অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

ডাউন সিনড্রোম: দরকার অধিক যত্ন ও ভালোবাসা


ডাউন সিনড্রোম এমন একটি জীনগত বৈশিষ্ট্য যার কারণে একটি শিশু বাড়তি ক্রোমোজম নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। (ছবি: অ্যাডোবি স্টক)
ডাউন সিনড্রোম এমন একটি জীনগত বৈশিষ্ট্য যার কারণে একটি শিশু বাড়তি ক্রোমোজম নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। (ছবি: অ্যাডোবি স্টক)

ফাহিমের বয়স প্রায় নয় বছর। ও সাধারণ শিশুদের মতো নয়। ফাহিম একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন যাকে বলা হয় ডাউন সিনড্রোম। পুরনো ঢাকার বাসিন্দা ফাহিম সূত্রাপুর এলাকার ‘আর্থ অব চিলড্রেনস স্কুল’-এর ছাত্র। এই স্কুলের ফাউন্ডার ও কোঅর্ডিনেটর শিক্ষিকা মাহমুদা বেগম পলি ফাহিমকে বাসায় গিয়ে শিক্ষাদান করেন। কারণ ফাহিমের এ্যাজমার সমস্যা থাকায় তাকে বাসা থেকে কম বের করা হয়। শিক্ষিকা মাহমুদা ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, "আমরা ফাহিমকে নিয়ে কাজ শুরু করবার আগে ওর পরিবার বুঝতে পারেনি যে ও ডাউন সিনড্রোম বেবি। আমি যখন ফাহিমকে পেয়েছি তখন ওর বয়স ছিলো ছয় বছর। সে সময় করোনার কারণে স্কুলগুলো বন্ধ ছিলো। তাই আমি ওকে বাসায় গিয়ে শিক্ষাদান ‍শুরু করি। সে সময় ওর কথা একদম অস্পষ্ট ছিলো। বয়সের তুলনায় ওর আচরণ দুই/তিন বছরের শিশুদের মতো ছিলো। লার্নিং প্রসেস ধীরগতির ছিলো। সবকিছু নিয়ে প্রচন্ড জেদ করতো। মা ছাড়া আর কারো হাতে খাবার খেতো না। তিনি খাওয়াতে না পারলে ফাহিম সারাদিন না খেয়েই থাকতো। তাই ওর মা ওকে রেখে কোথাও যেতে পারতেন না। নিজের হাতে কোনো কিছু খেতো না। ধীরে ধীরে অনেক কিছু শিখিয়েছি। এখন সে খাবার নিজের হাতে ধরে। আমার হাতে, ওর বড় দুই বোনের হাতে খাবার খায়। কমান্ড শোনে। লোকজনের সাথে কমিউনিকেট করছে। নিজের অনেক কাজ নিজেই করতে পারছে। আস্তে আস্তে ওর উন্নতি হচ্ছে।”

ডাউন সিনড্রোম কী?

ডাউন সিনড্রোম এমন একটি জীনগত বৈশিষ্ট্য যার কারণে একটি শিশু বাড়তি ক্রোমোজম নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে।

১৮৬৬ সালে ব্রিটিশ চিকিৎসক জন ল্যাঙ্গডন ডাউন এ বৈশিষ্ট্যের শিশুদের প্রথম চিহ্নিত করেন, তাই তার নামা অনুসারে নামকরণ করা হয় ডাউন সিনড্রোম। বিশ্বে প্রতি ৫০০ থেকে ৭০০ শিশুর মধ্যে একজন শিশু ডাউন সিনড্রোম শিশু হিসাবে জন্মগ্রহণ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বছর ৫০০০ বা প্রতিদিন প্রায় ১৫ জন ডাউন সিনড্রোম শিশুর জন্ম হয়। ডাউন সিনড্রোম (Down syndrome) সংক্ষেপে DS বা DNS নামে পরিচিত।

বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের চিকিৎসক ডা. মো. মেহেদী হাসান ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “আমাদের শরীরে ২৩ জোড়া ক্রোমোজম রয়েছে, অর্থাৎ ৪৬টি। এর মধ্যে ২৩টি আসে প্যাটার্নাল সাইড থেকে, ২৩টি ম্যাটার্নাল সাইড থেকে। ডাউন সিনড্রোমের ক্ষেত্রে ৪৭টি ক্রোমোজম থাকে। একটা বাড়তি ক্রোমোজম থাকে এবং সেটা ক্রোমোজম বিন্যাসের ২১তম পজিশনে থাকে। এ কারণে একে ট্রাইসোমি ২১ ও (Trisomy 21) বলা হয়ে থাকে অর্থাৎ ক্রোমোজমগুলো তো জোড়ায় জোড়ায় থাকে কিন্তু এক্ষেত্রে ২১তম জোড়ায় ৩টি ক্রোমোজম থাকে। ক্রোমোজম নির্ধারণ করে আমাদের শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ কেমন হবে। তার শারীরিক গ্রোথ কেমন হবে। ডাউন সিনড্রোম একটি জেনেটিক ডিজওর্ডার। যাদের এই সমস্যা আছে তাদের জন্মের আগে ও পরে বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। ডাউন সিনড্রোম আবার তিন ধরণের হয়ে থাকে। যেমন একটা বললাম, ট্রাইসোমি ২১। আর দুটি ধরণ হলো ট্রান্সলোকেশন ডাউন সিনড্রোম এবং মোজাইক ডাউন সিনড্রোম। তবে ডাউন সিনড্রোমের ৯৫ শতাংশ মানুষের মধ্যেই ট্রাইসোমি ২১ দেখা যায়।”

ডাউন সিনড্রোমের লক্ষণ ও জটিলতা

ডা. মেহেদী জানান, যদিও ডাউন সিনড্রোমের ব্যক্তিরা দেখতে প্রায় একই রকম হতে পারে, আচরণে মিল থাকতে পারে। তবে প্রত্যেক ব্যক্তির আলাদা আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। এদের সাধারণত আইকিউ মাঝারি থেকে নিচের স্তরের হয়ে থাকে। অন্য শিশুদের তুলনায় দেরিতে কথা শেখে। ডাউন সিনড্রোমের কিছু সাধারণ শারীরিক বৈশিষ্ট্য হলো, মুখমন্ডল খানিক চ্যাপ্টা, ছোট নাক, ছোট চোখ, ছোট ঘাড়, খাটো কান, হাত পায়ের তালু ও আঙ্গুল ছোট ছোট হয়ে থাকে। চোখের আইরিসে (রঙিন অংশ) ছোট সাদা দাগ থাকতে পারে। এরা কিছুটা স্থুল ও খর্বাকৃতির হয়। শরীরের মাংসপেশী খুব দুর্বল হয় তাই এ ধরণের শিশু নরম তুলতুলে হয়ে থাকে, যাকে ফ্লাপি বেবি বলে। অনেক ডাউন সিনড্রোম শিশু একাধিক শারীরিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা নিয়ে জন্ম নিতে পারে। যেমন: হৃদরোগ, অন্ত্রের অস্বাভাবিকতা, শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তির বৈকল্য, থা্ইরিয়েডের সমস্যা, কম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, রক্তজনিত অসুখ ইত্যাদি।

মায়েদের ক্ষেত্রে গর্ভকালীন ঝুঁকি

স্পিচ ল্যাংগুয়েজ প্যাথোলজিস্ট এবং অটিজম ব্যবস্থাপনার কনসালটেন্ট জয়া জানালেন, যদি বেশি বয়সে কিংবা তেত্রিশ বছর বয়সের পর নারী গর্ভধারণ করে তাহলে সন্তানের ডাউন সিনড্রোম হওয়ার ঝুঁকি থাকে। দ্বিতীয়ত হলো, নিকট আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ে হওয়া।

