অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

সাক্ষাৎকারঃ "মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সবাই যেন মালিকানা অনুভব করে এমন উদ্যোগ গ্রহণ করলাম"- মফিদুল হক


মফিদুল হক, ছবি-সাহাদাত পারভেজ
মফিদুল হক, ছবি-সাহাদাত পারভেজ

মফিদুল হক মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি। তিনি একাধারে একজন লেখক, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও প্রকাশক। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রবর্তিত মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী ভাষ্যসংগ্রহ প্রকল্পের অন্যতম প্রণেতা ও পরিচালক। বাংলাদেশের প্রগতিশীল সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সংগঠকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন তিনি। ২০১৪ সালে প্রবন্ধ সাহিত্যের জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্সের সদস্য এবং ‘সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব জেনোসাইড অ্যান্ড জাস্টিস’-এর প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক তিনি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠার নেপথ্য কথা, গণহত্যা দিবস ও স্বাধীন দিবসের প্রাক্কালে ভয়েস অফ আমেরিকার সঙ্গে কথা হয় তার।


ভয়েস অফ আমেরিকার পক্ষে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন এহসান মাহমুদ।


ভয়েস অফ আমেরিকা: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার ২৫ বছর পেরিয়ে গেল গত মার্চে। এর যাত্রা শুরু হয়েছিল আপনাদের হাত ধরে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেসরকারি উদ্যোগে এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠার চিন্তা কীভাবে এলো আপনাদের?


মফিদুল হক: আপনারা জানেন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। যদিও এর চিন্তাটা আমরা করেছিলাম ১৯৯৫ থেকেই। সেই সময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের ২৫ বছর পেরিয়ে যাচ্ছিল। আমরা সমমনা কয়েকজন আলোচনা করতাম- স্বাধীনতার অনেক বছর পার হয়ে যাচ্ছে, অথচ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংগ্রহের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। সরকারি কোনো উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে না। তাই আমরা নিজেরাই কিছু একটা করার উদ্যোগ নিই। যদিও এই দীর্ঘ সময়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় অনেক হারিয়ে যাচ্ছে। আবার অনেকেই চলে যাচ্ছেন। অনেক স্মারক, স্মৃতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটা বহমান রাখার বিষয়ে আমরা চিন্তিত হয়ে পড়ি। তখন নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার কথা ভাবি। সে চিন্তা থেকেই ১৯৯৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি ট্রাস্ট গঠন করা হয়। ট্রাস্টের মাধ্যমে অনেক রকম পরিকল্পনা গৃহীত হয়। তখন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করার বিষয়টাও ঠিক করা হয়েছিল। পরে চূড়ান্তভাবে ১৯৯৬ এর ২২ মার্চ যাত্রা শুরু হয়েছিল।


ভয়েস অফ আমেরিকা: বেসরকারি উদ্যোগে এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠার সময়কার চ্যালেঞ্জ কী ছিল? বিশেষকরে, স্মারক সংগ্রহ ও আর্থিক সক্ষমতার বিষয়টি কেমন ছিল?

মফিদুল হক: আমরা আটজন ট্রাস্টি ছিলাম। আমাদের দ্ইুজন ট্রাস্টি এরইমধ্যে মারা গেছেন। আমরা তাদের হারিয়েছি। তখন আমাদের মনে হলো, এই আটজন মিলে জাদুঘর করতে পারব না যদি দেশের মানুষের, সমাজের একটা বড় রকম সহায়তা না পাই। আমাদের একটা চিন্তা ছিল জাদুঘরে যা থাকবে তা দৃশ্যমান করে সাধারণ মানুষের কাছে উপস্থাপন করা হবে। আমরা চেয়েছিলাম, যে যেভাবে পারবেন স্মারক দান করবেন, আমরা সংগ্রহ করব। পরে জাদুঘরে সেটা দেখানো হবে। প্রথমে দৃশ্যমান করার জন্য আমরা বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলাম সেগুনবাগিচায়। প্রাথমিকভাবে সেখানেই কাজ শুরু হল। আমাদের দেশে তখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক বিকৃতি ও বিভ্রান্তি হচ্ছিল। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মতো করে প্রচার করতো। আমরা ঠিক করলাম তথ্যমূলকভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস উপস্থাপন করা হবে। সেই লক্ষেই আমরা কাজ করা শুরু করেছিলাম।


ভয়েস অফ আমেরিকা: জাদুঘরের জন্য স্মারক সংগ্রহের কাজ কীভাবে শুরু করা হল? প্রথমদিকে লোকজন তাদের সংগ্রহে থাকা স্মারক আপনাদের হাতে তুলে দিতে আস্থা পেল কীভাবে?


মফিদুল হক : প্রথমদিকে আমাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে সংবাদমাধ্যম। দেশে একটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর হচ্ছে এই কথা নানাভাবে উঠে আসে। আমরা জাদুঘরের জন্য স্মারকের আবেদন জানিয়ে দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে গেলাম। সেখানেও একটা সাড়া পাওয়া গেল। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর হবে- এমন কথা জানাজানি হল। যখন কেউ স্মারকগুলো নিয়ে এলেন, তখন সুফিয়া কামাল, শহীদজায়া ও সেক্টর কমান্ডারগণ সেসব গ্রহণ করলেন। সাধারণ লোকজন এটাকে গ্রহণ করলেন। আমরা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সবাই যেন মালিকানা অনুভব করে এমন উদ্যোগ গ্রহণ করলাম। তহবিল পাওয়া গেল সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। সর্বস্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করা হলো। শুরুতে এটা ব্যক্তিগত উদ্যোগ হলেও তা যেন সামাজিক উদ্যোগে পরিণত হয়, সে চেষ্টাই ছিল আমাদের। এখন প্রতিষ্ঠার এতোদিন পরে আমাদের মনে হচ্ছে আমরা তা অনেকটাই করতে পেরেছি।

মফিদুল হক, ছবি - সাহাদাত পারভেজ
মফিদুল হক, ছবি - সাহাদাত পারভেজ

ভয়েস অফ আমেরিকা: এইভাবে বেসরকারি উদ্যোগে জাদুঘর করার জন্য আপনাদের সামনে কোনো উদাহরণ ছিল কী?


