের মার্চে ঢাকার মলিবাগে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন ইউসুফ মিয়া। তখন তার বয়স ১৫। তিনি যখন বেশ ছোট তখন তার বাবা মারা গেছেন। বাবা মারা যাওয়ার পরে শরীয়তপুরের জাজিরা থেকে মায়ের সঙ্গে ঢাকায় এসে মালিবাগে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন তিনি। বাবার স্মৃতি খুব একটা মনে নেই ইউসুফ মিয়ার।

ঢাকায় আসার পর সংসারের খরচ মেটাতে এক সময় পান, বিড়ি, সিগারেট বিক্রি শুরু করেন ইউসুফ মিয়া। এতে সংসারে বাড়তি আয় হতে থাকে। ১৯৭০–৭১ সালে তিনি মালিবাগ, শান্তিনগর থেকে কখনো কখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় চলে যেতেন তার পান–বিড়ি–সিগারেটের ছোট্ট বাক্স হাতে। যেখানে মানুষের লোকসমাগম বেশি হতো, বাড়তি বিক্রির আশায় সেখানেই ছুটে যেতেন। এভাবেই ঢাকার রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ তার ঘোরা হয়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় ৭ মার্চেও তিনি হাজির হয়েছিলেন তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে।

৭ মার্চের বিকেলে ইউসুফ মিয়া দেখেছিলেন রেসকোর্স ময়দান লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে। মানুষ দাঁড়াবার জায়গা না পেয়ে উদ্যানের গাছে চড়েছে। বঙ্গবন্ধুকে একনজর দেখার জন্য, তার বক্তব্য শোনার জন্য মানুষ দীর্ঘ সময়ে অপেক্ষা করেছে। এই ঘটনা পরবর্তীতে ইউসুফ মিয়া তার গানে গানে লিখেছেন—“স্বাধীনতার চেতনা শক্তি বঙ্গবন্ধুর গড়া/বঙ্গবন্ধুর ডাকে মানুষ দিয়েছিল সাড়া/রমনা মাঠে মিটিং ডাকে শেখ মুজিবর/মাঠেতে ধরে না মানুষ গাছের উপর/বাঙালিরা মানবে না আর পাঞ্জাবি শাসন/বজ্রকণ্ঠে গর্জে উঠে মুজিবের ভাষণ/ইয়াহিয়া ভুট্টো টিক্কা পাইল শিক্ষা/টুকরা হইল পাকিস্তান”।

ভয়েস অফ আমেরিকাকে ইউসুফ মিয়া বলেন, “বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে মনে অইছে পাকিস্তান আর এলগে [এক সঙ্গে] থাকবে না। পরে নয় মাসের যুদ্ধের পরে দেশ স্বাধীন অইলো। অইলো বাংলাদেশ।”

সাতই মার্চের ভাষণের পরে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের মধ্যেও একধরনের শক্তি জেগেছিল বলছেন ইউসুফ মিয়া। তিনি বলেন, “ওই ভাষণ শোনার পর শরীরের পশম খাড়ায়া গেছে সবার। সব মানুষ স্বাধীনতার জন্য অপেক্ষা করছে। যুদ্ধ শেষে আমরা দেশ পাইলাম।”

একাত্তরের পঁচিশে মার্চের কালরাতে গণহত্যা চালানো হয়েছিল। সেই স্মৃতি ধরা পরে তার গানে—“পঁচিশে মার্চ কালো রাত্রি ভালো নাহি যায়/মায়ের সামনে ছেলে হত্যা কানছে ছেলে মায়/রাস্তা ঘাটে মরল মানুষ গুলির আঘাত খাইয়া/মায়ের সামনে ছেলে মরে মাইয়া নেয় ছিনাইয়া”।

পঁচিশে মার্চ মধ্যরাতে ঢাকায় হামলা শুরু করার পরে আটক করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন তিনি। সাধক কবি ইউসুফ তার গানে এই বিষয়টি তুলে ধরেছেন এভাবে—“আমার মুজিব বন্দী হলো/কান্দে রে বাঙালি/পাকিস্তানের কারাগারে/সামনে ধরে গুলি/বরফচাপা দিয়েছিল/বঙ্গবন্ধুর বুকে/মরণ ভয়ে কাঁদে না মুজিব/কাঁদে বাংলার দুখে/‘আমার মরা লাশ পাঠাইয়া দিও/আমার বাংলাদেশে/ বাংলাদেশে থাকব আমি/দেখবে বাংলা জনগণ’/সবার জানা মুক্তিসেনা করল দেশ/উদ্ধার তার সাথে মরল পুলিশ-বিডিআর/ রক্ত দিছি আরো দিব/দিব না আর দেশ/নয় মাসে জয় হইল বাংলা/ইউসুফের রচনা গান।”

এভাবে গানে গানে বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণসহ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি তুলে ধরেছেন সাধক কবি ইউসুফ মিয়া। ভয়েস অফ আমেরিকার সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, “এখন পরিবার স্বজন নিয়ে ঢাকার সেই মালিবাগেই থাকি। প্রতি বছর মার্চ মাসে রেসকোর্সের ভাষণের কথা মনে পড়ে। আমার সৌভাগ্য আমি ইতিহাস বানানো এই ভাষণ নিজে হাজির হয়ে শুনতে পেরেছিলাম।”

তথ্যসূত্র: সাধক কবিদের রচনায় বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি, সাইমন জাকারিয়া, বাংলা একাডেমি।

XS
SM
MD
LG