গর্ভাবস্থায় কিভাবে বোঝা যেতে পারে শিশু ডাউন সিনড্রোম হবে কি না এ প্রশ্নের উত্তরে ডা. মেহেদী বললেন, “আমরা আল্ট্রাসাউন্ডে (দেখি)... যদি বেবির ঘাড়ের পেছনে পানির মতো জমা আছে বা ফোলা আছে, ওই শিশুদের এ ধরণের জেনেটিক সমস্যা থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। তাছাড়া গর্ভাবস্থায় হরমোন লেভেল টেস্ট করেও সেটা যদি বেশি থাকে তাহলেও আমরা ডিটেক্ট করতে পারি যে বেবির ডাউন সিনড্রোম থাকতে পারে। সাধারণত গর্ভধারণের বিশ সপ্তাহের মধ্যে চিহ্নিত করা গেলে আমরা টার্মিনেট করতে পরামর্শ দেই।”

বিশ্ব ডাউন সিনড্রোম দিবস

২০০৬ সাল থেকে প্রতি বছর ২১ মার্চ বিশ্ব ডাউন সিনড্রোম দিবস পালন করা হয়। ২১ মার্চ দিবসটি পালন করার পেছনেও রয়েছে ডাউন সিনড্রোমের বৈশিষ্ট্য। ২১তম ক্রোমোজমের ট্রাইসোমি বোঝাতে বছরের তৃতীয় মাসের ২১তম দিনকে বেছে নেয়া হয়েছে। বিশ্ব ডাউন সিনড্রোম দিবসের এবারে প্রতিপাদ্য “With Us Not For Us.” বাংলা করলে দাঁড়ায়, “আমাদের জন্য নয়, আমাদের পাশে থাকো” । একটা সময়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দয়া ও করুণার পাত্র হিসেবে দেখা হতো। সময় এসেছে সে ধারণা থেকে বের হয়ে আসবার। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও আর সবার মতো নায্য অধিকার পাওয়ার, উন্নত জীবন যাপনের দাবীদার। তাই তাদের ভালো থাকার লড়াইয়ে আমাদের সামিল হতে হবে।

বাংলাদেশে ডাউন সিনড্রোম

২০১৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ ডাউন সিনড্রোম সোসাইটি’। সোসাইটির চেয়ারম্যান সরদার আব্দুর রাজ্জাক ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “বাংলাদেশ ডাউন সিনড্রোম সোসাইটির উদ্যোগে ২০১৪ সালের ২১ মার্চ বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ‘বিশ্ব ডাউন সিনড্রোম দিবস’ উদযাপন করা হয়। তখন এটি বিশ্বে ছিলো নবম বারের মতো। আমরা বাংলাদেশে সেবার প্রথমবার পালন করি। তারপর থেকে প্রতিবছর উদযাপন করছি। তবে এর সরকারি স্বীকৃতি পাওয়া যায় ২০১৬ সালে এসে। এখন সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে সারা দেশ জুড়েই দিবসটি পালন করা হয়। এবার আমরা উদযাপন করতে যাচ্ছি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে (UIU)। আমরা ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন ডিসঅর্ডার বিভাগের সঙ্গে। এখন আমরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে ইন্টারেস্টেড গ্রুপ তৈরি করতে চাচ্ছি। এ বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যত বেশি চর্চা হবে তত বেশি গবেষণা হবে। বাংলাদেশে এখনও ডাউন সিনড্রোম কমিউনিটি নিয়ে সেরকম কোনো গবেষণা নেই। UIU তে একটি ইনস্টিটিউট খোলা হয়েছে যেটা হলো Institute of Research, Innovation, Incubation and Commercialization (IRIIC)। আমরা এখানে কিছু গবেষণা শুরু হোক। সারা বিশ্বে ডাউন সিনড্রোম নিয়ে যে গবেষণা ও উন্নয়ন ঘটছে আমরা সেখান থেকে অনেক পিছিয়ে আছি। ”

