অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

ভারতের স্বাধীনতা দিবসে জাতির উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ: মূল বক্তব্যে আগামী নির্বাচন, ৬জি পরিষেবা, মূল্যবৃদ্ধি, ইন্ডিয়া জোট, নতুন যোজনা


ভারতের স্বাধীনতা দিবসে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ১৫ আগস্ট, ২০২৩।
ভারতের স্বাধীনতা দিবসে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ১৫ আগস্ট, ২০২৩।

আগামী লোকসভা নির্বাচনে জয়ের পরোক্ষ বার্তা

ভারতের স্বাধীনতা দিবসের দিন রাজধানী দিল্লির লালকেল্লার বক্তৃতায় দেশের মানুষকে সরকারের সরকারের সাফল্য ও ভবিষ্যৎ কর্মসূচি জানান দেওয়া বহুদিনের রীতি।

আগামী ২০২৪-এ ভারতে লোকসভা ভোটের আগে মঙ্গলবার ভারতের ৭৬তম স্বাধীনতা দিবসে রাজধানী দিল্লির লালকেল্লা থেকে জাতির উদ্দেশে বক্তৃতা দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এই বক্তৃতাতেই প্রত্যয়ের সঙ্গে জানিয়ে গেলেন, আগামী বছর ফের এই লালকেল্লায় তিনি বক্তৃতা দিতে আসবেন। দেশের মানুষের আশা, আকাঙ্ক্ষা, সাফল্য, উন্নয়নের কথা ফের তুলে ধরবেন তিনি। তার বক্তৃতায় স্পষ্ট বোঝাতে চাইলেন, আসন্ন লোকসভা ভোটে ফের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে চলেছে তার দল। ফের সরকার গড়তে চলেছে এনডিএ।

তার কথায়, “২০১৪ সালে পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলাম। রিফর্ম, পারফর্ম, ট্রান্সফর্মের মাধ্যমে সেই প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাসে বদলে দিয়েছি। কঠোর পরিশ্রম করেছি। দেশের জন্য করেছি। জীবনপণ করে তা করেছি। আগামী বছর ১৫ অগস্টের দিন, দেশের সাফল্য, আপনাদের সামর্থ্য ও উন্নতির কথা বলতে ফের এই লালকেল্লায় আসব।”

মোদী বলেন, “আমি আপনাদের জন্য বাঁচি। আমার যদি স্বপ্ন আসে, তাহলে সেই স্বপ্ন আসে শুধু আপনাদের জন্য। আমার যদি ঘাম হয়, তাহলে আপনাদের জন্য হয়। কারণ, আপনারাই আমার পরিবার। আমি আপনাদের পরিবারের শরিক বলেই আপনাদের জন্য লড়াইয়ের জন্য সঙ্কল্পবদ্ধ।”

জাতির উদ্দেশে বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী এদিন বলেন, “২০৪৭ সালে দেশের স্বাধীনতার ১০০ বছর পূর্ণ হবে। এটা অমৃতকাল। এই কালখণ্ডের সবচেয়ে সোনালি সময় হল আগামী পাঁচ বছর। তাই আগামী পাঁচ বছর খেয়াল রাখতে হবে যে আমাদের সামান্যতম যেন ভুল না হয়। মনে রাখতে হবে যে, দেশের জন্য সবচেয়ে অশুভ হল তিনটি বিষয়— দুর্নীতি, পরিবারতন্ত্র ও তুষ্টিকরণ। এই তিন অশুভ শক্তির বিরুদ্ধেই আমাদের লড়তে হবে।”

তিনি বলেন, ২০১৪ ও ২০১৯ সালে দেশে স্থির ও স্থায়ী সরকার গঠনের পক্ষে মানুষ ভোট দিয়েছিল। তার আগের তিন দশক ছিল অস্থির সময়। সেই সময় ছিল অনিশ্চয়তায় ভরা। কিন্তু দেশে স্থায়ী সরকার গঠনের পর উত্তোরোত্তর অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কথায়, “মোদী আপনাদের কথা দিচ্ছে, পাঁচ বছরের মধ্যে বিশ্বের তিন বৃহৎ অর্থনীতির মধ্যে অন্যতম হবে ভারত।”

