অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

প্রকাশনা শিল্প বদলে দিচ্ছেন বাংলাদেশের নারীরা


রুম্মান তার্শফিক
রুম্মান তার্শফিক

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় শুরু হয়েছে অমর একুশে বইমেলা ২০২২। প্রকাশক, লেখক ও বইপ্রেমীদের কলতানে এখন মুখরিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ। এবারের বইমেলায় অংশগ্রহণ করেছে চার শতাধিক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে প্রায় পঞ্চাশটির মতো প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার নারী প্রকাশক। প্রকাশনার মতো সৃজনশীল ও সম্ভাবনাময় পেশায় উদ্যোক্তা হিসেবে নারীদের এগিয়ে আসা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। গত কয়েক বছর আগেও প্রকাশনা শিল্পে নারীদের উপস্থিতি ছিলো একেবারেই হাতে গোনা। এখন সে চিত্র পাল্টাতে শুরু করেছে। প্রকাশনা সংস্থার হাল ধরেছেন অনেক নারী। সবাই মূলত বইয়ের প্রতি ভালোবাসা এবং ভালো বই প্রকাশের দায়বদ্ধতা থেকেই প্রকাশনায় এসেছেন। এ তালিকায় যেমন আছে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান তেমনি আছে একদম নবীন কিছু প্রতিষ্ঠান। ইউনিভার্সিটি প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স লিমিটেড (ইউপিএল), জাগৃতি, চিলড্রেন বুক কালেকশন, চয়ন প্রকাশন, ধ্রুপদী পাবলিকেশন্স, পেন্ডুলাম পাবলিশার্স, আনন্দম, চিত্রা প্রকাশনী, অধ্যায়ন প্রকাশন, বলাকা প্রকাশনী, যুক্ত-সহ আরো বেশ কিছু নারীদের দ্বারা পরিচালিত প্রকাশনা সংস্থা এবার বইমেলায় অংশগ্রহণ করেছে।

প্রকাশনা শিল্পের অভিজ্ঞতা, বর্তমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে কয়েকজন নারী প্রকাশকের সঙ্গে কথা হয়। ভয়েস অফ আমেরিকাকে তারা জানান সংগ্রাম ও স্বপ্নের কথা।

মাহরুখ মহিউদ্দিন

ইউনিভার্সিটি প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স লিমিটেডের (ইউপিএল) পরিচালক মাহরুখ মহিউদ্দিন। ইউপিএল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৫ সালে। বাবা মরহুম মহিউদ্দিন আহমেদের এ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মাহরুখ মহিউদ্দিন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হন ২০১৩ কিংবা ২০১৪ সাল থেকে। তারও আগ থেকেই অধ্যাপনা ও গবেষণা কাজের পাশাপাশি তিনি একটু একটু করে যুক্ত হচ্ছিলেন ইউপিএলের সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্রের টাফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই রাজনৈতিক চর্চা, সচেতন নাগরিকত্ব, ইতিহাস সচেতনতার বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হয়। স্নাতকোত্তরের পর দেশে এসে বন্ধুদের নিয়ে ২০০৬-২০০৭ সালের দিকে স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ শুরু করেন জাগরী ট্রাস্ট-এর সাথে। সে-সময়ে দেশের ছাত্রদের রাজনীতি ও রাষ্ট্রমুখী করা, নাগরিক সচেতনতাবোধ তৈরির লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নেন তাঁরা। একই সাথে অধ্যাপনা ও পাশাপাশি বাবার অসুস্থতার কারণে প্রকাশনার হালটাও ধরতে শুরু করেন মাহরুখ। ২০১১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধের উপর ৭১টি বইয়ের প্রদর্শনী করে ইউপিএল। সে সময়ে তাঁর উপলব্ধি হয় বাংলাদেশের অভ্যুদয়, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ইতিহাসের ঘটনাবলীর একটা চিত্র এই বইগুলো থেকে পাওয়া যাচ্ছে। তাই সে-সময় থেকেই তিনি মনে করেন এ ধরণের কাজকে অব্যাহত রাখতে হবে। এ ধরণের আরো বইয়ের ভান্ডার ‍গড়ে তুলতে হবে এবং এর মাধ্যমেই মাহরুখ যে নাগরিক সচেতনতাবোধ তরুনসমাজের মধ্যে তৈরি করতে চেয়েছিলেন তা সম্ভব হবে। এভাবেই প্রকাশনার জগতে পুরোপুরি চলে আসেন তিনি।

মাহরুখ মহিউদ্দিন
মাহরুখ মহিউদ্দিন

মাহরুখ মনে করেন, বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করবে এমন আরো গবেষণাধর্মী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থাকা প্রয়োজন এবং এর জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ থাকা দরকার। এ ধরণের প্রতিষ্ঠান আর না থাকার পেছনে অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাব রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। সরকারি অর্থায়ন ও পৃষ্ঠপোষকতায় অ্যাকাডেমিক গবেষণা ও প্রকাশনার উদ্যোগ নিতে হবে। বর্তমানে প্রকাশনা শিল্পে নারীদের এগিয়ে আসা এবং বিভিন্ন ধরণের প্রকাশনার সাথে যুক্ত হওয়া তাকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করছে। আরো নারীরা এগিয়ে আসার ব্যাপারে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

