অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

সরেজমিনেঃ ঢাকার বাজারে সয়াবিন তেল



হাতিরপুল বাজার/ছবি, এহসান মাহমুদ
হাতিরপুল বাজার/ছবি, এহসান মাহমুদ

বাংলাদেশে গত এক সপ্তাহ ধরে বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট দেখা দিয়েছে। হঠাৎ করেই দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে ভোজ্যতেল হিসেবে ব্যবহৃত এই তেল। দাম বাড়াতে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে বলেও অভিযোগ শোনা যাচ্ছে।

গত ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল। তখন বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে আট টাকা বাড়িয়ে ১৬৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বোতলজাত ৫ লিটার সয়াবিন তেলের দাম ৭৯৫ টাকা রাখা হয়েছিল। এর আগে ছিল ৭৬০ টাকা। কিন্তু এরই মধ্যে ইউক্রেন-রশিয়া যুদ্ধ শুরু হলে আবারও তেলের দাম বাড়াতে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরির অভিযোগ শোনা যায়। ক্রেতারা দোকানে গিয়েও সয়াবিন না পেয়ে খালি হাতে ফিরেছেন, এমন সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল গতকাল (বৃহস্পতিবার) সয়াবিন তেলের ওপর ২০ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। তাতে বলা হয়- সয়াবিন তেলের ক্ষেত্রে উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট মওকুফ করা হবে। আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে বলে জানানো হয়েছে।

সরকারের এই ভ্যাট প্রত্যাহারে সয়াবিন তেলের বাজারে কী প্রভাব পড়ছে তা সরেজমিনে দেখতে শুক্রবার সকালে বাসা থেকে বের হই রাজধানী ঢাকার কয়েকটি বাজারে। মিরপুর, কারওয়ানবাজার, বনানী, হাতিরপুল বাজার ঘুরে দেখা যায় এলাকা ভেদে ভিন্ন ভিন্ন দাম। আবার পাইকারি বাজার, ছোট বাজারের দোকানি, বিক্রয়কর্মী ও ক্রেতাদের সাথে আলাপে জানা যায় অনেকে ফায়দা লটার চেষ্টা করছেন। যে যেভাবে পারছেন অতিরিক্ত দামে তেল বিক্রি করছেন।

প্রথমে যাই মিরপুরের রূপনগর এলাকায়। বেশ কয়েকটি দোকান ঘুরে কোন খোলা সয়াবিন তেল দেখা গেল না। আরমান নামের এক ব্যবসায়ীর দোকানে দেখা গেল এক লিটার দুই লিটারের অল্প কয়েকটি সয়াবিন তেলের বোতল। পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে বললেন, “গতকাইল সরকার ভ্যাট বাতিলের ঘোষণা দিছে। এখন আশাকরি তেল পামু। কাস্টমার আসলে আর ফিরায়া দিতে অইবো না।”

এতোদিন তেল কেন পাওয়া যায়নি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ডিলারেরা তেল দেওয়া বন্ধ রেখেছিল। তাই তেল ছিল না।

রূপনগরের এক দোকানে গিয়ে দেখা যায় সারিসারি তেলের বোতল সাজানো। কাছে যেতেই দেখা গেল সরিষার তেল। সোহেল নামের এই দোকানি জানালেন, গত কয়েকদিনে তার দোকানে সরিষা তেলের বিক্রি বেড়েছে। প্রতি লিটার সরিষা তেল তিনি বিক্রি করছেন ২১০ টাকায়।

রূপনগর বাজারেই কথা হয় মাসুম বিল্লাহ (৪২) নামের একজনের সাথে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। জানালেন, সাধারণত মাসের প্রথম দিকে পুরো মাসের বাজার করেন তিনি। শুক্রবার সবজি, মাছ-মাংস কিনেন। তবে চলতি মাসের শুরুতে মাসের বাজার করেননি। জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় অল্প অল্প করে কেবল দরকারি জিনিস কিনছেন। জানালেন, প্রথমে সয়াবিন তেলের দাম যখন বাড়তে শুরু করলো তখন ভেবেছিলেন রমজান সামনে করে দাম বাড়তে শুরু করেছে। পরে দেখলেন দোকানে আর তেলই পাওয়া যায় না। চারজনের সংসারে মাসে ৫-৬ লিটার তেল দরকার হয়। গতকাল (বৃহস্পতিবার) সরকারি ঘোষণার পর আজকে আবার বাজারে এসেছেন, কম দামে পাওয়া যাবে এই আশায়।

