অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠনে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে 'সংলাপ', বিরোধীদের আগ্রহ কম


নির্বাচন কমিশন ভবন। (ছবি- মানবজমিন)
নির্বাচন কমিশন ভবন। (ছবি- মানবজমিন)

পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটি করতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু হচ্ছে সোমবার থেকে। এ দিন বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে জাতীয় পার্টির একটি প্রতিনিধি দল আলোচনায় অংশ নেবে। বুধবার জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের আলোচনার সূচি চূড়ান্ত হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলকে পর্যায়ক্রমে আমন্ত্রণ জানানো হবে বলে প্রেসিডেন্টের প্রেস সচিব জয়নাল আবেদীন জানিয়েছেন।

যদিও এই সংলাপের প্রতি বেশিরভাগ বিরোধী দলেরই আগ্রহ নেই বলে মনে হচ্ছে। প্রধান বিরোধী জোটের নেতৃত্ব দেয়া বিএনপি এই সংলাপে অংশ নেবে না বলে আগেই ঘোষণা দিয়েছে। তাদের নেতৃত্বাধীন ২০ দলের শরিক দলগুলোও এই সংলাপে যাচ্ছে না। এছাড়া বাম দলগুলোও সংলাপে অংশ নেয়ার বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।

পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটি করতে এই সংলাপ আহ্বান করা হলেও বঙ্গভবন থেকে যে চিঠি পাঠানো হয়েছে এতে মতবিনিময়ের কথা বলা হয়েছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনও এই সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠন করেছিলেন প্রেসিডেন্ট। যদিও এই কমিশন নিয়ে বিরোধী দলগুলোর ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। তারা বলছেন, একই প্রক্রিয়ায় পরবর্তী নির্বাচন কমিশনে তারা মতামত দিতে চান না। কারণ এই প্রক্রিয়াটি গ্রহণযোগ্য নয়। সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় সংসদের মাধ্যমে আইন প্রণয়ন করে নির্বাচন কমিশন গঠনের পক্ষে বেশিরভাগ বিরোধী দল।

ওদিকে প্রেসিডেন্টের এ সংলাপ প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। যথানিয়মে সংলাপে অংশ নেয়ার কথা জানিয়েছেন দলটির নেতারা। এছাড়া আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোও সংলাপে অংশ নেবে।

সোমবার জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি আলোচনায় অংশ নেবে। দলটির আট সদস্যের প্রতিনিধি দল বঙ্গভবনে যাচ্ছেন বলে দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু জানিয়েছেন। দলের পক্ষ থেকে কি মতামত দেয়া হবে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, জাতীয় পার্টির তরফে কোনো মতামত দেয়া হবে না। প্রেসিডেন্টের তরফে কি জানতে চাওয়া হয় তা আগে শুনবে জাতীয় পার্টি। তিনি বলেন, জাতীয় পার্টি সার্চ কমিটি নয়, আইন প্রণয়ন করে নির্বাচন কমিশন গঠনের পক্ষে।

বঙ্গভবন সূত্র জানিয়েছে, করোনা সংক্রমণ ঝুঁকির কারণে দলগুলোর প্রতিনিধি দলের প্রত্যেককে করোনা পরীক্ষা করে নেগেটিভ সনদ নিয়ে যেতে হবে। আগের বার সংলাপে প্রত্যেক দলের ২০ জনকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও এবার এই সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছে। কোন দলের কতজন যেতে পারবেন তা চিঠিতে উল্লেখ করে দেয়া হবে। জাসদের তরফে জানানো হয়েছে, বুধবার তাদের দলের সাতজন প্রতিনিধিকে বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সংলাপের আমন্ত্রণ পেয়েছে কিনা তা দলটির তরফে প্রকাশ করা হয়নি। তবে নেতারা আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন নির্বাচন কমিশন গঠনে প্রেসিডেন্টের সংলাপ প্রক্রিয়ায় তারা আর অংশ নেবেন না। বিএনপি’র সঙ্গে রাজনৈতিক জোটে আছে এমন দলগুলোর সংলাপে অংশ নেয়ার বিষয়ে কোনো আগ্রহ নেই। বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক কল্যাণ পার্টি অবশ্য সংলাপে অংশ নেয়ার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এখন পর্যন্ত আমন্ত্রণ না পেলেও দলটির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক জানিয়েছেন, তিনি সংলাপে অংশ নেয়ার পক্ষে।