প্রকাশনায় নতুনদের জন্য মাহরুখ মহিউদ্দিনের পরামর্শ হলো, “প্রকাশনার ক্ষেত্রে একটি গ্রুপ নির্ধারণ করা, কাদের জন্য কাজ করছি, কি ধরণের কাজ করছি সেটা নির্দিষ্ট করে কাজে নামা খুব গুরুত্বপূর্ণ । আবার ব্যবসায় টিকে থাকাটাও খুব জরুরি। তাই ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য পরিকল্পনা করেই কাজ শুরু করতে হবে।”

ডা. রাজিয়া রহমান জলি

জাগৃতি প্রকাশনের স্বত্তাধিকারি ডা. রাজিয়ার রহমান জলি পেশাগত জীবনে একজন চিকিৎসক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টারে কর্মরত আছেন। প্রকাশনায় তার আসার গল্পটি একটু ভিন্ন রকমের। স্বামী ফয়সাল আরেফিন দীপনের প্রতিষ্ঠান ছিলো এই জাগৃতি প্রকাশন। ২০১৫ সালে উগ্রবাদীদের হাতে দীপন নিহত হওয়ার পর তাঁর ফেলে যাওয়া স্বপ্নের হাল ধরেন স্ত্রী ডা. রাজিয়া। চিকিৎসকের দায়িত্বের পাশাপাশি প্রকাশনা পরিচালনার দায়িত্বও কাঁধে তুলে নেন তিনি। সেই থেকে থামেনি পথচলা। ডা. রাজিয়ার ভাষায়, ‘জাগৃতি’ যেমন তাঁর ভালোবাসার জায়গা, তেমনি তাঁর প্রতিবাদের ভাষাও।

ডা. রাজিয়া রহমান জলি
ডা. রাজিয়া রহমান জলি

ডা. রাজিয়া মনে করেন প্রকাশনা শিল্পে কাজ করার জন্য যথেষ্ট ধৈর্য, সৃজনশীল মন, সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ থাকা প্রয়োজন। পুরুষের তুলনায় নারীদের এ ধরণের দক্ষতা বেশি থাকে তাই প্রকাশনার কাজে নারীরা এগিয়ে এলে ভালো করতে পারবেন। গত দুই বছরের তুলনায় এবারের বইমেলা যথেষ্ট প্রাণবন্ত মনে হচ্ছে বলে জানান। সাধারণত নারী লেখকরা নারী প্রকাশকদের কাছে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তাই জাগৃতি থেকে অনেক নারী লেখক নিয়মিত বই প্রকাশ করে থাকেন বলে ডা. রাজিয়া জানান।

নিশাত জাহান রানা

লেখিকা নিশাত জাহান রানার প্রতিষ্ঠান যুক্ত প্রকাশনী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে সাংবাদিক হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিলেন। সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বড় হওয়া ও লেখালেখির সাথে যুক্ত থাকায় শখের বশেই ২০০০ সালে প্রকাশনার কাজ শুরু করেন। এর চার-পাঁচ বছর পর থেকে পেশাগতভাবেই যুক্ত প্রকাশনী নিয়ে প্রকাশনা শুরু করেন। ২০০৮ সাল থেকে একুশের বইমেলায় অংশগ্রহণ করছে যুক্ত প্রকাশনী। এ পর্যন্ত তিন শতাধিক বই প্রকাশিত হয়েছে। যদিও নারী হিসেবে প্রকাশনার কাজে নিশাত জাহানকে কখনও বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি তবে তিনি মনে করেন, যে কোনো পেশার ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্যের ব্যাপারটি পরোক্ষভাবে হলেও থাকে। বাংলাদেশে প্রকাশনা শিল্পটি এখনও পেশাদারিত্বের জায়গায় পৌঁছায়নি বলে নিশাত জাহান মনে করেন। তিনি বলেন, বইয়ের পান্ডুলিপি লেখা থেকে শুরু করে বইটি ছাপানো পর্যন্ত এর বিভিন্ন কাজ রয়েছে। সম্পাদনা, পেজ মেকাপ, অলংকরণ, প্রচ্ছদ আঁকাসহ সকল কাজে নারীদের সম্পৃক্ততা এখনও অনেক কম। প্রকাশক হিসেবে তিনি মনে করেন একটা বড় প্রতিবন্ধকতা, বাংলাদেশে ভালো বই তৈরি হয় খুব কম, এবং তার বাজারও ভালো নয় অর্থাৎ ভালো বই বিক্রি হয় না। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা। বিদ্যালয়গুলো পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে পারছে না ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাঠ্যবইয়ের বাইরে বই পড়ার অভ্যাস কমে গিয়েছে। এ কারণেই ভালো লেখক ও গবেষক তৈরি হচ্ছে না। যার ফলে পান্ডুলিপি সম্পাদনা করতে প্রকাশকদের অনেক সময় হিমশিম খেতে হয়। ভালো সম্পাদকেরও অভাব রয়েছে। লেখক, সম্পাদক ও গবেষক তৈরির ক্ষেত্রে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। তাছাড়া বাংলা একাডেমি এবং “জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি” এ সকল সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিতে পারে।”