বাংলাদেশে কতজন ডাউন সিনড্রম আছে এখনও তার পূর্ণাঙ্গ কোনো জরিপ নেই। এ বিষয়ে সরদার রাজ্জাক জানালেন, সরকারি পর্যায়ে জরিপ চলামান। এছাড়া গ্লোবাল পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি আটশত শিশুতে একজন শিশু ডাউন সিনড্রোম জন্মগ্রহণ করে। সেই হিসেবে প্রতি বছর বাংলাদেশে যদি বিশ লক্ষ শিশুর জন্ম হয়, তাহলে তারমধ্যে দুই থেকে আড়াই হাজার শিশু ডাউন সিনড্রোম।

তিনি আরো বলেন, “আরেকটি সমস্যা হলো কোনো শিশু ডাউন সিনড্রোম কিনা সেটা কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই প্রাথমিক স্টেজেই চিহ্নিত করতে পারছি না।” কেনো চিহ্নিত করা করা যাচ্ছে না, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “অনেক ক্ষেত্রে কমিউনিটি লেভেলের যে ডাক্তাররা ডেলিভারি করাচ্ছেন বা জন্ম নেয়ার পর শিশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছেন, তিনি বুঝতে পারেন না। অনেক সময় শিশুর মুখ দেখেও সে সময় বোঝা যায় না কিংবা ফেস ডিটেক্ট করবার মতো সক্ষমতা স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকে না। আবার এসব বাচ্চাদের কথাবার্তা, হাটাচলা সবই দেরীতে হয়। তো অনেক সময় অভিভাবকরা মনে করেন এমনিতেই দেরি হচ্ছে। কারণ সাধারণ শিশুদেরও এগুলো অনেক সময় দেরিতে হয়ে থাকে। এটিও দেরীতে চিহ্নিত হওয়ার একটি কারণ। এখন কিন্তু ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া বিভিন্ন কারণে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে। আমরা প্রতিদিনই নতুন বাবা-মায়েদের ফোনকল পাচ্ছি।

একজন ডাউন সিনড্রোম শিশুর পিতা

বাংলাদেশ ডাউন সিনড্রোম সোসাইটির চেয়ারম্যান সরদার আব্দুর রাজ্জাক নিজেও চৌদ্দ বছর বয়সের একজন ডাউন সিনড্রম শিশুর পিতা। তিনি নিজেকে একজন গর্বিত পিতা মনে করেন। ডাউন সিনড্রোম নিয়ে তাঁর এই বসবাস সম্পর্কে সরদার রাজ্জাক বললেন, “আমার তৃতীয় সন্তান রাফানের যখন জন্ম হয়, তখন আমি এই ডাউন সিনড্রোম শব্দটির সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না। ও জন্মানোর পর খুব ফ্লাপি, নরম, তুলতুলে ছিলো। তখন শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শে ক্রোমোজোমাল এনালাইসিস দেখার জন্য টেস্ট করা হয়। সেখানে দেখা গেলো ট্রাইসমিক ২১ লেখা যা ৯৫ শতাংশ ডাউন সিনড্রোমদের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। যেহেত বাংলাদেশে তখন এ বিষয়ে তেমন কোনো কাজ ছিলো না তাই ডাক্তারের পরামর্শে ইন্টারনেট ঘাঁটতে শুরু করি। তখন থেকেই আমার আর রাফানের মায়ের জার্নিটা শুরু হয়। জানার চেষ্টা শুরু করলাম। এভাবে একসময় অভিভাবকদের খুজে বের করে প্যারেন্টস সাপোর্ট ফোরাম করলাম। তো রাফানের ক্ষেত্রে শুরু থেকেই যেহেতু জেনেছিলাম তাই ওর বিষয়গুলো আমরা চর্চা করা শুরু করলাম। ফলে ওর স্পিচে কোনো ডিলে হয় নাই। এছাড়া ওর আর কোনো শারীরিক ত্রুটি ছিলো না যা অনেক ডাউন সিনড্রোম শিশুদের ক্ষেত্রেই থাকে।

