অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে বিতর্ক


ইউক্রেনের কিয়েভের বাইরে, ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর স্থানীয়দের মতে ভ্যাসিলকিভ বিমান ঘাঁটিতে পাঁচটি রকেট আঘাত করেছিল। সেখানে জ্বালানী ট্যাঙ্কগুলি থেকে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। ১২ মার্চ, ২০২২, ছবি-রয়টার্স/থমাস পিটার
ইউক্রেনের কিয়েভের বাইরে, ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর স্থানীয়দের মতে ভ্যাসিলকিভ বিমান ঘাঁটিতে পাঁচটি রকেট আঘাত করেছিল। সেখানে জ্বালানী ট্যাঙ্কগুলি থেকে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। ১২ মার্চ, ২০২২, ছবি-রয়টার্স/থমাস পিটার

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের ভোটদানে বিরত থাকা নিয়ে বিতর্ক জারি রয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের তরফে বলা হয়েছে, তারা নিরপেক্ষ অবস্থান থেকেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান না জানিয়ে রাশিয়াকে দোষারোপ করার কারণে বাংলাদেশ জাতিসংঘের প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থাকে। তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, জাতিসংঘে কৌশলগত কারণে বাংলাদেশ ভোটদানে বিরত ছিল। বিরোধী বিএনপি মনে করে, নিরপেক্ষ অবস্থানের কথা বলে বাংলাদেশ কার্যত রাশিয়ার আগ্রাসনকে সমর্থন দিয়েছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির স্বার্থ বিবেচনায় নিয়েই সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশি আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মধ্যেও বিভক্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন মনে করেন, বাংলাদেশ সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে। তার ভাষায়, বাংলাদেশ এ ধরনের সিদ্ধান্ত এবারই শুধু নয়, এর আগেও নিয়েছে। তিনি এ প্রসঙ্গে মিয়ানমারের বিপক্ষে ভোট না দেয়ার সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করেন। বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, আমাদের নৈতিক অবস্থান থেকে এটা সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ রাশিয়ার আক্রমণ থেকে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন হচ্ছে এটা আমাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি।

গত ২ মার্চ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ইউক্রেন আক্রমণের জন্য রাশিয়ার নিন্দা এবং অবিলম্বে সেনা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে ভোটের আয়োজন করা হয়। প্রস্তাবের পক্ষে ১৯৩টি দেশের মধ্যে ১৪১টি দেশ ভোট দেয়। বাংলাদেশসহ ৩৫টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। এই ভোটে দক্ষিণ এশিয়া কার্যত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছে। সার্কভুক্ত ৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা ভোটদানে বিরত ছিল। অন্যদিকে আফগানিস্তান, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপ প্রস্তাবের পক্ষে অবস্থান নেয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিনের মতে, ধারাবাহিক পররাষ্ট্র নীতির কারণে বাংলাদেশ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি বলেন- "সাউথ আমেরিকা, আফ্রিকান নেশন, সাউথ এশিয়া থেকে শুরু করে সাউথ ইস্ট এশিয়া অনেকটা একযোগেই ভোট দিয়েছে। এখানে একটা বেল্ট দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন ফরেন পলিসি থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, এবারও তাই নিয়েছে। কিন্তু অনেকেই বুঝতে পারছেন না আমাদের ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফরেন পলিসি এগিয়ে নেয়ার ক্ষমতা আছে কি-না? আমার মতে, আছে । দিস ওয়াজ দ্য মেসেজ ফর রেস্ট অব দ্য ওয়ার্ল্ড।" নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, আফগানিস্তান তারা তো সরাসরি ইউক্রেনকে সমর্থন করেছে। এই প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ইয়াসমিন বলেন, "তারা করলেই আমাদের করতে হবে এর কোনো মানে হয় না।" এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে অধ্যাপক ইয়াসমিন বলেন, "আমরা যদি লিথুয়ানিয়ার কাছ থেকে ৪ লাখ ভ্যাকসিন না পাই তাহলে আমরা পিছিয়ে থাকবো না। আমরা তো কয়েকদিন পর নিজেরাই ভ্যাকসিন তৈরি করবো। সেই সক্ষমতা আমাদের হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের কারণে গার্মেন্টস খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে এমনটা তিনি মনে করেন না। তিনি বলেন, প্রয়োজনে আমরা অন্য জায়গায় যাবো । সৌদি আরব, তুরস্ক, জাপানে মার্কেট গড়ে তোলা সম্ভব।" এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ইয়াসমিন বলেন, "আমরা ইউক্রেনের জনগণের পক্ষে আছি। রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক ভিন্ন। ইউক্রেনের সাথেও ভিন্ন। আমরা কারো পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দেই নাই। এখানে অন্য কাউকে অনুসরণ করে ভোট দেই নাই।" এই নীতিতে বাংলাদেশ স্ট্যান্ড করতে পারবে কি-না এই প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ইয়াসমিন বলেন, "ফরেন পলিসি বা ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনে প্রেডিকশন বলতে কিছু নেই। দেখা যাক কি হয়।"


ওদিকে বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, "আমাদের নৈতিক অবস্থান এবং আমাদের সংবিধানে যে কথা উল্লেখ করা আছে সে অনুযায়ী স্বাধীন, সার্বভৌম দেশের ওপরে আগ্রাসন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সেটা যে কারণেই হোক না কেন। সেখানে যদি কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণও থাকে সেটার জন্য কূটনৈতিক পথ অবলম্বন করতে হবে। কোনো আগ্রাসন গ্রহণযোগ্য নয় বর্তমান পৃথিবীতে। বিশেষ করে আইনভিত্তিক যে বর্তমান ব্যবস্থা আছে সেখানে এ ধরনের কোনো হস্তক্ষেপ হতে পারে না। এখান থেকে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন হচ্ছে সেটা আমাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এই কারণে যে, ক্ষুদ্র রাষ্ট্র হিসেবে যে ধরনের নিরাপত্তা পরিস্থিতি থাকা দরকার সেটা বাংলাদেশের জন্য খুবই জরুরি। ইউক্রেন যদিও আয়তনের দিক থেকে ক্ষুদ্র রাষ্ট্র নয়, কিন্তু তুলনামূলক ক্ষমতার বলয়ে সেটা একটা ক্ষুদ্র রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত আছে। কাজেই বড় শক্তিশালী রাষ্ট্র দ্বারা এই ধরনের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রকে যদি আক্রমণ করা হয় তাহলে অন্য যে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো আছে তাদের নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের প্রশ্নের জন্ম হবে।" জেনারেল মুনীরুজ্জামান বলেন, "সাম্প্রতিক ঘটনাবলী থেকে আমরা কোনো কিছু লাভ করতে পারি নাই। আমরা সামঞ্জস্য রেখে ভোটদানেও বিরত ছিলাম না। আমরা স্বাধীনতাকামী জনগণ ও দেশকে বরাবরই সমর্থন দিয়ে এসেছি। কিন্তু এবার আমরা আমাদের ঘোষিত নীতি থেকে বিচ্যুত হয়েছি। ভবিষ্যতে এর প্রভাব ব্যবসা-বাণিজ্যে পড়ে কি-না এ নিয়েই আমি চিন্তিত।"

XS
SM
MD
LG