অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

সবার আগে দরকার দুর্নীতির রাশ টেনে ধরা: তাসলিমা আখতার


তাসলিমা আখতার
তাসলিমা আখতার

বাংলাদেশের আসন্ন বাজেট নিয়ে গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান ও আলোকচিত্রী তাসলিমা আখতারের সঙ্গে কথা হয় ভয়েস অফ আমেরিকার। ভয়েস অফ আমেরিকার পক্ষে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন মলয় বিকাশ দেবনাথ।

ভয়েস অফ আমেরিকা: এবারের কোন কোন খাতে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত? কেন?

তাসলিমা আখতার: প্রথমেই যা না বললেই না তা হলো, উচিত-অগ্রাধিকার এসব আলাপ তখনই জরুরি হতে পারে যখন বাজেট ব্যবস্থায় সরকারের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত সম্ভব হয়। নইলে এসব কথার কথা হিসেবেই থেকে যাবে। দেশ পরিচালনায় জনগণ থেকে সম্পদ আহরণ এবং বণ্টনে যে বৈষম্য আছে বাজেট আলাপে সেদিকে নজর দেয়া জরুরি। কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারের দলীয় বা মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ীর স্বার্থ নয় বরং সকল জনগণের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার ও স্বস্তির জীবন নিশ্চিত করাই বাজেটে প্রধান বিবেচ্য হবার কথা। অর্থনীতির জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় খাদ্য-কৃষি, মর্যাদাপূর্ণ কর্মসংস্থান-জাতীয় মজুরি ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে অগ্রাধিকার থাকা দরকার।

এশিয়া মহাদেশের ৪৬ দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি এখন বাংলাদেশে। চলতি অর্থবছরে দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার প্রায় শতকরা ১০ ভাগ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিএসএস) মতে, এপ্রিলে খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার শতকরা ১০.২২ ভাগ। যদি সরকারি তথ্যের বাইরে গিয়ে দেখা যায়, তাহলে এর হার আরও বেশি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তৈরিতে অন্যতম ভূমিকা রাখা পোশাক শ্রমিকসহ অন্যান্য কোনো কোনো খাতে শ্রমিকের মজুরি বাড়লেও প্রকৃত আয় বাড়েনি। যার ফলে জীবন বাঁচাতে নিম্ন আয়ের জনগণ খাদ্য ও পুষ্টি কাটছাঁট করতে করতে বেসামাল। এ অবস্থায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির বিপদকাল পেরুতে বাজেটে খাদ্যের মতো মৌলিক চাহিদার খাতে সরকারের অগ্রাধিকার হওয়ার কথা। খাদ্যের কথা এলে সাথে সাথে চলে আসে কৃষির প্রসঙ্গ। কৃষি খাতে বিনিয়োগ বাজেটের বিবেচনায় থাকা জরুরি। পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদের সংকট দূর করতে শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে অগ্রাধিকার দরকার। দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি, নিজ দেশের সক্ষমতা-উৎপাদনশীলতা-উপার্জন বৃদ্ধিতে শিক্ষার ভূমিকা অনস্বীকার্য। বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থার মানের অবনতি, পরিচালনা কমিটিতে দলীয় প্রভাব, পর্যাপ্ত সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব, অধিক মূল্য শিক্ষা উপকরণ, শিক্ষকদের কম বেতন ইত্যাদি সমস্যায় জর্জরিত।

স্বাস্থ্য ও চিকিৎসায় বেহাল অবস্থা টের পাওয়া যায় সরকারি হাসপাতালের দুরবস্থা, স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা, হাসপাতাল স্বল্পতা, দুর্নীতিপ্রবণ ব্যবস্থার মধ্যে। স্বাস্থ্যসেবা অপর্যাপ্ত অন্যদিকে স্বাস্থ্য খাতও শিক্ষার মতো বাণিজ্যিক উপকরণে পরিণত হয়েছে। যার অর্থ আছে কেবল সেই স্বাস্থ্যসেবা-চিকিৎসা পাচ্ছে বা শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। এই অবস্থার পরিবর্তন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বাজেটের জরুরি দিক। এ ছাড়া পোশাক শ্রমিকসহ নিম্ন আয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দোরগোড়ায় সরকারি স্বল্প বা বিনামূল্যে মানসম্মত চিকিৎসা নেই। ফলে স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ থেকে তারা বরাবর বঞ্চিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকারের জায়গা মজবুত করা বাঞ্ছনীয়।

ভয়েস অফ আমেরিকা: বাজেটের বাস্তবায়ন সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কী কী করা দরকার?