ডাউন সিনড্রোম শিশুর শিক্ষা

হাসিবা হাসান বলেন, “ডাউন সিনড্রোম শিশুদের মানসিক বিকাশ তাদের বয়স অনুযায়ী হয় না। হয়তো একটি শিশুর বয়স পাঁচ কিন্তু তার বুদ্ধিবৃত্তিক বয়সটা এক-দুই বছরের মধ্যেই আটকে থাকে। বেশিরভাগ শিশুকে ভ্যোকেশনাল ও অন্যান্য কার্যক্রমে যুক্ত করা সম্ভব হয়। কথা বলে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করা, অন্যদের সাথে কমিউনিকেট করার ক্ষেত্রে ওরা পিছিয়ে থাকে। আইকিউ লেভেল কম থাকার কারণে ওদের মধ্যে জেদ, অস্থিরতা দেখা যায়। খুব কম শিশুই পড়াশোনা করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। সারা বিশ্বে খুব কম শিশুই দেখা গেছে, যারা পরবর্তী সময়ে উচ্চ শিক্ষা নিতে পেরেছে কিংবা তাদের বাবার বিজনেস দেখছে।”

শিক্ষিকা মাহমুদা বেগম পলি বললেন, “এ ধরণের শিশুদের লার্নিং প্রসেসটা হলো, ওদেরকে একদম প্রথম থেকে সবকিছু সঠিক ও স্বাভাবিকভাবে শেখাতে হবে। কারণ যা শেখানো হবে ও ঠিক সেটাই করবে। পরে যতই কারেকশন করে দেয়া হোক, ওরা একবার যেটা শেখে সেটাই বারবার করতে থাকে। অল্প বয়সেই যদি ডাউন সিনড্রোম শিশুদের শেখোনোর প্রক্রিয়াটি শুরু করা যায় তাহলে ওদের খুব তাড়াতাড়ি উন্নতি ঘটে।”

মাহমুদা জানান, তাদের স্কুলে এই মূহুর্তে ৩৫জন শিক্ষার্থী আছেন। তার মধ্যে ফাহিমসহ দুইজন শিক্ষার্থী ডাউন সিনড্রোম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। বাকিরা অটিজমে আক্রান্ত। স্কুলের কারিকুলামের মধ্যে আছে শিশুদের স্পিচ থেরাপি, তাদের বিভিন্ন সামাজিক আচরণ শেখানো, যেমন: সিটিং ম্যানার, ডাইনিং ম্যানার, টয়লেট ট্রেনিং, জামা কাপড় পরা ইত্যাদি। অর্থাৎ দৈনন্দিন জীবনের সকল স্বাভাবিক ও প্রয়োজনীয় কাজ তাদের শেখানো হয় যাতে তারা স্বাবলম্বী হতে পারে। অকুপেশনাল থেরাপি, ফিজিওথেরাপি, স্পিচ থেরাপি দেয়া হয়। যখন ওরা একটু স্বাভাবিক হয়ে আসে, আই কন্টাক্ট বাড়ে তখন ওরা লেখাপড়াও শিখতে পারে।