মফিদুল হক: শুরুতে আমরা যখন ভেবেছিলাম তখন অন্য কোনো দেশের কথা ওইভাবে স্মরণ ছিল না। আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। সেই চিন্তা থেকেই কাজ শুরু হয়েছিল। এখন বিশ্বের অনেক দেশেই স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কথা আমরা জানছি। কানাডা ওয়ার ২০০৫ সালে উদ্বোধন করা হয়। আরও অনেক দেশেই রয়েছে।

ভয়েস অফ আমেরিকা: স্মারক সংগ্রহ করতে গিয়ে শুরুতে কী ধরনের জিনিস সংগ্রহ শুরু করলেন আপনারা?


মফিদুল হক : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ তো কেবল নয় মাসের নয়। এর আগেও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে। আছে দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিহাস। এছাড়া বাঙালির সভ্যতা ও সংস্কৃতিও অনেক পুরোনো। আমরা সবটাই অল্পের মধ্যে দেখাতে চেয়েছিলাম স্মারক হিসেবে। আমরা কিছু মডেল পেয়েছিলাম। যেমন বাগেরহাট ষাটগম্বুজ মসজিদ, পাহাড়পুরের সভ্যতা, কান্দজী মন্দির। আবার ব্রিটিশ যুগ থেকেও আমরা কিছু স্মারক পেয়েছিলাম। আবার খুব বেশি পরিচিত নয় কিন্তু মুক্তিযুদ্ধেও সঙ্গে জড়িতএ রকম অনেক স্মারক আসতে লাগল। ওই সময়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেত্রী ছিলেন। জাদুঘর উদ্বোধনের আগে তিনি বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত বেশকিছু সামগ্রী যেমন- তামাকের কৌটা, তার লেখা কারাগারের চিঠি আমাদের হাতে তুলে দিলেন। এভাবে অনেক রকম স্মারক আসা শুরু হলো। তখন এসব স্মারক রাখাটাই আমাদের বড় সমস্যা হয়ে গেল। আমরা দেখলাম যে একটি স্থায়ী জাদুঘর ভবন না হলে চলবে না।


ভয়েস অফ আমেরিকা : সেগুনবাগিচার ভাড়াবাড়ি থেকে আপনারা তো এখন আগারগাঁওয়ে স্থায়ী ভবনে চলে এসেছেন ....


মফিদুল হক : জাদুঘরের নিজস্ব একটা ভবন তৈরি হয়েছে। এটা একটা বড় বিষয়। সব রকম সুবিধাই এখানে আছে। ফলে আমরা স্মারক সংরক্ষণ, স্মারক উপস্থাপন করতে পারছি। এই জাদুঘরের এখন অনেক শক্তি। সমাজ এই শক্তিটা ব্যবহার করবে- এটাই মূল ব্যাপার। ব্যক্তিগত উদ্যোগে শুরু হলেও এখন এটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে।

ভয়েস অফ আমিরাকা: এখন এই জাদুঘর কীভাবে পরিচালিত হয়?


মফিদুল হক : ট্রাস্টি বোর্ডের কিছু নীতিমালা আছে। কিছু কাজ আমরা দায়িত্ব ভাগ করে সম্পন্ন করি। আমাদের নিবেদিত একটা কর্মী বাহিনী আছে। তবে এত বড় জাদুঘরের তুলনায় সংখ্যায় তারা খুব কম। এখানে এখন আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়। চলচ্চিত্র উৎসব হয়। এখানে সংগীত উৎসব হয়। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণহত্যার বিচারের দাবি তুলে ধরা হয়। একটা বিশাল স্বেচ্ছাসেবী কর্মী দল আছে। এটা একটা বড় শক্তির জায়গা।

ভয়েস অফ আমেরিকা : আপনারা বেসরকারিভাবে কাজ করতে গিয়ে কোনো বাঁধার মুখে পড়ছেন কিনা? বিশেষকরে, যেখানে রাজনৈতিক দলসমূহ বিভিন্ন সময়ে নিজেদের মতো করে ইতিহাস বলতে চায়, সেক্ষেত্রে কোন পন্থা আপনারা অনুসরণ করেন?


মফিদুল হক : আমরা শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংগ্রহ ও সংরক্ষণে রাজনৈতিক মতবাদ, দলীয় চিন্তাধারা ও ধর্মীয় বিবেচনাকে দূরে রাখতে চেয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে স্লোগান ছিল ‘বাংলার হিন্দু বাংলার মুসলিম বাংলার বৌদ্ধ বাংলার খ্রিস্টান- আমরা সবাই বাঙালি।’ এখন এই চিন্তাটা ধরে রাখলে সকল বিভক্তি দূর হবে। বাংলাদেশকে ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে আমরা দলমত ও ধর্মের ঊর্দ্ধে রেখে দেখতে চাই। যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল সেভাবেই মুক্তিযুদ্ধকে দেখতে হবে।

XS
SM
MD
LG