নিশাত জাহান রানা
নিশাত জাহান রানা

শরীফা বুলবুল

সাংবাদিক ও লেখক শরীফা বুলবুল বলাকা প্রকাশনের কর্ণধার। তিনি দৈনিক ভোরের কাগজ’এ সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত আছেন। বাবা মরহুম নুরুছ্ছফা চৌধুরীর স্বপ্নকে পুঁজি করে প্রকাশনা জগতে আসেন। শরীফার বাবা ১৯৭০ সালে চট্টগ্রামে বলাকা নামে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বাবার স্মৃতি ধরে রাখতে প্রথমে তিনি ১৯৯৪ সালে ‘মাসিক বলাকা’ নামে পত্রিকা প্রকাশ করেন। তারপর তিনি চট্টগ্রামেই ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন প্রকাশনী সংস্থা বলাকা। শরীফা বুলবুলের পথ চলা খুব মসৃণ ছিলো না। চট্টগ্রাম শহর থেকে একাকী পত্রিকার কাজ করেছেন, প্রকাশনা করেছেন। পত্রিকা ও প্রকাশনার কাজ করতে গিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অনেক জায়গায় তাঁকে হেয় হতে হয়েছে। তবে দৃঢ়তার সাথেই তিনি সব প্রতিকূলতা কাটিয়েছেন। একজনের হাতে প্রকাশনী দেখার দায়িত্ব ছেড়ে ২০০৬ সালে ঢাকায় কর্মজীবন শুরু করেন। তারপর সেই ব্যক্তির সঙ্গেই বলাকা’র মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব হয়। প্রভাবশালীদের সঙ্গে পেরে উঠেন না। প্রতিষ্ঠান বেদখল হয়ে যায় শরীফার হাত থেকে। ২০১৬ সালে ঢাকা থেকে তিনি আবার শুরু করেন প্রকাশনার কাজ, বলাকা প্রকাশন নামে। শরীফা বুলবুল অনেক স্বপ্ন দেখেন তাঁর প্রতিষ্ঠান নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মাথায় রেখেই তিনি বই প্রকাশের পরিকল্পনা করেন। তিনি চান প্রকাশনা শিল্পে আরো নারী এগিয়ে আসুন, এ শিল্পে নারীদের কাজ করার অনেক সুযোগ আছে বলে তিনি মনে করেন।

শরীফা বুলবুল
শরীফা বুলবুল

রুম্মান তার্শফিক

পেন্ডুলাম পাবলিশার্সের স্বত্তাধিকারী রুম্মান তার্শফিক একজন নবীন ও বয়সে তরুণ প্রকাশক । প্রকাশনার জগতে বিচরণ খুব বেশি দিনের নয়। রুম্মান বরাবর প্রকাশকই হতে চেয়েছেন। ২০০৪ সালে যখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়েন, সে-সময় বাবার সাথে বইমেলায় ঘুরে প্রকাশক হওয়ার বাসনাটাই মাথায় ঢুকে পড়ে। তাই ডেন্টাল কলেজে পড়াশোনা করেও দন্তচিকিৎসক না হয়ে ছোটবেলার লক্ষ্য অনুযায়ী প্রকাশনাতেই এসেছেন। ২০১৮ সালে শুরু করেন পেন্ডুলাম পাবলিশার্স। মাত্র ২১ বছর বয়সের একজন নারী প্রকাশক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করায় শুরুর দিকে কিছু অসহযোগিতা ও বাধার সম্মুখিন হয়েছেন। লেখকদের সহযোগিতা পেলেও ছাপাখানা ও বই বাঁধাইয়ের লোকজনের কাছে একেবারেই সহযোগিতা পাননি। তবে এখন অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। এখন সবার সাথে একটা সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। রুম্মানও মনে করেন প্রকাশনার প্রতিটি ধাপে নারীদের কাজ করার অনেক সুযোগ আছে। মেয়েরা যত এগিয়ে আসবে প্রকাশনায় পুরুষকেন্দ্রিকতা কমে যাবে বলে তিনি মনে করেন। গত বছরের চাইতে এবারের বইমেলা অনেক স্বতস্ফুর্ত বলে মনে করছেন তিনি।

রুম্মান তার্শফিক
রুম্মান তার্শফিক
XS
SM
MD
LG