কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেসে, শি জিনপিং নজির ভঙ্গ করে তৃতীয় মেয়াদে নেতৃত্ব লাভ করেছেন। আর, পলিটব্যুরোর স্থায়ী কমিটি সাজিয়েছেন সম্পূর্ণভাবে তার অনুগতদের দিয়ে। এর মধ্য দিয়ে, মাও সেতুং-এর পর, শি জিনপিং চীনের সবচেয়ে ক্ষমতাধর শাসক হিসেবে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করলেন।
শি এক দশক ধরে ক্ষমতায় রয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে, চীন, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট, উভয় ক্ষেত্রেই ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে।
শি এর আমলে চীনে যে পরিবর্তনগুলো হয়েছে, তার মধ্য থেকে কয়েকটি নিচে তুলে ধরা হল।
১. পশ্চিমা দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোতে চীনের ভাবমূর্তি খারাপ হয়েছে
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার সম্পর্কের দ্রুত অবনতি হয়েছে। চীনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের কঠোর নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আরও দ্রুত সম্পর্কের অবনতি হয়। তবে, মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ এবং তাইওয়ানের প্রতি চীনের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসনের প্রতি পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির কারণেও চীনের ভাবমূর্তির অবনতি হয়।
২. দুর্নীতির বিরুদ্ধে শি’র অভিযান
দায়িত্ব গ্রহণের পর কমিউনিস্ট পার্টি থেকে দুর্নীতির মুলোৎপাটনে শি এক অনন্য অভিযান শুরু করেন। এমন উদ্যোগ জনগণের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়।তবে,বেশ কিছু বিশ্লেষক বলেছেন যে এটি শি এর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্মূলের ক্ষেত্রেও সহায়ক হয়েছে।
৩. এক সময়ের বিশৃঙ্খল সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা
তিব্বত, ঝিনজিয়াং ও হংকং; এই এলাকাগুলো রাজধানী বেইজিং থেকে বেশ দূরে। এলাকাগুলো অনেকদিন ধরেই চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির জন্য মাথাব্যথার কারণ ছিল।
নিরাপত্তার অজুহাতে শি ঐ এলাকাগুলোতে নজিরবিহীনভাবে ব্যাপক দমনপীড়ন শুরু করেন; এর মাধ্যমে এসব সীমান্তবর্তী এলাকাকে নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।
এমন দমন অভিযানের সময় ঝিনজিয়াং -এ আনুমানিক ১০ লক্ষ সংখ্যালঘু মুসলিম উইঘুরদের শিবিরে আটকে রাখার ঘটনা ঘটে। হংকংয়ে ২০১৯ সালের সরকারবিরোধী বিশাল বিক্ষোভ দমনে বেইজিং জাতীয় নিরাপত্তা আইন নামে একটি আইনকে ঢালাও ভাবে ব্যবহার করে।
৪. তাইওয়ানের বিরুদ্ধে হুমকি জোরদার
মাও এর পর থেকে চীনের সব নেতাই স্বশাসিত তাইওয়ান দ্বীপটিকে চীনের সাথে “পুনরেকত্রীকরণের” গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছেন।
তবে শি-এর আমলে তাইওয়ান প্রণালীতে উত্তেজনা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পিপল’স লিবারেশন আর্মি দ্বীপটির আশপাশে তাদের কার্যক্রমের মাত্রা বৃদ্ধি করেছে। এসব কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে সামরিক মহড়া থেকে শুরু করে তাইওয়ানের আকাশ প্রতিরক্ষা চিহ্নিতকরণ এলাকায় অনুপ্রবেশ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি করা।
গত আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইপেই সফরের জের ধরে, চীন নজিরবিহীন মাত্রায় সামরিক মহড়া পরিচালনা করে।
৫. অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান ভাবে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা
অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও নির্দেশনা বৃদ্ধি করেছেন শি। যেসব খাতে নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করা হয়েছে, সেগুলো হলো বেসরকারি পরিচালনায় সবচেয়ে গতিশীল খাত, বিশেষ করে অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে এবং লাভজনক শিক্ষা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়।
এই খাতগুলোতে দমন এবং চলমান কোভিড-১৯ সংক্রান্ত বিধিনিষেধের প্রভাব, শহরে বেকারত্ব বৃদ্ধি করেছে এবং ভোক্তাদের আস্থা হ্রাস করেছে।
৬. প্রবৃদ্ধি হ্রাস, আয় বৃদ্ধি
শি দায়িত্ব গ্রহণের আগেই দুই সংখ্যার প্রবৃদ্ধির আমল শেষ হয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস পেতে শুরু করে। অর্থনীতির আকার বড় হওয়ার সাথে সাথে এটা ছিল একটা অনস্বীকার্য প্রবণতা।শি-এর শাসনামলে অবিচলভাবে আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ।ব্যাপক সংখ্যক বিশ্লেষক সতর্ক করেছেন যে, চীনের বিনিয়োগ ব্যাপক ও অবকাঠামো নির্মাণ মডেলের ওপর নির্ভরশীল। উন্নয়নের এই মডেলটি, ভবিষ্যতের ক্রমহ্রাসমান প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মেলাতে অক্ষম।
৭. ভিন্নমতাবলম্বীদের দমন এবং সেন্সরশীপের পরিধি বৃদ্ধি
অভ্যন্তরীণ সমালোচনা ও প্রতিবাদ কঠোরভাবে দমন করেছেন শি। যার মধ্য দিয়ে ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ ধ্বংস হয়ে গেছে; আর চীনের ভেতরে ক্রমবর্ধমান হারে সেন্সরশীপের “গ্রেট ফায়ারওয়াল” জোরদার হয়েছে।
৮. বিশ্বের বৃহত্তম সামরিক বাহিনী গড়ে উঠেছে, আধুনিক হয়েছে
শি-এর নেতৃত্বাধীন পিপল’স লিবারেশন আর্মি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সাথে নিজের ব্যবধান কমিয়ে আনছে। এমনকি গভীর সমুদ্রে অভিযান পরিচালনার সক্ষমতার ক্ষেত্রেও এমন কথা প্রযোজ্য। তাইওয়ানকে ঘিরে বিদ্যমান উত্তেজনার ক্ষেত্রে এটি দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু কর্মকর্তা সতর্ক করেছেন যে, তাইওয়ানকে দখল করে নেওয়ার সক্ষমতার ক্ষেত্রে চীন আরও দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে।
৯. পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি এবং পরিবেশ দূষণের নেতৃত্বে চীন
একদিকে চীন কয়লার উপর নিজেদের নির্ভরতা কমাতে হিমশিম খাচ্ছে। অপরদিকে, বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনে চীন বিশ্বজুড়ে নেতৃস্থানীয় অবস্থানে চলে এসেছে। এর মাধ্যমে ২০৬০ সাল নাগাদ কার্বন নিরপেক্ষ হওয়ার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের কাছাকাছি চলে আসছে বলে প্রশংসা কুড়িয়েছে। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হল যে, চীনে বায়ুর মান গত একদশক ধরে অব্যাহত ভাবে উন্নত হয়েছে।
১০. চরম দারিদ্র নির্মূল হয়েছে, বৈষম্য রয়ে গেছে
চীনে চরম দারিদ্র নির্মূলকে, শি গত দশকে কমিউনিস্ট পার্টির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জনগুলোর একটি হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
তবে, এর তুলনায় বৈষম্য আরও কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে; বিশেষ করে শহুরে ও গ্রামীণ আয়ের বৈষম্য। শি তার “অভিন্ন সমৃদ্ধি” নীতি দিয়ে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছেন।
চীনের সরকারিভাবে প্রকাশিত জিনি গুণাঙ্কের (জিনি কোএফিসিয়েন্ট) মান থেকে দেখা যায় যে, সাম্প্রতিক বছরে সামান্য হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও, বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি, চীন এখনও বৈষম্যের মাত্রা সবচেয়ে বেশি থাকা দেশগুলোর মধ্যে একটি।