অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

ভারতীয় আদিবাসীরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পারিবারিক সহিংসতার শিকার সতর্ক করলেন সক্রিয়কর্মীরা


১৪ বছর বয়সী একজন আদিবাসী কিশোরী ও শিশু-বউ । তার স্বামী তাকে প্রহার করায় শরীরে রয়েছে ক্ষতচিহ্ন। ঝাড়খন্ড, ভারত ( আর্টিমুন্ডা /ভিওএ)
১৪ বছর বয়সী একজন আদিবাসী কিশোরী ও শিশু-বউ । তার স্বামী তাকে প্রহার করায় শরীরে রয়েছে ক্ষতচিহ্ন। ঝাড়খন্ড, ভারত ( আর্টিমুন্ডা /ভিওএ)

ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ঝাড়খাণ্ডের মুন্ডা উপজাতির আঠারো বছর বয়সী মেয়ে জয়া। এক দশকেরও বেশি হয়েছে যে তিনি তারা বাবাকে দেখেননি। ২০১৩ সালে জয়ার মা, যিনি দিনমজুরের কাজ করতেন একটি কৃষিজমিতে, তিনি তার দুই মেয়েকে নিয়ে ঝাড়খাণ্ডের রাজধানী রাঁচিতে শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাদের গ্রামের বাড়িতে চলে যান। সেখানে তার বাবা-মায়ের একটি জমিতে বসতি গড়েন।

ভয়েস অফ আমেরিকাকে তার নিরাপত্তার জনিত কারণে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ফোন সাক্ষাৎকারে জয়া বলেন, “আমার বাবা প্রচণ্ড মদ্যপ, তিনি মদ পান করতেন। আমরা যখন তার সাথে থাকতাম তখন এমন কোন দিন ছিল না যখন তিনি আমার মা, বোন এবং আমাকে বেধড়ক পেটাতেন না।

ভারতের পঞ্চম জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য জরিপ অনুসারে, সিডিউল্ড ট্রাইব যা সরকার স্বীকৃত উপজাতি ও আদিবাসী সম্প্রদায়র্ভুক্ত ৩০ শতাংশেরও বেশি ভারতীয় নারী পরিবারের ভেতরেই শারীরিক ভাবে নির্যাতনের শিকার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে পরিবারের অভ্যন্তরেই শারীরিক, মানসিক, মৌখিক ও যৌন সহিংসতা সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। এর কারণই হচ্ছে কিছু এলাকায় মদ্যপান একটি সংস্কৃতিতে পরিণত হয়ে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মাঝে শেকড় গেড়েছে। বেশির ভাগ সহিংসতার ঘটনাই অপ্রকাশিত থেকে যায়।

ঘরে ঘরে সহিংসতা

ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীদের লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা রোধে কাজ করছে বেসরকারী সংস্থা আহান ফাউন্ডেশন। এই সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা রাশমি তিওয়ারি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন যে তিনি যেসব মেয়েদের সাথে কাজ করেছেন তাদের ১০০ভাগই কোন না কোন ধরণের পারিবারিক সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছেন অথবা প্রত্যক্ষ করেছেন।

তিওয়ারা বলেন, “পারিবারিক নির্যাতন ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীদের সামাজিক কাঠামোর একটি অংশ হয়ে উঠেছে এবং এর বেশিরভাগই কয়েক প্রজন্ম ধরে মাদকাসক্তি এবং উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত মানসিক ভীতির সাথে যুক্ত। শারীরিকভাবে খুব শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও আদিবাসী নারীরা প্রায়ই প্রচন্ড মারধরের শিকার হন। এর একটাই কারণ, তারা মনে করেন তাদের নির্যাতন করা পুরুষদের অধিকার।”

তিনি বলেন, “হাদিয়া, একধরণের দেশীয় মদ। গাঁজানো ভাত দিয়ে এটি তৈরি করা হয়। ঐতিহ্যগতভাবে ভারতীয় আদিবাসী সম্প্রদায় শীতল পানীয় হিসাবে একে ব্যবহার করতেন। তবে, বর্তমানে গ্রামে আদিবাসীদের প্রায় প্রতি একটি বাড়ি পরপরই এটা তৈরি হচ্ছে। তবে দ্রুত গাঁজানোর এবং বিপুল পরিমাণ বিক্রয়ের জন্য এতে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হচ্ছে। বহু আর্থ-সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারগুলোর কাছে হাদিয়া বিক্রি করাই জীবন-জীবিকার একমাত্র উৎস - এবং এটা প্রায়শই তাদের পরিবারিক সংস্কৃতির শামিল হচ্ছে।”

জয়া তারা নানা-ননী, মামা এবং তাদের পরিবারের সঙ্গে বসবাস করেন। তিনি বলেন, “এখানেও তার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়।”

জয়া ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “আমার নানা একজন চাষী, তিনি ক্লান্তিদূর করার জন্য কাজের পরে প্রায়ই মদ্যপান করেন। মদ্যপ অবস্থায় তিনি আমাকে ও আমার মাকে খুব মারধর করেন। মাঝে মাঝে আমাদের খেতে দেন না। পরিবারের অন্য কোনো সদস্য তাকে থামানোর চেষ্টা করে না কারণ তারা এই ধরণের আচরণকে স্বাভাবিক বলেই মনে করে।

উইচ হান্টিং

ঋষি কান্ত নতুন দিল্লি ভিত্তিক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান শক্তি বাহিনীর সহ-প্রতিষ্ঠাতা। এই প্রতিষ্ঠানটি অনেক আদিবাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, পারিবারিক সহিংসতা অনেক আদিবাসী “সংস্কৃতিতে গ্রথিত” এবং প্রচলিতভাবে যা বোঝা যায় বা মনে হতে পারে তা তার মতো নাও হতে পারে।