শুধুমাত্র ডাউন সিনড্রোমের বাচ্চাদের জন্য কোনো স্কুল নেই। অটিজমসহ অন্যান্য স্পেশাল শিশুদের স্কুলেই ডাউন সিনড্রোম শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম চলে। বেসরকারি পর্যায়ে বেশ কিছু স্কুল এখন ঢাকা শহরে রয়েছে তবে স্কুলগুলোর বাণিজ্যিক মনোভাবই বেশি মনে করেন হাসিবা হাসান । তিনি বললেন, “এদের অনেকেই সিআরপি (Centre for the Rehabilitation of the Paralyzed) থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে একটি সেন্টার খুলেছে। সেখানে যাদের প্রশিক্ষক হিসেবে নেয়া হচ্ছে তাদেরকে নিজেরাই ট্রেইন করে তাদের দিয়ে কাজগুলো করাচ্ছে। স্পেশাল শিশুদের শিক্ষকদের বিএসএড, এমএসএড করা থাকা উচিৎ বলে আমি মনে করি। এ কাজের জন্য যে ধৈর্য্য, যে মানসিকতা প্রয়োজন তার জন্য এ ধরণের ট্রেনিংগুলো করে তারপরেই পেশায় আসা প্রয়োজন।”

সরদার রাজ্জাক মনে করেন, “শুধু ডাউন সিনড্রোমের শিশুদের জন্য স্কুলের ব্যবস্থা করাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং। কারণ বিশেষ শিশুদের স্কুলগুলো কিন্তু অটিজম, ডাউন সিনড্রোম, ইনটালেকচুয়াল ডিজঅর্ডার, এরকম সকলকে নিয়েই হয়েছে। তাই আলাদা করে এখনো ডাউন সিনড্রোমের জন্য স্কুল নেই। তাছাড়া ওদের থেরাপিগুলো, কাউন্সিলিংগুলোর মধ্যে মিল রয়েছে।”

যত্ন ও পরিবারের চিত্র

এ শিশুদের যত্ন ও চিকিৎসা সম্পর্কে ডা. মেহেদী বলেন, “ডাউন সিনড্রোম শিশু যেহেতু কয়েক ধরণের শারীরিক সমস্যা নিয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারে তাই তাদের ক্ষেত্রে জন্মের পর থেকেই নার্সিং অত্যন্ত জরুরী। যদি কার্ডিও সমস্যা থাকে তাহলে কার্ডিওলজিস্টের আন্ডারে চিকিৎসা করাতে হবে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকতে পারে। এসব ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তাছাড়া তাদের মেন্টাল ডেভেলপমেন্ট, মেমোরি ডেভেলমেন্টের জন্য সাইকোলজিস্ট দেখাতে হতে পারে। এখন সরকারি হাসপাতালগুলোতে শিশু বিকাশ কেন্দ্র রয়েছে, সেখানে তাদের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নেয়া হয়। মোট কথা, যত্নটা যত বেশি হবে তত দ্রুতই তারা অনেকটাই স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে। ডাউন সিনড্রোম ব্যক্তিদের জীবনকাল সাধারণত পঁয়ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত হয়ে থাকে।”

হাসিবা হাসানের মতে, “বাবা-মায়ের কাউন্সিলিংটা খুব জরুরী। কারণ অনেক শিশুর বাবা-মা শিশুর ডাউন সিনড্রোম হয়ে জন্ম নেয়াটাকে মেনে নিতে পারে না। তারা তাদের অন্য স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের শিশুদের সঙ্গে এ সন্তানদের তুলনা করেন।” তিনি বলেন, “আমার কাছে যেসব বাবা-মায়েরা শিশুদের নিয়ে আসেন তাদের আমরা স্পিচ ল্যাংগুয়েজ প্যাথোলজি, বাচ্চার ধরণ অনুযায়ী অকুপেশন থেরাপি দিয়ে থাকি। বাচ্চার বেশি এ্যাংগারনেস থাকলে নিউরোর ডাক্তারের কাছে পাঠাই। অনেকেই আছেন যারা বাচ্চাদের বিভিন্ন টেস্ট করাতে বললে, সেগুলো করাতে চান না। শিশুটির সমস্যাকে সামনে আনতেই তারা ভয় পান। সেসব ক্ষেত্রেও শিশুর বাবা-মাকে অনেক কাউন্সিলিং করতে হয়। দেখা যায়, পরিবারে দুটি কিংবা তিনটি শিশু রয়েছে। তারমধ্যে যে শিশুটি ডাউন সিনড্রোম সে শিশুটির জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সময় থাকে না। দেখা যাচ্ছে, সে শিশুটির জন্য বাসার গাড়িটা অ্যাভেইলেবল না, তাই তাকে স্কুলে পাঠানো হচ্ছে না। কিংবা তার চিকিৎসা ব্যয়ের বরাদ্দ কম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই অবহেলাগুলোই হয়। ”