তাসলিমা আখতার: বাস্তবায়ন সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সবার আগে দরকার দুর্নীতির রাশ টেনে ধরা এবং সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি, অস্থিতিশীল বৈদেশিক মুদ্রাবাজার, ব্যাংকে তারল্য সংকটের সাথে ঋণখেলাপির হার বৃদ্ধি, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের নামে ব্যাংক ও অন্যান্য ঋণের বোঝা বাজেট সক্ষমতা বৃদ্ধির পথে বড় বাধা। এই বাধাগুলো দূর করতে উচ্চবিত্তদের কর ছাড় ও ফাঁকি রোধ দরকার। একইসাথে প্রয়োজন অর্থ পাচার এবং অবৈধ অর্থ রোধে পদক্ষেপ। ‘কালো’ টাকা সাদা করার নামে সম্পদশালীদের কর ছাড় সুবিধা না দিয়ে বাজেট তদারকিতে স্বচ্ছতা আনতে হবে। ব্যাংকিং ব্যবস্থার সংকট দূর করতে ব্যাংক ঋণ ও ঋণের বোঝা সাধারণের ওপর চাপানো বন্ধ করতে হবে। দলীয় বা স্বজনপ্রীতির ভিত্তিতে নয় বরং যোগ্যতার ভিত্তিতে বাজেট বরাদ্দ বণ্টনের ব্যবস্থা তৈরি করা। পরিকল্পনার সময়েই বাস্তবায়নের উপযোগিতা যাচাই করতে হবে এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় বিভিন্ন প্রকল্পে যথেচ্ছ খরচ বন্ধ করা।

ভয়েস অফ আমেরিকা: আয় বাড়ানোর জন্য কী করা দরকার?

তাসলিমা আখতার: আয় বাড়ানোর জন্য নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর পরোক্ষ করের বোঝা বৃদ্ধি না করে উচ্চবিত্ত-সম্পদশালীদের কর বাড়ানো ও আদায় সক্ষমতা বৃদ্ধি দরকার। দরকার ঋণখেলাপিদের ঋণ আদায় এবং অবৈধ পাচার প্রতিহত করার উদ্যোগ। ব্যাংকিং সংকট মোকাবিলা করা জরুরি।

ভয়েস অফ আমেরিকা: কোন কোন খাতে খরচ কমানো উচিত?

তাসলিমা আখতার: বাংলাদেশ সরকারের পরিচালন ব্যয় তার সামগ্রিক বাজেটের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ফলে সরকারের পরিচালন ব্যয় কমানো প্রয়োজন। এ ছাড়া মেগা প্রকল্পের ব্যয় ও সরকারি ঋণ কমানো জরুরি। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাবে ব্যয় হার অধিক করা হচ্ছে– এমন ক্ষেত্রে যার স্বল্প বা মধ্য মেয়াদে কোনো উপযোগিতা নেই। আবার কোনো কোনো প্রকল্পে ব্যয় অন্যান্য দেশের চাইতে অনেক বেশি। জনগণের করের টাকায় দলীয় ব্যক্তিদের কথায় সুযোগ-সুবিধা প্রদান সম্পর্কিত ব্যয় কমানো দরকার।

ভয়েস অফ আমেরিকা: আইএমএফ বাজেটের আকার ছোট রাখতে বলেছে, আপনি কি একমত? কেন?

