অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

বিশ্বাস ছিল আব্বার হত্যার বিচার পাব: মৌলি আজাদ


মৌলি আজাদ
মৌলি আজাদ

"বিশ্বাস ছিল আব্বার হত্যার বিচার পাব"- হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলার রায়ে চার জঙ্গির মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পরে ভয়েস অফ আমেরিকাকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় এই মন্তব্য করেছেন তার কন্যা মৌলি আজাদ।

বাংলাদেশের বহুমাত্রিক ও প্রথাবিরোধী লেখক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলায় জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) চার জঙ্গির ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন দেশটির আদালত। বুধবার (১৩ এপ্রিল) ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. আল মামুনের আদালতে এই রায় ঘোষণা করা হয়।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চারজন হচ্ছেন- মিজানুর রহমান ওরফে মিনহাজ, সালেহীন ওরফে সালাহউদ্দিন, নূর মোহাম্মদ ওরফে শামীম এবং আনোয়ারুল আলম ওরফে ভাগনে শহীদ। এদের মধ্যে মিজানুর রহমান ও আনোয়ারুল আলম কারাগারে রয়েছেন। সালেহীন ওরফে সালাহউদ্দিন ও নূর মোহাম্মদ ওরফে শামীম পলাতক আছেন।

এর আগে গত ২৭ মার্চ আদালতে এই মামলার যুক্তিতর্ক শুনানি শেষ হয়। আদালত রায় ঘোষণার জন্য আজের দিন ধার্য করা হয়েছিল।

এই রায়ের পরে ভয়েস অফ আমেরিকাকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় হুমায়ুন আজাদের পরিবারের সদস্য এবং মামলার সাক্ষী ও বিশিষ্টজনরা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। তারা দ্রুত মামলার রায় বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন।

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “আমাদের দেশে এই ধরনের মামলায় দীর্ঘসূত্রীতার একটি বিষয় থাকে। দেরিতে হলেও হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলার রায় হয়েছে এটা ভালো দিক। আমি বলতে চাই মানুষকে হত্যা করে তার মতামতকে হত্যা করা যায় না। তাই হুমায়ুন আজাদকে হত্যা করেও হত্যাকারীরা তার চিন্তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।”

পরিবারের প্রতিক্রিয়া

হুমায়ুন আজাদের বড় মেয়ে মৌলি আজাদ ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “আমার আব্বার হত্যা মামলার বিচার হয়েছে এতে আমরা সন্তুষ্টি প্রকাশ করছি। অনেকেই বলতেন, আব্বার মামলার খবর কী? বিচার পাব কিনা? আমি সবসময়ই মনে করতাম, বর্তমান (আওয়ামী লীগ) সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। তাই আব্বার হত্যার একটি বিচার আমরা পাব। এখন দীর্ঘদিন পরে হলেও মামলার রায় পেয়েছি, এটা অবশ্যই ভালো ঘটনা হিসেবে দেখতে চাই। এখন রায় কার্যকর হবে এটাই আমরা আশাকরি।”

হুমায়ুন আজাদ ও স্ত্রী লতিফা কোহিনূর
হুমায়ুন আজাদ ও স্ত্রী লতিফা কোহিনূর

হুমায়ুন আজাদের স্ত্রী লতিফা কোহিনূর ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “আমার সন্তানেরা ছোটবেলায় তাদের বাবাকে হাঁরিয়েছে। বাবার আদর বঞ্চিত হয়েছে। এতোদিন পরে হলেও আমরা একটা বিচার পেয়েছি। এখন দ্রুত তাদের বিচারের রায় কার্যকর করা হোক। এছাড়া বাকি যে দ্ইু সদস্য পলাতক রয়েছে তাদেরকেও দ্রুত আটক করার দাবি জানাই। পুলিশের গাফিলতিতে এই দুইজন পালিয়েছে। তাই বাকিদের আটক এবং যারা আটক আছে তাদের ফাঁসি কার্যকর করার দাবি জানাই। এই রায় কার্যকর হলে মানুষ বুঝতে পারবে অন্যায়ভাবে একজনকে হত্যা করার কোনো অধিকার কারও নাই”।

হত্যা চেষ্টা মামলা থেকে হত্যা মামলা

২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে অমর একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে হুমায়ুন আজাদকে কুপিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে যায় জঙ্গিরা। এ ঘটনায় পরদিন তার ভাই মঞ্জুর কবির ঢাকার রমনা থানায় হত্যাচেষ্টার অভিযোগে একটি মামলা করেন। পরে দেশে ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর জার্মানিতে যান হুমায়ুন আজাদ। সেখানেই ওই বছরের ১২ আগস্ট মারা যান হুমায়ুন আজাদ। এরপরই মামলাটি আদালতের নির্দেশে হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়।

প্রায় তিন বছর তদন্ত শেষে ২০০৭ সালের ১৪ জানুয়ারি পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ২০০৯ সালের ৭ অক্টোবর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে হত্যা মামলার বিচার শুরু হয়। মামলার পাঁচ আসামির মধ্যে হাফিজ মাহমুদ নামে একজনের আগেই মৃত্যু হয়েছে।

