অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

শীতকালে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ৭০ শতাংশ নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে


প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

আগামী শীতে, বাংলাদেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার দুই-তৃতীয়াংশ নিষ্ক্রিয় থাকবে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তারা এর কারণ হিসেবে বলছেন, বেসরকারি খাত থেকে জাতীয় গ্রিডে আরো বিদ্যুৎ যুক্ত হচ্ছে; যা সরকার-এর ক্যাপাসিটি পেমেন্টর বাধ্যবাধকতা বাড়িয়ে তুলবে। ইতোমধ্যেই সরকারের বকেয়া বিলের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে৩৫০ কোটি ডলার। এমন পরিস্থিতিতে উৎপাদন হ্রাসের দিকে যেতে হতে পারে কর্তৃপক্ষের।

বিদ্যুৎ বিভাগ সম্পর্কিত সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, চলতি বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অফ-গ্রিড নবায়নযোগ্য এবং ক্যাপটিভ পাওয়ার-সহ বাংলাদেশের দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিলো ২৭ হাজার ৮৩৪ মেগাওয়াট। আর, দৈনিক সর্বোচ্চ উৎপাদন রেকর্ড রয়েছে ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট পর্যন্ত।

বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (বিপিডিবি)-এর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে গত ২৬ সেপ্টেম্বর ১৪ হাজার ২১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। এর ফলে, লোডশেডিং করতে হয়েছে ১১৩ মেগাওয়াট। এর অর্থ হলো, অর্ধেক বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার করা হয়েছে; আর, অনিবার্যভাবেই লোডশেডিং করতে হয়েছে। উল্লেখ্য, গত শীতে চাহিদা কমে, বিদ্যুতের উৎপাদন ১০ হাজার মেগাওয়াটের নিচে নেমে আসে।

বিদ্যুৎ শিল্পের অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিদের মতে, আগামী শীতে উদ্বৃত্ত বিদ্যুতের পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে এবং আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে জাতীয় গ্রিডে আরো বেশি বিদ্যুৎ আসবে। এতে, স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা ৩০ হাজার মেগাওয়াট অতিক্রম করতে পারে; যার ফলে, উদ্বৃত্ত বিদ্যুতের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে, শীত মৌসুমে সাধারণত প্রায় ৭০ শতাংশের মতো চাহিদা কমে যায়। অথাৎ, ক্যাপাসিটি পেমেন্টর বাধ্যবাধকতা আরো বাড়বে।

বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপের বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেঘনাঘাট-এর রিলায়েন্স পাওয়ার এলএনজি ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এলএনজি ভিত্তিক জিই-সামিট মেঘনাঘাট-২ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এবং মেঘনাঘাটের এলএনজিভিত্তিক ইউনিক গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্র। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্পনসররা সরকারকে রাজি করানোর জন্য কঠোর পরিশ্রম করছেন, যাতে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের প্ল্যান্ট চালু করার অনুমতি দেয়া। এগুলো উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত হলেও, গ্যাস সংকটের কারণে সেগুলো চালু করতে দেয়া হচ্ছে না।

এদিকে, আদানি গ্রুপের ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট কয়লা-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিট এবং রামপাল পাওয়ার প্ল্যান্ট এর দ্বিতীয় ইউনিট থেকে ৬২০ মেগাওয়াট সহ সম্প্রতি সম্পন্ন হওয়া কিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে আরো বিদ্যুৎ ইতোমধ্যেই গ্রিডে এসেছে।

বিপিডিবি রেকর্ড অনুযায়ী, ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বরে উৎপাদন রেকর্ডকরা হয়েছিলো ৯ হাজার ১৩৪ মেগাওয়াট। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চাহিদা দ্রুত গতিতে না বাড়ায় আগামী শীতে উৎপাদন ১০ হাজার মেগাওয়াটের নিচে থাকবে।

বিপিডিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যদিও ৭০ শতাংশ বিদ্যুত কেন্দ্র নিষ্ক্রিয় থাকবে, তবুও সরকারের সঙ্গে তাদের চুক্তি অনুযায়ী বিনিয়োগকারীরা ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে তাদের পেমেন্ট পাবেন।

বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যেই বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকদের পাওনা পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে।বিদ্যুত বিভাগ এবং বিপিডিবি-র কর্মকর্তারা বলেছেন যে বর্তমানে, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) -এর মোট পাওনা ৩৫০ কোটি ডলার (৩৫ হাজার কোটি টাকার সমতুল্য)।

সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, আইপিপি কোম্পানিগুলো তাদের বিল নিয়ে দ্বৈত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। প্রথমত, তারা সময়মতো বিল পাচ্ছেন না এবং দ্বিতীয়ত, তারা আংশিক বিল পাচ্ছেন। আর, ডলার সংকটের কারণে, যে অর্থ পাচ্ছেন, সে অর্থও বৈদেশিক মুদ্রায় রূপান্তর করতে পারছেন না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিডিব’র একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, তারা অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছেছেন; কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বিপিডিবি-কে তার খরচ মেটাতে প্রতিদিন গড়ে দুই কোটি ডলার দেবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিপিডিবি’র আরেক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, “তবে আমরা প্রতিদিন এক কোটি থেকে দেড় কোটি ডলারের বেশি পাচ্ছি না।’

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশের বিদ্যুৎ খাত সমস্যার দিকে ঝুঁকছে এবং এটি মূল্যস্ফীতি আরো বাড়ায়, সামগ্রিক অর্থনীতিতে এটি বড় প্রভাব ফেলবে। বিশিষ্ট জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (ক্যাব) উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, “গ্রীষ্মকালে ৫০ শতাংশ এবং শীতকালে ৭০ শতাংশ বিদ্যুত উদ্বৃত্ত থাকলে দেশ এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হবে।”

তিনি বলেন, “বিদ্যুৎ খাতে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। কারণ বেসরকারি খাতের ক্যাপাসিটি পেমেন্টের চাপ বাড়তে থাকবে এবং প্রাথমিক জ্বালানি আমদানি বাড়বে। পরিশেষে, এটি জ্বালানি নিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দেবে।”

অধ্যাপক এম শামসুল আলম আরো বলেন, “এ অবস্থায় মুক্তির একমাত্র উপায় হচ্ছে সরকারকে প্রথমে স্বীকার করতে হবে, চাহিদা বিবেচনা না করেই বেসরকারি খাতকে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনুমতি দিয়ে ভুল করেছে। তারপর, বর্তমান নীতি ও কৌশল পরিবর্তন করতে হবে।

“এদিকে, আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর জন্য ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের চাপ আসছে। এতে পরিস্থিতি সামলানো আরো কঠিন হবে। আর, যদি নীতি ও কৌশল পরিবর্তন করা না হয়, তাহলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে;” উল্লেখ করেন অধ্যাপক এম শামসুল আলম।

XS
SM
MD
LG