মিরপুর থেকে এরপর যাই বনানী বাজারে। এখানকার বাজারে দেখা গেল তেলের উপস্থিতি মোটামুটি ভালো। প্রায় দোকানেই তেলের বোতল দেখা গেছে। বেশ কয়েকজন দোকানি বললেন, তারা সরকার নির্ধারিত মূল্যেই সয়াবিন বিক্রি করছেন।

বনানী বাজারে কথা হয় উম্মে কুলসুম (৩৩) নামের একজনের সাথে। এই তরুণী ব্যাংকার জানালেন, স্বামী দেশের বাইরে থাকায় তাকেই বাজার করতে হয়। সয়াবিন তেলের দাম নিয়ে প্রশ্ন করলে প্রথমে হাসলেন। পরে একটু ভেবে বললেন, “দেখেন, আমাদের তো তেল লাগবেই। এখন দাম বাড়লেও কিনতে হবে। দাম বাড়ানো বা কমানো আমাদের হাতে নেই। ”

বনানী বাজারেই কথা হয় সিএনজি অটোরিক্সা চালক সাইফুলের সাথে। সাইফুল পরিবার নিয়ে বসবাস করেন ভাসানটেক বস্তিতে। জানালেন, তার স্ত্রী টিসিবির ট্রাকে লাইন ধরে চার লিটার তেল কিনেছেন গত সপ্তাহে। দুইদিনে লাইন দিয়ে চার লিটার সংগ্রহ করেছেন। তাই আপাতত এখন আর সয়াবিন তেলের দাম নিয়ে চিন্তা করতে চাইছেন না।

কারওয়ান বাজার ঢাকার সবচেয়ে বড় পাইকারী বাজার। শুক্রবার যখন এখানকার পাইকারী বাজারে প্রবেশ করি তখন প্রায় জুম্মার নামাজের সময়। পাইকারী দোকানগুলোতে ভিড় কমে এসেছে। এখানেই কথা হয় ব্যবসায়ী মো. শফিকুর রহমানের সাথে। কারওয়ান বাজারে প্রায় ১০-১২ বছর যাবৎ ব্যবসা করেন শফিকুর। সয়াবিন তেলের দাম জানতে চাইলে এই ব্যবসায়ী বললেন, “তেলের দাম কে কতো রাখতেছে, এই কথা অহন আল্লায় ছাড়া কেউ কইতে পারবো না। যে যেমনে পারছে দাম রাখতেছে।” তার দোকানে কতো দামে বিক্রি হচ্ছে জানতে চাইলে শফিকুর বলেন, “আজকে তো সরকারি দামেই ১৬৮ করেই বেচা হইতেছে।”

শফিকুরের কাছে জানতে চাই তার দোকানে কোনো তেলের মজুত আছে কিনা? শফিকুর বলেন, “রাখার মতো তেল পাবো কই! আগে যা ছিল গত কয়দিনে সব শেষ হয়েছে। ডিলাররা তেল ছাড়তে চায় না। আবার মিলের মালিকরা তেল আটকায়া রাখছে। তারা যদি তেল না ছাড়ে তাহলে তেল কই পাব?”

এই ব্যবসায়ীর কাছে জানতে চাওয়া হয়, হঠাৎ করে তেল সংকট কেন হলো? তিনি বলেন, “সব সিন্ডিকেট। এর বেশি বলা যাবে না।”

কারওয়ান বাজারের পাইকারী মাকের্টের সামনে দেখা যায় এক মধ্যবয়সী লোক এক হাতে পাঁচ লিটারের এক তেলের বোতল নিয়ে যাচ্ছেন। তার পিছু পিছু গিয়ে দেখা যায় পাইকারী বাজারের সামনেই গাড়িতে উঠছেন তিনি। পরিচয় দিয়ে তার সাথে কথা বলে জানা গেল, সরকারি চাকরিজীবী এই লোক মাসের বাজার করতে এসেছেন বন্ধের দিন শুক্রবার। বাজারে দেশি সয়াবিন তেলের ৫ লিটারের বোতল না পেয়ে বিদেশি তেল কিনেছেন। কোন দেশের জানতে চাইলে তিনি জানালেন, মালয়েশিয়ার তেল।