তিনি বলেন, “ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীদের মধ্যে কুসংস্কার বিরাজ করে এবং নারী ও মেয়েরা প্রায়শই এর শিকার হন। ভয়াবহ অথচ খুব প্রচলিত ভাবে যে পাবিারিক সহিংসতা প্রকাশ পায় তা হলো ‘উইচ হান্টিং’।

কান্ত বলেন, “পরিবারে যদি কোনও সমস্যা থাকে, যেমন অসুস্থতা বা বেকারত্ব সে ক্ষেত্রে বাড়িতে যে নারীটি আছেন তাকে দোষ দেয়া হয় – পুত্রবধূ, মেয়ে, বৃদ্ধা নানী- দাদীকে। তার উপরে জিন-ভুতের “আসর” পড়েছে বলে তাকে মারধর করা হয়, গাছের সঙ্গে বেধে রাখা হয় এবং তার দেহ বিকৃত করে দেয়া হয়।

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো বা এনসিআরবি অনুসারে ঝাড়খন্ডে, ২০২২ সালে উইচ হান্টের শিকার এমন ১১টি মামলা নথিভুক্ত করা হয়েছিল কিন্তু এর শেষ পরিণত ছিল খুন। হিসেব অনুসারে, ঝাড়খণ্ডে প্রতি বছর ডাইনিপূজারী অপবাদ দিয়ে ৬০ থেকে ৭০ জন নারীকে হত্যা করা হয়, যাদের বেশিরভাগই আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত।

আদিবাসী ছেলেমেয়েদের বাবা-মা দুজনই প্রায় সময়ই নেশাগ্রস্ত অবস্থায় থাকে, ফলে বিশেষকরে মেয়েরা - প্রায়শই নির্যাতনের শিকার হয়, মানসিক ভীতিতে ভোগে এবং অনেক ক্ষেত্রে মানব পাচারের ঝুঁকিতে পড়ে।

মানব পাচার

তিওয়ারি ভায়েস অব আমেরিকাকে বলেন, আদিবাসী পুরুষরা যখন মাতাল হয় তখন তারা হিংস্র হয়ে ওঠে। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে, হাদিয়ার কারণে প্রায়ই নারীরা তাদের পরিবার থেকে দূরে সরে যায় এবং তাদের সন্তানদের অবহেলা করতে শুরু করে।

তিনি বলছিলেন, “বাড়ির কোন প্রাপ্ত বয়স্ক লোক রান্না করবেন না বলে অল্প বয়সী মেয়েরা রান্না করতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলেছে। আমরা এমন শিশুদেরও দেখেছি যাদের মা মাতাল অবস্থায় ছেলেমেয়েদের মারধর করে। একই সঙ্গে, আদিবাসী মেয়েরা হাদিয়া প্রস্তুত করা এবং গ্রাহকদের পরিবেশন করায় সক্রিয় অংশ নেয় - এটি একটি পারিবারিক ব্যবসা। ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে শিশুদেরও মদ্যপান করতে দেখা যায়, ”

প্রজন্মগত ভীতি

ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট এবং ট্রমা থেরাপিস্ট প্রাচী সাক্সেনা ভৈষ বলেন যে বাড়িতে বাবা-মায়ের মধ্যে নিয়মিতভাবে ঝগড়াঝাটি মারামারি দেখার ফলে ঐ শিশুটি ভবিষ্যতে তার সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশেষত নির্যাতনের ঝুঁকিতে পড়তে পারে।

তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “শৈশবে অত্যাচার দেখে যে শিশুটি বড় হয়, অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হয় তার জন্য একটি নতুন স্বাভাবিক সম্পর্ক যখন তৈরি হয় সে ক্ষেত্রে তারা নির্যাতনের সাথে “ভালবাসা” যুক্ত করতে শেখে। এমনকি তারা যা দেখছে তার প্রতি ক্রোধ এবং বিদ্রোহ অনুভব করলেও তারা এই স্বাভাবিক নির্যাতন থেকে বেরিয়ে এসে তাদের মনে ভালবাসার একটি সুস্থ প্রোটোটাইপ তৈরি করতে পারে না।”

তিনি বলেন, “পরে, এরা নিজেরাই তাদের নিজস্ব ভবিষ্যতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নির্যাতনের সহজ শিকার হতে পারে বা তাদের সঙ্গী বা বন্ধু-বান্ধবীর প্রতি নিজেরাই আপত্তিকর আচরণ করে থাকতে পারে কারণ তারা বিশ্বাস করে যে এটি ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ”। আহান ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা তিওয়ারি বলেন, এদের পরিবারে সহিংসতার হার বেশী হওয়া সত্ত্বে আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সাহায্য বা বা কোনও সাহায্য একেবারেই পান না।

তিওয়ারি বলেন, “আহানের পক্ষ থেকে আমরা আদিবাসী মেয়ে এবং ছেলেদের জন্য বিনা অর্থে লাইসেন্সপ্রাপ্ত পেশাদারদের দিয়ে কাউন্সেলিং, ট্রমা থেরাপি এবং ডান্স থেরাপি করিয়ে থাকি। আমাদের পিয়ার কাউন্সেলিং-এরও ব্যবস্থা আছে এবং আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে শিক্ষা, শিল্প প্রশিক্ষণ এবং খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুদের মাঝে এই বোধ সৃষ্টি করতে হবে যে তাদের মানুষ ভালবাসে এবং তারা সুরক্ষিত।

তবে আহান কেবলমাত্র বিশাল সমস্যার খুব সামান্যই মোকাবিলা করতে পেরেছে। আমাদের সরকার এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছ থেকে সমর্থন প্রয়োজন – মদের আসক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আদিবাসী পুরুষ ও নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে।

XS
SM
MD
LG