মোদী আরও বলেন, “আমি গত দশ বছরের হিসাব তিরঙ্গাকে সাক্ষী রেখে লালকেল্লা থেকে দিতে চাই। আপনাদেরও মনে হবে এত বড় বদল? এত সামর্থ্য! আগে কেন্দ্র থেকে রাজ্যগুলির কাছে ৩০ লক্ষ কোটি টাকা যেত। গত ৯ বছরে তা বেড়ে ১০০ লক্ষ কোটি টাকা হয়েছে। আগে স্থানীয় প্রশাসনের উন্নয়নের জন্য কেন্দ্র থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকা যেত, এখন ৩ লক্ষ কোটি টাকা যায়। আগে গরিবের ঘর বানানোর জন্য ৯০ হাজার কোটি টাকা খরচ হত এখন চার লাখ কোটি টাকা খরচ হয়।”

দেশে ৬জি পরিষেবা শুরু করার আশ্বাস

৪জি পেরিয়ে এখন ভারতবর্ষ আস্তে আস্তে ৫জি পরিষেবার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। তারমধ্যেই ৬জি পরিষেবা নিয়ে দেশবাসীকে আশার আলো দেখালেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। জাতির উদ্দেশে তার ভাষণে একাধিক বিষয়ের পাশাপাশি উঠে আসে ‘৬জি পরিষেবা’ প্রসঙ্গও।

ভারতবর্ষের প্রায় বেশিরভাগ জায়গাতেই পৌঁছে গেছে ৫জি পরিষেবা। সেই পরিষেবায় অভ্যস্থ হতে শুরু করেছে ভারতবাসী। তারমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী এদিন লালকেল্লা থেকে বলেন, "ভারতবর্ষ ৬জি পরিষেবার জন্য প্রস্তুত। শিগগির ভারত ৬জি জগতে প্রবেশ করবে।"

ভারত যে ৬জি পরিষেবায় পথ প্রদর্শক হতে চলেছে সেকথা আগেই জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সেই নিয়ে যে প্রস্তুতি চলছে তার আভাসও দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় টেলিকম মন্ত্রী। দেশের ৭৭তম স্বাধীনতা দিবসে মোদীর ভাষণে প্রায় অনেকটা অংশ জুড়েই ছিল ৬জি পরিষেবার প্রসঙ্গ। তিনি বলেন, "৬জি-র জন্য একটি টাস্ক ফোর্স তৈরি করা হয়েছে।"

এখানেই থেমে থাকেননি মোদী। ইন্টারনেট জগতে কীভাবে ভারত দ্রুত গতিতে বিবর্তন ঘটিয়েছে সেই কথাও তুলে ধরেন মোদী। তিনি বলেন, ‘"ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। সময়ের আগেই ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ৫জি পরিষেবা পৌঁছে গেছে। এখন অপেক্ষা ৬জি-র।"

ভারতে মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী আন্তর্জাতিক কারণ

সোমবার ১৪ অগাস্ট, ভারতের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান মন্ত্রক জানিয়েছিল যে দেশে মুদ্রাস্ফীতির সর্বশেষ হার এখন ৭.৪৪ শতাংশ। খাবার তথা খাদ্য পণ্যের দাম এক ধাক্কা লাফিয়ে বেড়েছে। তার ফলে জুন মাসের তুলনায় জুলাই মাসে মুদ্রাস্ফীতির হার বেড়ে গিয়েছে ৫২ শতাংশেরও বেশি।

স্বাধীনতা দিবসে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে দেশে মূল্যবৃদ্ধি পরিস্থিতির জন্য আন্তর্জাতিক কারণকেই দায়ী করলেন মোদী। প্রধানমন্ত্রী এদিন বলেন, “করোনা একপ্রস্থ ধাক্কা দিয়েছে। এখন যুদ্ধের কারণে মন্দা ও মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে ভুগছে বিশ্ব। আমাদের দুর্ভাগ্য যে মূল্যবৃদ্ধিও আমদানি করতে হচ্ছে”।

