অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

বাংলাদেশের বেসরকারি বাস পরিবহনের মালিক-শ্রমিক সংগঠন সরকারের চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান: টিআইবি


ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

বাংলাদেশের বেসরকারি বাস পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিক সংগঠন সরকারের চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান। ‘ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস পরিবহন ব্যবসায় শুদ্ধাচার’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

মঙ্গলবার (৫ মার্চ) ঢাকার ধানমন্ডিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, গবেষণালব্ধ তথ্য অনুযায়ী, বাস কোম্পানির প্রায় ৯২ শতাংশের মালিক ও পরিচালনা পর্ষদের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে, ৮০ শতাংশ ক্ষমতাসীন দল ও বাকি ১২ শতাংশ অন্য দলের। এর ফলে এই জনগুরুত্বপূর্ণ খাতটি যাত্রীবান্ধব গণপরিবহন হয়ে উঠবে এমন প্রত্যাশা থাকলেও, বাস্তবে তা জিম্মি হয়ে গেছে এসব মালিক শ্রমিকদের সংগঠনের কাছে। আর এই জিম্মিদশার সুযোগ নিয়ে অনৈতিক সুবিধা ভোগ করছে সিন্ডিকেট। এই জিম্মি দশা এতটাই প্রকট যে মালিক-শ্রমিকের আতাতের কারণে তাদের আচরণ অবস্থাদৃষ্টে সরকারের চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান হিসেবে মনে হয়।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস পরিবহন খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে সরকার তার নিজের প্রণীত আইন ও নিয়মনীতি বাস্তবায়নে সফল হচ্ছে না। প্রত্যাশিত সেবাও নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না, একইসঙ্গে এ খাতের সাধারণ শ্রমিকেরাও তাদের মৌলিক অধিকারসহ ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

পরিবহন খাতের সংশ্লিষ্টদের ভূমিকার সমালোচনা করে তিনি বলেন, “বাস পরিবহন ব্যবসায় বিভিন্ন আঙ্গিকে চাঁদাবাজি ও অবৈধ লেনদেনের ঘটনা ঘটে। এ সকল ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন, হাইওয়ে পুলিশ, মালিক-শ্রমিক সংগঠনের যোগসাজস রয়েছে। বিআরটিএ তার নির্ধারিত ভূমিকা পালন করতে স্পষ্টতই ব্যর্থ হয়েছে। যাত্রী সেবার ব্যর্থতা ঢাকতে লোকবল সংকটকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। বিআরটিএর অনিয়ম-দুর্নীতি ও অবৈধ লেনদেনের সবই চলছে যোগসাজশের মাধ্যমে। অবস্থা প্রকটতর হয়ে ওঠার কারণ হচ্ছে, এই দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থনৈতিক লাভের অংশীদার কম-বেশি সংশ্লিষ্ট সকলে। এ খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সকলকে বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে আহ্বান জানাই আমরা। কারণ, দুর্নীতি অনিয়ন্ত্রিত থাকলে তা আরও বিকশিত হয়।”

গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বছরে প্রায় ১ হাজার ৬০ কোটি টাকা চাঁদা বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ হিসেবে দিতে বাধ্য হন বাস মালিক ও কর্মী/শ্রমিকেরা। এর মধ্যে প্রায় ২৫ কোটি টাকা দলীয় পরিচয়ে সড়কে চাঁদাবাজি হয় বলে উঠে এসেছে গবেষণায়। এ ছাড়া, রাজনৈতিক সমাবেশ, বিভিন্ন দিবস পালন, টার্মিনালের বাইরে (রাস্তায়) পার্কিং এবং সড়কের বিভিন্ন স্থানে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন ও ‘টোকেন বাণিজ্যে’র জন্য বাস মালিক ও কর্মী/শ্রমিকেরা চাঁদা বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দেয় বা দিতে বাধ্য হয় বাস মালিক। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বড়ো অংশ হলো নিবন্ধন ও সনদ গ্রহণ ও হালনাগাদ বাবদ ঘুষ, বাস মালিক-শ্রমিকদের বিআরটিএকে বছরে ঘুষ দিতে হয় ৯০০ কোটি টাকার বেশি।

