বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২তম। যা, গত বছর ছিল ১৫২তম। বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করে এই সংগঠনটি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যম কতটা স্বাধীন তার ওপর ভিত্তি করেই ২০০২ সাল থেকে আরএসএফ এই সূচক প্রকাশ করে আসছে।
এবারের রিপোর্টে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশকে নানা ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। যেমন ভালো, সন্তোষজনক, সমস্যাযুক্ত ও কঠিন বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
রিপোর্টে, বাংলাদেশ পরিস্থিতিকে বর্ণনা করা হয়েছে খুবই গুরুতর হিসেবে। ২০২২-এর তালিকায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বিষয়ে, শীর্ষে রয়েছে নরওয়ে। আর সবচেয়ে নিচে অবস্থান করছে উত্তর কোরিয়া। ভারতের অবস্থান ১৫০তম। গত বছরের তুলনায় দেশটি আট ধাপ পিছিয়েছে।
সাংবাদিকতার শিক্ষক ও সাংবাদিক নেতাদের কেউ কেউ, এই পরিস্থিতির জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে দায়ী করেছেন। এই আইনে, গত ২৬ মাসে ৮৯০টি মামলা হয়েছে। এরমধ্যে, বেশিরভাগ মামলাই হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এই রিপোর্টকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। বলেছেন, “এই রিপোর্ট বিদ্বেষমূলক, আপত্তিকর এবং অগ্রহণযোগ্য।” তিনি বৃহস্পতিবার (৫ মে) দুপুরে, চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়কালে এ মন্তব্য করেন ।
তথ্যমন্ত্রী বলেন, “এই রিপোর্ট মনগড়া । বিদেশে বসে যারা বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচার চালায়, তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে, তারা অসৎ উদ্দেশ্যে রিপোর্ট তৈরি করে থাকে।”
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রসঙ্গে তথ্যমন্ত্রী বলেন, “যখন আইনটি তৈরি করা হয়, তখন ক্ষতিগ্রস্তদের আইনি সুরক্ষা দেয়ার সুযোগ ছিল না। এই আইন পৃথিবীর অনেক দেশেই আছে এবং হচ্ছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক, অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস মনে করেন, বিশ্ব গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান পিছিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এই আইনে সাংবাদিকরাই সবচেয়ে বেশি হেনস্তা ও গ্রেপ্তারের শিকার হয়েছেন।
ভয়েস অফ আমেরিকাকে অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, “এক রুদ্ধশ্বাস অবস্থা বিরাজ করছে বাংলাদেশে। আর, এটা তৈরি করেছে সরকার। গণতন্ত্র যেখানে নাজুক অবস্থায়, সেখানে গণমাধ্যম টিকে থাকবে, এটা কি করে আশা করা যায়। কেননা, গণতন্ত্রের সঙ্গে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে রয়েছে।”
অধ্যাপক ফেরদৌস বলেন, “বাংলাদেশে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী সরকার রয়েছে। সেই পরিচয়টাই সামনে আসছে বারবার। যে কারণে, গণতান্ত্রিক ও মুক্তচিন্তার জায়গা ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। আমাদের ভাবমূর্তি খারাপের দিকে যাচ্ছে।”
র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গটিও টেনে আনেন তিনি। বলেন, “এরপর আমাদের বোঝা উচিত ছিল, কিন্তু আমরা শুধরাচ্ছি না।”
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (একাংশ) সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুলও একই মত দেন। বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার গোটা সাংবাদিকতা পেশাকেই এক চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।”
ভয়েস অফ আমেরিকাকে তিনি বলেন, “বিদ্বেষপ্রসূত, অগ্রহণযোগ্য বলে রিপোর্ট উড়িয়ে দেয়াটা ঠিক হবে না। এর পেছনের কারণ খুঁজতে হবে। বিশ্লেষণ করতে হবে কেন বাংলাদেশের অবস্থান দিনে দিনে অবনমন হচ্ছে। তথ্যমন্ত্রীকে এর মূল কারণ খুঁজে বের করতে হবে।”
তিনি বলেন, “সাংবাদিক সংগঠনগুলোরও দায়িত্ব রয়েছে। যদিও সাংবাদিক সংগঠনগুলো রাজনৈতিক কারণে বিভক্ত।” তার ভাষায়, “গণমাধ্যম না থাকলে সংগঠন থেকে কী হবে। পেশাদার সংগঠনগুলোর অবশ্যই এখানে করণীয় রয়েছে। চুপ করে বসে থাকাটা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না।”
মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, “সূচকে পরোক্ষভাবে সরকারের দায় রয়েছে। সূচকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কিছু মানুষের অনেক টাকা রয়েছে। তারা বড় বড় ব্যবসায়ী। এরাই গণমাধ্যমের মালিক হয়েছেন। এই মালিকেরা গণমাধ্যমকে নিজেদের প্রভাব বিস্তার এবং মুনাফা অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। এই কারণে তারা সরকারের কোনো কাজের সমালোচনা করতে চান না। সুসম্পর্ক রেখে ব্যবসা করতে চান।” তার মতে, সূচকে অবনমনের পেছনে এটা একটি বড় কারণ।
উল্লেখ্য যে, আরএসএফের রিপোর্টে বলা হয়েছে- ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কারণে, বাংলাদেশের সাংবাদিকরা পুলিশি সহিংসতা, রাজনৈতিক কর্মীদের আক্রমণ ও জঙ্গি সংগঠনগুলোর হাতে হেনস্তা বা হত্যার শিকার হওয়ার পথ উন্মোচিত হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, কোনো প্রকার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের অনুমতি দেয়া হয়েছে। যা, সাংবাদিকের খবরের সূত্রের গোপনীয়তার কোনো নিশ্চয়তা দেয় না।