২০ দলের শরিক লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম বলেন, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে অতীতেও অনেক আলাপ হয়েছে। কিন্তু কোনো আলাপই ফলপ্রসূ হয়নি। এটা শুধু চা খাওয়ার দাওয়াতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এখন পর্যন্ত আমাদের সিদ্ধান্ত হলো সংলাপে যাবো না। তবে প্রেসিডেন্ট হাউজ থেকে দাওয়াত পাওয়ার পরে আমরা এটা নিয়ে বসে সিদ্ধান্ত নেবো।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো চিঠি এখনো পাইনি। চিঠি পেলে আমাদের যে বাম গণতান্ত্রিক জোট আছে সেখানে দলগতভাবে বসে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবো সংলাপে যাব কি-না।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সংলাপের বিষয়ে বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য কি করণীয় তা ৫ বছর আগে আমরা প্রেসিডেন্টের কাছে বলে এসেছি। তিনি চাইলে তখনকার ফাইল খুঁজে দেখতে পারেন। সার্চ কমিটি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ না করে প্রেসিডেন্টের উচিত সংসদকে চিঠি দেয়া। সংসদকে ৭ দিনের মধ্যে তিনি নির্বাচন কমিশন আইন গঠনের জন্য বলতে পারেন। দুঃখজনক হচ্ছে, এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে আইন গত ৫০ বছরে করা হলো না। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বিগত সংলাপের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে সিপিবি সভাপতি বলেন, সিপিবি এর আগের সংলাপে যে পরামর্শ দিয়েছিল তা থেকে ভালো কোনো রেজাল্ট আসেনি। এমন কিছু লোককে নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলো যারা নৈশকালীন ভোটের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

নিবন্ধিত আরেক রাজনৈতিক দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান জানিয়েছেন, বঙ্গভবনের তরফে চিঠি তারা পাননি। তার মতে, আগেও এমন সংলাপ হয়েছিল। এতে কোনো আশাব্যঞ্জক কিছু হয়নি। এই সংলাপেও নতুন কিছু হবে বলে মনে হয় না। সংলাপে অংশ নেয়ার বিষয়ে ২৩শে ডিসেম্বর দলীয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত হবে।

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের এখতিয়ার প্রেসিডেন্টের হাতে। প্রয়াত প্রেসিডেন্ট মো. জিল্লুর রহমান ২০১২ সালে এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ২০১৬-২০১৭ সালে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করে সার্চ কমিটির মাধ্যমে সর্বশেষ দুটি নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দিয়েছিলেন। ২০১৬-২০১৭ সনের সংলাপে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোও অংশ নেয়। কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন ইসি গঠনের আগে ২০১৬ সালের ১৮ই ডিসেম্বর সংসদের বাইরে থাকা বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে সংলাপ শুরু করেন আবদুল হামিদ। একমাস ধরে ৩১টি দলের সঙ্গে চলা ওই সংলাপ ২০১৭ সনের ১৮ই জানুয়ারি শেষ হয়। ওই সময় সার্চ কমিটি গঠন করার পর সে বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ওই কমিটির কাজের সাচিবিক দায়িত্বও ছিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের হাতে।

আইন করে নির্বাচন কমিশন গঠনের কথা বিদ্যমান সংবিধানে থাকলেও এতদিনে কেন তা করা হয়নি এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। এ বছর নাগরিক সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন আইনমন্ত্রীর কাছে কমিশন গঠন সংক্রান্ত একটি আইনের খসড়াও জমা দিয়েছে। তবে পরবর্তী কমিশন গঠনের আগে কোনো আইন করা যাবে না বলে সরকারের তরফে বলা হচ্ছে। যদিও আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন, কমিশন গঠনে আইন করতে সরকার কাজ করছে। সংসদের পরবর্তী দুটি অধিবেশনেই তা দৃশ্যমান হবে।

সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠনের কথা রয়েছে। এ বিষয়ে প্রণীত আইনের বিধান সাপেক্ষে প্রেসিডেন্ট প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দেবেন বলে সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে।

XS
SM
MD
LG