বাস পরিবহন খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির মহোৎসবের কেন্দ্রে রয়েছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্য ও সমর্থনপুষ্টদের মাধ্যমে পরিবহন ব্যবসা নিয়ন্ত্রিত হওয়া। মালিক সংগঠনের নেতাদের অধিকাংশ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। জরিপে অংশগ্রহণকারী ২২টি (১৩ দশমিক ১ শতাংশ) কোম্পানির কাছে ৮১ দশমিক ৪ শতাংশ বাসের মালিকানা রয়েছে এবং এ সব বৃহৎ বাস কোম্পানির প্রায় ৯২ শতাংশের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যের সঙ্গে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল (৮০ শতাংশ) এবং অন্য রাজনৈতিক দলের (১২ শতাংশ) প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তারা মালিক ও শ্রমিক সংগঠনে একচেটিয়া ক্ষমতা চর্চার পাশাপাশি নীতি করায়ত্ব করার মাধ্যমে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগে প্রতিবন্ধকতা তৈরির মাধ্যমে খাতটিকে জিম্মি করে রেখেছেন।

বাস পরিবহনে অনিয়ম ও দুর্নীতির আরও প্রকট উদাহরণ হলো, জরিপে অংশগ্রহণকারী কর্মী/শ্রমিকদের ৪০ দশমিক ৯ শতাংশের মতে, তাদের সংশ্লিষ্ট কোম্পানির এক বা একাধিক বাসের নিবন্ধনসহ কোনো না কোনো সনদের ঘাটতি আছে। ২৪ শতাংশ কর্মী/শ্রমিকের মতে, তাদের সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কোনো না কোনো বাসের ফিটনেস সনদ নেই এবং ২২ শতাংশ বলেছেন বাসের রুট পারমিট নেই। রয়েছে ব্যক্তিমালিকানাধীন বাসে পেশাদার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও লাইসেন্সধারী চালকের সংকট।

এছাড়া জরিপে অংশগ্রহণকারী ১১ দশমিক ৯ শতাংশ বাস মালিক জানান তাদের কোম্পানিতে এক বা একাধিক পেশাদার লাইসেন্সবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্সধারী চালক আছে। জরিপের ২২ দশমিক ২ শতাংশ কর্মী/শ্রমিকের তথ্যানুযায়ী মদ্যপান বা নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন করে চালক গাড়ি চালান এবং কন্ডাক্টর/হেলপার/সুপারভাইজার বাসে দায়িত্ব পালন করেন। তা ছাড়া চলন্ত বাসে চালকরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। ফলে অনেকসময় প্রাণহানিসহ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।

বাস পরিবহনে অনিয়মের উদাহরণের মধ্যে আরও রয়েছে প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, অতিরিক্ত আসন সংযোজন, নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ইত্যাদি।

জরিপে অংশগ্রহণকারী সিটি সার্ভিসের ৮৯ দশমিক ২ শতাংশ এবং আন্তঃজেলার ৬০ দশমিক ৪ শতাংশ কর্মী/শ্রমিকের মতে, তাদের সংশ্লিষ্ট কোম্পানির বাসে নিয়ম অনুযায়ী টায়ার, ইঞ্জিন অয়েল, ব্রেক সংক্রান্ত সরঞ্জামাদি ইত্যাদি পরিবর্তন ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না।

বাসের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়মিত না করায় তাদের সংশ্লিষ্ট কোম্পানির গাড়ি সড়ক পথে কালো ধোঁয়া নির্গমন বা নিঃসরণ করে। অনেক ক্ষেত্রে বাস মালিকেরা নকশা পরিবর্তন করে বাসে অতিরিক্ত আসন সংযোজন করে যাত্রী পরিবহন করে থাকে।

সিটি সার্ভিসের কর্মী/শ্রমিকদের ৪০ দশমিক ৪ শতাংশ বলেছেন, তাদের সংশ্লিষ্ট কোম্পানির গাড়িতে নকশা পরিবর্তন করে অতিরিক্ত আসন সংযোজন করা হয়েছে। বাস পরিবহন ব্যবস্থার জরিপে অংশগ্রহণকারীদের দেওয়া আরেকটি উদ্বেগজনক চিত্র হলো ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ নারী বাসযাত্রী যাত্রাপথে কোনো না কোনো সময় যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বা হতে দেখেছেন। এ হার আন্তঃজেলা (দূরপাল্লা ও আঞ্চলিক) বাসের ক্ষেত্রে ৩১ দশমিক ৩ শতাংশ এবং সিটি সার্ভিসের ক্ষেত্রে ৪২ দশমিক ৬ শতাংশ। যৌন হয়রানির শিকার নারীদের মধ্যে ৮৩ দশমিক ২ শতাংশ সহযাত্রী এবং ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ হেলপার দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।

গবেষণা প্রতিবেদনে ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস পরিবহন ব্যবসায় শুদ্ধাচার নিশ্চিতে ১৫ দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি।

XS
SM
MD
LG