তার কথায়, “ভারত মূল্যবৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য খুব চেষ্টা করেছে। গত সরকারের আমলে যে মূল্যবৃদ্ধি পরিস্থিতি ছিল তার চেয়ে এখন ভাল অবস্থা। গোটা বিশ্বের তুলনায় ভারতে পরিস্থিতি ভাল। কিন্তু এতেই আমরা সন্তুষ্ট থাকতে পারি না। আমাদের আরও চেষ্টা করে যেতে হবে।”

কটাক্ষ বিরোধীদের ইন্ডিয়া জোটের শরিকদের

দশ বছর টানা সরকার চালানোর পর এই প্রথম সমষ্টিগত বিরোধিতার মুখে পড়েছে কেন্দ্রে বিজেপি সরকার। কংগ্রেস, তৃণমূল সহ ২৬টি বিরোধী দলের জোট ইন্ডিয়া তৈরি হয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে ইন্ডিয়া জোটকে বিঁধতে স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে মুখ্যত তিনটি বিষয়কে আক্রমণে সূচিমুখ করে নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

এই বক্তৃতায় তিনি বলেন, “দেশের জন্য তিনটি বিষয় সবচেয়ে অশুভ। দুর্নীতি, পরিবারতন্ত্র ও তোষণের রাজনীতি। এই তুষ্টিকরণ দেশের চরিত্রে দাগ লাগিয়ে দিয়েছে। এই তোষণ হত্যা করেছে সামাজিক ন্যায়বিচারকে।”

প্রধানমন্ত্রীর কথায়, “দেশে অমৃতকাল চলছে। এই কালখণ্ডে আগামী পাঁচ বছর হল সবচেয়ে সোনালি সময়। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে সামান্যতম ভুল যেন না হয়।” এ কথা বলেই মোদী বলেন, "দেশের রাজনীতিতে এখন অদ্ভূত একটা বিকৃতি এসেছে। পরিবারতন্ত্র দেশের রাজনীতিকে গ্রাস করতে চাইছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে এরা নিজের পরিবারের ভাল ছাড়া আর কিছু বোঝে না। এরা দেশের মানুষের সুযোগ সুবিধা সব তাদের পরিবারের জন্য কেড়ে নিতে চায়।"

দেশে আসছে বিশ্বকর্মা যোজনা

২০১৪ সালে ক্ষমতা আসার পর থেকে একাধিক জনকল্যাণমূলক প্রকল্প চালু করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এবছর স্বাধীনতা দিবসের দিনে লালকেল্লা থেকে প্রধানমন্ত্রী বললেন, তার পরবর্তী প্রকল্প হল বিশ্বকর্মা যোজনা। পিছিয়ে পড়া ও অনগ্রসর শ্রেণির মানুষজনের সুবিধার্থে এই প্রকল্পের সূচনা করতে চলেছেন তিনি।

এদিন লালকেল্লা থেকে মোদী তার ভাষণে বলেছেন, স্বর্ণকার, নাপিত, তাঁতি, সুতার, রাজমিস্ত্রি, ধোপার মতো বংশ পরম্পরায় চলে আসা পেশাগুলির জন্য বিশ্বকর্মা যোজনা শুরু করা হবে। প্রায় ১৩ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা দিয়ে ওই প্রকল্প শুরু হবে। তবে ঠিক কী প্রকল্প তিনি শুরু করতে চলেছেন সে বিষয়ে অবশ্য এখনই বিশদে কিছু বলেননি প্রধানমন্ত্রী।

স্বাধীনতার ১০০ বছরে ২০৪৭ সালের মধ্যে ভারতকে উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলছে কেন্দ্র।প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বক্তব্য, পরিকাঠামো এখন অর্থনীতির চালিকাশক্তি। তার গতি আরও বাড়াতে হবে। মোদী বলেছেন, "দেশের কোণায় কোণায় কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। পাঁচ বছরের মেয়াদে সাড়ে ১৩ কোটি গরিব ভাইবোন দারিদ্র থেকে বেরিয়ে এসে নিউ মিডল ক্লাসে উত্তীর্ণ হয়েছে।"

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, আগামী পাঁচ বছরে দেশ পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী তিনটি অর্থনীতির মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠবে।

XS
SM
MD
LG