অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

একুশে বইমেলার মিলনমেলা ভেঙেছে—মেয়াদ বাড়লেও বিক্রি হয়েছে প্রত্যাশার চেয়ে কম


সমাপনী দিনে বইমেলায় মানুষের সমাগম ছিল অনেক। বিক্রিও হয়েছে ভালো।

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী অমর একুশে বইমেলার মিলনমেলা বৃহস্পতিবার (১৭ মার্চ) ভেঙেছে। রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই বৃহস্পতিবার রাতে মাথার ওপরে চাঁদ উঠেছিল। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছগাছালির ওপর ছড়িয়ে গিয়েছিল ধবল জ্যোৎস্না। কাল শুক্রবার পূর্ণিমা। আগের রাতের অমল ধবল আলো গায়ে মেখে বৃহস্পতিবার রাতে মেলার মাঠ ছাড়লেন গ্রন্থানুরাগীরা।

এ বছর দুই মাস মিলিয়ে বইমেলা হলো বাংলা একাডেমির ইতিহাসের সবচেয়ে লম্বা মেয়াদে। ফেব্রুয়ারির ১৫ থেকে বৃহস্পতিবার ১৭ মার্চ পর্যন্ত মেলা হলো টানা ৩১ দিন। সাধারণত ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ২৮ বা অধিবর্ষে ২৯ দিন বইমেলা চলে। করোনা মহামারির কারণেই গত দুই বছর থেকে মেলার মেয়াদের এই নড়চড়। তাতে বই বিক্রিতেও বড় রকমের প্রভাব পড়েছে। গত বছর বেচাকেনা হয়েছে খুব কম, এবার সে তুলনায় কিছুটা বাড়লেও স্বাভাবিক সময়ের মেলার মতো বিক্রি হয়নি। এই নিয়ে প্রকাশকদের মনে কিছুটা খেদ থাকলেও মোটের ওপর শেষ পর্যন্ত মাসব্যাপী মেলা হয়েছে এবং ক্রেতারা বই কিনতে এসেছেন, এটা ভালো লক্ষণ বলেই মনে করছেন তারা।

বিক্রি কমেছে

বাংলা একাডেমি মেলার সমাপনী শেষে জানিয়েছে, এবার মেলায় ৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়েছে। একাডেমির সদস্য সচিব ড. জালার আহমদ তার সমাপনী প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সর্বশেষ ২০২০ সালের মেলায় বিক্রি হয়েছিল ৮২ কোটি টাকা। এবার বাংলা একাডেমির নিজস্ব বইয়ের বিক্রিও কমেছে। মেলায় একাডেমির বই বিক্রি হয়েছে ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। ২০২০ সালে বিক্রি ছিল ২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। তবে গত বছরের তুলনায় বিক্রির পরিমাণ বেড়েছে এবং মেলায় প্রচুর মানুষের সমাগম ঘটেছে।

আগামী প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ওসমান গনি, অবসর প্রকাশনীর ব্যবস্থাপক মাসুদ রানা, প্রতীক প্রকাশনীর ফাহিমা সুলতানা, স্বপ্ন ’৭১–এর প্রধান আবু সাঈদ ও ঐতিহ্যের ব্যবস্থাপক আমজাদ হোসেন খানসহ অনেক প্রকাশক ও বিক্রয় ব্যবস্থাপকেরা ভয়েস অফ আমেরিকার এই প্রতিবেদককে জানালেন, মেলার প্রথমার্ধে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে বিক্রির পরিমাণ যেমন ছিল, মার্চে সে্ই ধারাবাহিকতা আর থাকেনি। এই মেলার সঙ্গে ভাষার মাসের যে আবেগ আছে, বই বিক্রির ক্ষেত্রে তা বড় ভূমিকা রাখে। ফেব্রুয়ারির পরে বেশির ভাগ মানুষ সাধারণত বেড়ানোর উদ্দেশ্য নিয়েই মেলায় এসেছেন। ছুটির দিন ছাড়া অন্য দিনগুলোতে বিক্রির পরিমাণ ছিল খুব কম। এ ছাড়া করোনার একটি প্রভাব আছে। এসব মিলিয়েই এবার বিক্রি কমেছে। ফেব্রুয়ারির প্রথম থেকে মেলা শুরু হলে বিক্রির পরিমাণ আরও বাড়ত। তবে শেষ পর্যন্ত মাসব্যাপী মেলা হয়েছে এতেই তারা সন্তুষ্ট।