শিক্ষিকা মাহমুদাও মনে করেন, এ ধরণের শিশুদের আসলে অনেক বেশি নার্সিং, অনেক বেশি যত্ন প্রয়োজন। তিনি বলেন, “সবার আগে প্রয়োজন অভিভাবকদের সচেতনতা তৈরি। আমরা তাই প্রতিমাসে একটি প্যারেন্ট কাউন্সিলিং মিটিংয়ের ব্যবস্থা করি। আমরা কাজ করতে গিয়ে এমন অনেক শিশুদের পেয়েছি, যাদের পরিবার তাদেরকে বাসা থেকেই বের করে না, প্রকাশই করে না যে তাদের এমন একটি সন্তান রয়েছে। যার ফলে এদের স্কুলিংও হয়নি। বয়স বেড়ে গিয়েছে। আমরা যখন ২০১৮ সালে এই স্কুলটা শুরু করি তখন সেটা পুরনো ঢাকার আরমানিটোলায় ছিলো। সেই এলাকায় আমি তিন/চার জন ডাউন সিনড্রোম বেবির পরিবার পেয়েছি। আমি সেই পরিবারগুলোকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি। ওদেরকে আমাদের সাথে যুক্ত করেন, আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। একটু স্বাভাবিক জীবন যাপনে আসবে। কথা ক্লিয়ার হবে। কিন্তু ওইসব মা’দের দেখেছি, ওদের যে এরকম একজন সন্তান আছে সেটা তারা প্রকাশই করতে চায় না। তাদের অন্য সন্তানরা হয়তো আমাদের মতো সাধারণ, স্বাভাবিক পড়াশোনা করছে। বাবা-মায়েরা সেইসব সন্তানদের নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। বাসার সহযোগী, দাদু-নানু এরাই সেই পরিবারের ডাউন সিনড্রোম শিশুদের যত্ন নিচ্ছেন। এখন এই অবস্থার অনেকটাই পরিবর্তন ঘটছে। যেমন, এখন আমাদের স্কুলে ফাহিম ছাড়াও আরো যে ডাউন সিনড্রোম শিশুটি রয়েছে, ওর পরিবার বেশ এ্যাকটিভ। বিশেষ করে শিশুটির অনার্স পড়ুয়া বোন তার এই ভাইটির প্রতি বিশেষ যত্নশীল। তো মনে হচ্ছে, এখন বাবা-মায়েরা এগিয়ে আসছেন। তারা বুঝতে পারছেন, এমন শিশুকেও প্রোপার টেক কেয়ার করলে, গ্রুমিং করলে ওরা কারো বোঝা হয়ে বাঁচে না, স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে।”

সরদার রাজ্জাক মনে করেন, এদের উন্নয়ন ও স্বাভাবিক জীবন যাপনে নিয়ে আসার জন্য অভিভাবকেরই সবচেয়ে বেশি উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। সে কারণে তারা ২০১০ সালে প্যারেন্টস সাপোর্ট গ্রুপ তৈরি করেছেন। এছাড়া ডাউন সিনড্রোম সিবলিং গ্রুপও খোলা হয়েছে।