তাসলিমা আখতার: বাজেট যাদের টাকায় হয়, সেই জনগণ বা তাদের প্রতিনিধিদের বদলে বরাবরই আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকসহ দেশি-বিদেশি গোষ্ঠী, সম্পদশালী ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি, দলীয় বিবেচনা বাজেটে ভূমিকা রাখতে দেখা যায়। যেটি চিন্তার বিষয়। প্রকৃতার্থে বাজেটের আকার ছোট না বড়– সেটা প্রধান বিষয় নয়। বাজেটে আয়ের সংস্থান বা রাষ্ট্রের সম্পদ সংগ্রহ ও বণ্টনে অসমতার দিকগুলো খেয়াল রাখা দরকার। তা না হলে আয়বৈষম্য বাড়বে। তাই ছোট-বড় প্রসঙ্গের চেয়ে বাজেটের অর্থের পরিমাণ, উৎস, ধরন ও খরচের খাতের বিষয় জনগণের কাছে স্বচ্ছ রাখাটা জরুরি মনে করি। একইসাথে জরুরি অর্থ খাতের সকল দুর্নীতি রোধে ব্যবস্থা নেয়া।

ভয়েস অফ আমেরিকা: কোন তিনটি খাতে সংস্কার সবচেয়ে জরুরি? কেন? কী করা উচিত?

তাসলিমা আখতার: সংস্কার প্রস্তাব আসলে একটা সামগ্রিক ব্যাপার। এর পরিসর বাজেটে সীমাবদ্ধ নয়। দেশে প্রধান যে তিনটি বিষয়ে সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করি, সেগুলো হলো– ক্ষমতা কাঠামো, আর্থিক খাত এবং শাসন ও নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার। দেশের সমস্ত ক্ষমতা এক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত এবং জবাবদিহিতাবিহীন; যা জনগণের অধিকারকে খর্ব করে এবং অপরিসীম দুর্নীতির জন্ম দেয়। ফলে এই সংস্কার হলো অগ্রাধিকার। সংস্কারের মাধ্যমে এখানে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে। বিচার বিভাগকে পুরোপুরি স্বাধীন করতে হবে এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।

দেশের আর্থিক খাত কিছু ব্যক্তির বা ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে। তাই ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা জরুরি। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তার প্রকৃত ক্ষমতা বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশে শাসনব্যবস্থায় গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকারের অভাব জরুরি প্রশ্ন হিসেবে সামনে আছে। এখানে নির্বাচনী ব্যবস্থা সব দিক থেকেই জনগণের আস্থা হারিয়েছে। বাজেটে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত ও জনমুখী করতে সরকারের শাসন ও নির্বাচনী ব্যবস্থা মেরামতের বিষয় এড়িয়ে এগোনোর কোনো সুযোগ নেই। এই বিষয় এড়িয়ে গেলে বরাবরের মতো বাজেটে নিম্ন আয়ের মানুষের অবস্থা কমে আরও ম্লান হবে– এটাই স্বাভাবিক।

ভয়েস অফ আমেরিকা: বাজেট তৈরির সময় কোন কোন চ্যালেঞ্জের কথা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মাথায় রাখা দরকার?

তাসলিমা আখতার: বর্তমান সময়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উচ্চ মূল্যস্ফীতি-দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ডলার ও ব্যাংকিং সংকটের কথা মাথায় রাখা দরকার। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে পোশাক শ্রমিকসহ শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের জনগণকে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।

ভয়েস অফ আমেরিকা: গত পাঁচ বছরের বাজেট পর্যালোচনা করলে কোন দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতা বা ভুলগুলো চোখে পড়েছে? এগুলো অ্যাড্রেস করা হয়েছে কি? কী করা উচিত?

তাসলিমা আখতার: বাজেট দুর্বলতার কয়েকটি দিক হলো:

– সম্পদশালী এবং সরকার দলীয় ও গোষ্ঠী স্বার্থ বাজেটের প্রধান বিবেচ্য থাকা।

– বাজেট বিষয়ে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার ঘাটতি।

– অর্থ পাচার, অবৈধ অর্থ ও ঋণখেলাপি নিয়ন্ত্রণে অপারগতা।

XS
SM
MD
LG