নতুন বই ৩ হাজারের বেশি

সমাপনী দিনেও মেলায় ১৯২টি নতুন বই এসেছে। বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্রের হিসাব অনুসারে এবার মেলা উপলক্ষে নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে ৩ হাজার ৪১৬টি। প্রকাশনায় কবিরা জয় করেছেন শীর্ষস্থান। এক হাজার ৬০টি কাব্যগ্রন্থ নিয়ে তাদের এই জয়যাত্রা। উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে ৬০১টি, গল্প ৪৬৭টি, প্রবন্ধ ১৭৯টি, জীবনী ১০৩টি, গবেষণা এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ১০২টি, শিশুতোষ ১০০টি, বঙ্গবন্ধুবিষয়ক ৮৫টি, ইতিহাসের বই ৭২টি, ছড়া ৬৪টি, ভ্রমণ ৫৬টি, বিজ্ঞানের বই পঞ্চাশের ঘরে যেতে পারেনি, ৪৮টিতে ঠেকে গেছে, ধর্মীয় বই ও অনুবাদ ৪০টি, রাজনীতিবিষয়ক ২৪টি, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যবিষয়ক ২১টি, নাটক ও রচনাবলী ১৭টি এবং অভিধান ১০টি। এই হলো এবারের মেলার প্রকাশনার চিত্র।

মেলায় তিন হাজারের বেশি বই প্রকাশিত হলেও বইয়ের মান নিয়ে কিছু অসন্তোষ পাঠক–লেখক–প্রকাশক সবারই ছিল। তবে একাডেমির পক্ষ থেকে সমাপনী অনুষ্ঠানে মেলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবার ৯০৯টি মানসম্মত বই প্রকাশ হয়েছে। যা মোট বইয়ের ২৬ শতাংশ। গত বছর মানসম্মত বইয়ের পরিমাণ ছিল ১৫ শতাংশ।

লেখকেরা যা বললেন

প্রতি বছর সমাপনী দিনে যেমন হয় এবারও তার ব্যত্যয় হয়নি। বৃহস্পতিবার সমাপনী দিনে প্রচুর গ্রন্থানুরাগীর সমাগম হয়েছিল মেলায়। শেষ দিনে বিক্রির পরিমাণ বেড়েছে। লেখকেরাও এসেছিলেন অনেকে। বাংলা একাডেমির সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত বিশিষ্ট কথাশিল্পী রফিকুর রশীদ ভয়েস অফ আমেরিকাকে বললেন, “শেষ দিনে মেলায় এক রকমের বিষাদের আবহ থাকে। মনে সেই অনুভুতি আছে। তবে এবার শেষ পর্যন্ত মেলা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলো। এ মাসে আমাদের এখানে ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। প্রকৃতির সেই বিরূপতা থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে। তবে বইমেলা ফেব্রুয়ারিতে হলেই সব দিক থেকে মানানসই হয়। আগামীতে সেই দিকটি বিবেচনায় রাখতে হবে।”

মেলার পরিসর নিয়ে ভয়েস অফ আমেরিকার এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন কথাসাহিত্যিক দন্তস্য রওশন। তিনি বললেন, “পরিসর এত বড় হয়েছে যে, এক দিনে সারা মেলা ঘুরে বই কেনা সম্ভব নয়। বিশেষ করে মাঠের পূর্বপ্রান্তে লোকজন যেতেই চাননি। কাজেই আগামী বছর মেলার বিন্যাসের সময় এই দিকগুলো ভাবতে হবে। খাবারের দোকানগুলো পূর্ব দিকে বসিয়ে বাইয়ের স্টল–প্যাভিলিয়ন সামনের দিকে আনতে হবে। তা ছাড়া এবার লেখক বলছি মঞ্চের অনুষ্ঠানও ভালো হয়নি। এই আলোচনা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। এই আয়োজন কী করে আকর্ষণীয় করা যায় তা ভাবতে হবে।”

সমাপনী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন

মেলার সমাপনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল একাডেমির মাঠের মূলমঞ্চে। প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। প্রতিবেদন পাঠ করেন মেলার সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ। সভাপতিত্ব করেন একাডেমির সভাপতি কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন।

সমাপনী অনুষ্ঠানে একাডেমির পক্ষ থেকে নানা প্রতিকূলতার ভেতরেও মাসব্যাপী মেলার অনুষ্ঠিত হওয়ায় লেখক, পাঠক ও প্রকাশকসহ সবাইকে ধন্যবাদ জানানো হয়। মেলার স্টলবিন্যাস এবং অন্য বিষয়ে যেসব অভিযোগ এসেছে, আগামীতে সমাধানের জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানানো হয়।

সন্ধ্যার পর মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের স্বাধীনতা স্তম্ভের সামনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০২তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের্ আয়োজন করা হয়। এ সময় বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি এবং বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির পক্ষ থেকে ১০২টি কেক কাটা হয়। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ কেক কেটে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন। এই আনন্দঘন আয়োজনের ভেতর দিয়ে শেষ হয় বইমেলার আয়োজন।

XS
SM
MD
LG