ডাউন সিনড্রোম শিশুর পছন্দের কাজ

হাসিবা হাসান বললেন, “এসব শিশুরা খুব নাচতে পছন্দ করে, গাইতে পছন্দ করে। এদের মধ্যে কিছু শিশুর খাবারে প্রচন্ড অনীহা থাকে আবার কিছু শিশু প্রচন্ড খেতে পছন্দ করে। বাংলাদেশ ডাউন সিনড্রোম সোসাইটি, ডাউন সিনড্রোম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, প্যারেন্টস ফোরাম আছে। এইসব সংগঠনগুলো ডাউন সিনড্রোম শিশুদের এ ধরণের বিকাশ নিয়ে কাজ করে।” শিক্ষিকা মাহমুদা বললেন ফাহিমের পছন্দের কথা। ফাহিম সাদিন খেলনা নিয়ে খেলতে পছন্দ করে আর মিউজিক ভীষণ পছন্দ করে। মাহমুদা বলেন, “আমাদের জাতীয় সংগীত ফাহিমের ভীষণ পছন্দ। প্রথম দুই লাইন শুনে গানের সাথে সাথে ও বলে ‘ভালোবাসি’।"

সরদার রাজ্জাক বলেন, “একাডেমিক পড়াশোনার চাইতে ভিন্ন কিছু তাদের খুব পছন্দ। যেমন, আমি আমার ছেলে রাফানের কথা বলি। ওকে বইয়ের পাতায় যদি কোনো কিছু পড়তে বলি, সেটা সে পড়তে চায়না। কিন্তু আমি যদি সেই বিষয়টাই ল্যাপটপের সাহায্য নিয়ে পাওয়ার পয়েন্টে স্লাইড শো বানিয়ে দেখাই সে কিন্ত সেটাকে খুব আনন্দের সাথে নিচ্ছে। নিজেই নানান কিছু ছবি তৈরি করে শিখছে। আমাদের অনুষ্ঠানগুলোতে মূল আকর্ষণ থাকে ডাউন শিশুদের পারফরমেন্স। আমাদের ফোরামের শিশুদের ডাউন সিনড্রোম ডান্স গ্রুপ আছে। রাফান ভীষন নাচতে পছন্দ করে। ওর ডান্স পার্টনার আছে, ওরা স্টেজ পারফর্ম করে থাকে। আমরা এখন সাধারণ শিশুদের সাথে ওদের গ্রুপটাকে ইনক্লুসিভ পর্যায়ে নিতে চাচ্ছি।”

ডাউন সিনড্রোমদের দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবন যাপন

সরদার রাজ্জাক মনে করেন এখন ডাউন সিনড্রোমদের বৈবাহিক জীবন নিয়ে ভাবনা চিন্তা করা জরুরী হয়ে পড়েছে। এগুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াতে অনেক চমৎকার কিছু রিসার্চ হয়েছে। এবং বিভিন্ন দেশে এ বৈশিষ্ট্যের মানুষ বিয়ে করছে, দাম্পত্য জীবন যাপন করছে। আমাদের দেশে তো এখনও এমন কোনো রিসার্চ হয়নি। ওইসব দেশের গবেষণার ফলাফল থেকে জানা যায়, ডাউন সিনড্রোম ও নন ডাউন সিনড্রোম জুটি সন্তান নিতে পারে। সে ক্ষেত্রে সন্তানের ডাউন সিনড্রোম হওয়ার ঝুঁকি থাকে পঞ্চাশ শতাংশ অর্থাৎ ফিফটি ফিফটি চান্স থাকে। আবার দুজন ডাউন সিনড্রোম জুটির ক্ষেত্রে এই সম্ভাবনা হয়ে যায় নব্বই শতাংশের বেশি। যেমন আমেরিকায় বিখ্যাত ‘মনিকা ও ডেভিড দম্পতি’ রয়েছেন। আমাদের দেশে আমরা দু-একটি কেস এমন পেয়েছি। বরগুনার পাথরঘাটায় একজন নারী, যিনি নিজে ডাউন সিনড্রোম। স্বামী স্বাভাবিক এবং তাদের দুটো সন্তান আছে, তারাও স্বাভাবিক।"

XS
SM
MD
LG