কারওয়ান বাজার থেকে বেরিয়ে পরের গন্তব্য হাতিরপুল বাজারের দিকে এগিয়ে যাই। হাতিরপুল বাজারে যারা বাজার করতে আসেন অধিকাংশই ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবী। এই বাজারে মুদি দোকানি মো. লিটন প্রায় ২৫ বছর ধরে ব্যবসা করেন। গত এক সপ্তাহের সয়াবিন তেলের মূল্য বৃদ্ধি, বাজার থেকে তেল উধাও হয়ে যাওয়া ও ক্রেতাদের উপস্থিতি নিয়ে তার সাথে আলাপ হয়। লিটন বললেন, “গত দুইদিন ধরে ভোক্তা অধিকারের লোকজন আমাদের বাজারের ব্যবসায়ীদের সাথে যোগাযোগ করছে। আমরা তাদের বলেছি, ডিলাররা মাল না দেওয়ায় তেলের সংকট দেখা গেছে। এখন সরকার উদ্যোগ নিছে দাম কমে আসবো। এখন যে দামে তেল কিনে বেচি তাতে লাভ কম।”

কত টাকা দিয়ে ক্রয় করে কত টাকায় বিক্রি করেন, জানতে চাইলে লিটন জানান, ১৬৪ টাকা লিটার এনে ১৬৮ টাকা বিক্রি করতে হয়।

রমজান সামনে, তেলের দাম আবার বাড়বে কিনা এমন প্রশ্ন করা হলে হাতিরপুল বাজারের এই ব্যবসায়ী বলেন, “এখন আর দাম বাড়বে না। রমজানের পর, ঈদের পর বাড়বে।” ঈদের পর কেন বাড়বে জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, “সরকার এখন যে ভ্যাট বাতিলের ঘোষণা দিছে তা থাকবে জুন মাসের শেষ পর্যন্ত। তারপর আবারও বাড়তে পারে।”

লিটনের দোকান থেকে বের হওয়ার সময় পাশেই দেখা গেল এক নারীকে। হাতে বাজারের ব্যাগ। বাজারের দ্রব্যমূল্য নিয়ে কথা বলতে চাইলে দ্রুত পাশ কাটিয়ে সরে গেলেন। যাওয়ার আগে বললেন, “বিদেশে যুদ্ধ লাগার খবর দেশের টিভিতে দেইখ্যাই (দেখে) তেলের দাম বাড়ছে।”

পাশেই দাঁড়ানো জাহাঙ্গীর হোসেন (৩৮) এর কাছে জানতে চাইলাম, তিনিও কি তেলের দাম বৃদ্ধিও জন্য ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকে দায়ী করবেন কিনা? জবাবে স্যানিটারি মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করা জাহাঙ্গীর বললেন, “পড়ালেখা কম। যুদ্ধের খবর অতো জানি না। তেল কিনতে আসছিলাম। এখন এক লিটার কিনলাম। পরিবারকে বলতে হবে এটা দিয়ে অল্প করে খরচ করতে।” কতো দামে কিনলেন জানতে চাইলে জানালেন, ১৮০ টাকা। যদিও তা সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ১২ টাকা বেশি।

এই মুহূর্তে সরকারের নির্ধারিত দাম অনুযায়ী, বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৬৮ টাকা, পাঁচ লিটারের বোতলের দাম ৭৯৫ টাকা। আর খোলা সয়াবিন লিটার ১৪৩ টাকা। এর আগে গত সপ্তাহে সয়াবিন তেল ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকা হয়ে গিয়েছিল এক লিটারের বোতলের দাম। পাঁচ লিটারের বোতলের দাম ৯২০ থেকে হাজার টাকা। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ১৫ দিনে এভাবে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর মাধ্যমে ১০০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।

XS
SM
MD
LG