হামলার দিন যা ঘটেছিল

মামলার নথি সূত্রে জানা যায়, ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাত আটটার দিকে সানির নেতৃত্বে মিজানুর একটি চাপাতি, জেএমবির কিলিং স্কোয়াডের সদস্য নূর মোহাম্মদ ছুরি, আনোয়ারুল ও নুরুল্লাহ বোমা নিয়ে অবস্থান করছিলেন। হুমায়ুন আজাদ রাত সোয়া নয়টার দিকে বইমেলা থেকে বের হয়ে হেঁটে টিএসসির দিকে যেতে থাকেন। বাংলা একাডেমি ও টিএসসির মাঝামাঝি অবস্থানে পৌঁছালে সানির নেতৃত্বে তার সহযোগীরা হুমায়ুন আজাদকে ঘেরাও করে ফেলেন।

মিজানুর ও নূর মোহাম্মদ ব্যাগ থেকে চাপাতি-ছুরি বের করে হুমায়ুন আজাদের ঘাড়, মাথা, মুখ, গলা, হাতসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে উপর্যুপরি আঘাত করেন। এ সময় আনোয়ারুল ও নুরুল্লাহ বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক ছড়ান। এরপর হামলাকারীরা সাধারণ লোকজনের সঙ্গে মিশে যান।

প্রকাশক ওসমান গনীকে হুমকি দিয়ে চিঠি

২০০৪ সালে ‘আগামী প্রকাশনী’ থেকে হুমায়ুন আজাদের ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলায় আদালতে সাক্ষ্য দেন আগামী প্রকাশনীর প্রকাশক ওসমান গনী।

ওসমান গনী আদালতে বলেন, "২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাত নয়টার দিকে বাসায় যাই। পরে টেলিফোনে প্রথমে সংবাদ পাই, হুমায়ুন আজাদ স্যারকে মেরে ফেলা হয়েছে। পরে শুনি, স্যার মেডিকেলে চিকিৎসাধীন। এ সংবাদ শোনার পর আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে যাই। তখন হুমায়ুন আজাদ স্যারকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পাই।"

২০০৪ সালের বইমেলায় 'পাক সার জমিন সাদ বাদ’ উপন্যাসটি ব্যাপক বিক্রি হয় বলে জানান ওসমান গনী। তিনি আদালকে বলেন, "বইটি ইত্তেফাক পত্রিকায়ও বের হয়। তখন মৌলবাদীরা মিছিল করে বইটি নিষিদ্ধের দাবি জানায়। মৌলবাদীরা হুমায়ুন আজাদকে মুরতাদ ঘোষণা করে। তাকে হত্যার হুমকি দেয়। আমাকেও তারা মৃত্যুদণ্ড দিয়ে চিঠি পাঠায়।"

ওসমান গনী ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেন, “দীর্ঘদিন পার হলেও আলোচিত এই মামলার বিচার হয়েছে, এটা ভালো খবর। হুমায়ুন আজাদের মতো একজন বহুমাত্রিক লেখককে আমরা হারিয়েছি, এটা দেশের জন্য অভাবনীয় ক্ষতির। এখন দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই রায় কার্যকর হবে এটাই আশাকরি।”

"প্রথমে আমাদেরকে আসামী করার চেষ্টা করা হয়"

কবি মোহন রায়হান হুমায়ুন আজাদের একসময়ের ছাত্র। তিনি এই মামলার একজন সাক্ষী। মামলার রায়ে চারজনের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা হওয়ার ভয়েস অফ আমেরিকা তার সাথে যোগাযোগ করে। তার প্রতিক্রিয়া জানতে চেষ্টা করে।

ভয়েস অফ আমেরিকাকে মোহন রায়হান বলেন, “আমি স্যারের ছাত্র ছিলাম। আবার তার সাথে জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠনে কাজ করেছি। হামলার দিন আমিও বইমেলায় ছিলাম। বইমেলা থেকে বের হওয়ার আগে স্যারের সাথে আড্ডা দিয়েছিলাম। সেখানে আরও অনেকেই ছিলেন। আমি বের হয়ে পল্টনের দিকে রওনা দিয়েছিলাম। স্যার টিএসসির দিকে। আমি পল্টনে সংবাদের অফিসের সামনে আসতেই খবর পেলাম হুমায়ুন আজাদ স্যারকে হামলা করা হয়েছে। খবর পেয়েই আমি ঢাকা মেডিকেলে ছুটে গেলাম। দেখি স্যার রক্তাক্ত অবস্থায় আছেন। তখনও স্যারের জ্ঞান আছে। আস্তে আস্তে আরও অনেকে খবর পেয়ে ছুটে এলেন। স্যারকে ক্যান্টনমেন্টে সিএমএইচ-এ নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে রক্ত যোগার করা থেকে শুরু করে নানাকাজে জড়িয়ে পড়লাম। সারারাত সেখানেই কাটিয়ে দিলাম।”

এই ঘটনায় তিনি নিজেই আসামী হতে চলেছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এরপরে আমরা যারা প্রথমে ওখানে গিয়েছিলাম বলা হল আমাদের আসামী করা হবে। পরে স্যারের সাথে কথা বলে আমাকে বাদ দেওয়া হয়েছিল।”

দীর্ঘদিন পরে হলেও বিচারকার্য নিয়ে সন্তুষ্টির কথা জানিয়ে মোহন রায়হান বলেন, “আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। হুমায়ুন আজাদ স্যারের মামলার বিচার হয়েছে, এটা আশার কথা। কিন্তু আরও এমন ঘটনা দেশে বহু ঘটেছে। এখন আমরা আশাকরি, সেইসব মামলারও বিচার হবে। দেশে মুক্তমত ও মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা তা বাস্তবায়ন করতে হবে। দেশকে যারা মৌলবাদ ও ধর্মীয় রাজনীতির দিকে নিয়ে যায় তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।”

XS
SM
MD
LG