বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকরা যুক্ত্ররাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার নানাদিক পর্যালোচনা করেছেন। তারা জানার চেষ্টা করেছেন- কেন এই নিষেধাজ্ঞা? এর প্রভাবই বা কি হতে পারে? এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৌশল নির্ধারণে তিনজন মন্ত্রীকে দায়িত্ব দিয়েছেন। তারা হলেন-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক শেষে এই সিদ্ধান্তের কথা জানান কেবিনেট সেক্রেটারি খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের তরফে র্যাব এবং প্রতিষ্ঠানটির সাবেক ও বর্তমান ৭ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। ঢাকায় নিযুক্ত যুক্ত্ররাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে প্রতিবাদ জানানো হয়। রাজনৈতিকভাবেও প্রতিবাদ জানানো অব্যাহত রয়েছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মনে করেন- যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক, এর পেছনে নিশ্চয় কোনো ষড়যন্ত্র রয়েছে। সোমবার দলের সম্পাদকমণ্ডলীর এক বৈঠক শেষে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের কাছে এই মনোভাব ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, "বিজয়ের মাসে যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ দেশে জঙ্গিবাদ ও তাদের পৃষ্ঠপোষক এবং সন্ত্রাসীদের উৎসাহিত করবে। ওবায়দুল কাদের বলেন, ঢালাওভাবে অভিযোগ এনে একটি বাহিনীর প্রধান এবং সাবেক কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে নিষেধাজ্ঞা প্রদান অযৌক্তিক। মানবাধিকারের কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের সিদ্ধান্তই এক ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন। তিনি বলেন, এসব নিষেধাজ্ঞা আগামী নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলবে না।"
ঢাকা-ওয়াশিংটনের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কে ফাটল ধরাতে ‘তৃতীয়পক্ষ ষড়যন্ত্র করছে’ দাবি করে সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা আরো জোরদার এবং বন্ধু দেশগুলোর কাছে সব বিষয়ে ‘সঠিক তথ্য’ তুলে ধরার পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন সরকারের শরিক ১৪ দলের নেতারা। সোমবার এক ভার্চ্যুয়ালি আলোচনা সভায় জোট নেতারা এই পরামর্শ দেন। জোটের সমন্বয়ক ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, "সারাবিশ্বে যখন জঙ্গিবাদ আলোড়িত একটি বিষয়, সেই সময়ে শেখ হাসিনা’র নেতৃত্বে জঙ্গিবাদ নির্মূল করা হয়েছে। জঙ্গি নির্মূলে যেই সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ অবদান সেই সংস্থাকে আঘাত করা হচ্ছে কেন আমাদের বোধগম্য নয়। আজকে বঙ্গোপসাগর নিয়ে যে বলয় সৃষ্টি হয়েছে, সেই বলয়ে আমাদের দেশ অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার কারণেই চাপ প্রয়োগ হচ্ছে বলে আমরা মনে করি।"
ওদিকে র্যাবের বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি। সোমবার কমিটির মুখপাত্র ড. শাহদীন মালিক এর তরফে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, "আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, মার্কিন প্রশাসন কর্তৃক র্যাবের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের ওপর চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে নিষেধাজ্ঞা ও বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। আমরা মনে করি, এটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত অমর্যাদাকর এবং অপমানজনক একটি পদক্ষেপ। এই বিষয়টি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতির একটি বহিঃপ্রকাশ।"
বিবৃতিতে বলা হয়, "অবিলম্বে এই বাহিনীর ভেতরের পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য, বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, নির্যাতন ও অন্যান্য অপরাধের যে ঘটনাগুলো ঘটেছে সেগুলোর ব্যাপারে আশু, দ্রুত এবং উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি করছি। সেই সাথে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে ঘটনাগুলো ঘটেছে সে বিষয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, মানবাধিকার কমিশনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের যথাযথ ভূমিকা প্রত্যাশা করছি। আমরা আশঙ্কা করছি, এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা সামনে অব্যাহত থাকলে বা আরো সম্প্রসারিত হলে রাষ্ট্র হিসেবে আমরা অত্যন্ত অমর্যাদাকর এবং লজ্জাজনক স্তরে পৌঁছাবো। এই বিষয়গুলো চিন্তা করে এবং বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংশ্লিষ্ট আদর্শগুলো স্মরণে রেখে অবিলম্বে এই দেশে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো বিচারের আওতায় আনা এবং এই ধরনের ঘটনা যাতে আর কখনো না ঘটে সেই ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি।"
কূটনীতিক ও ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেছেন, "কয়েকদিন ধরে যেসব খবরাখবর আসছে এগুলো আমাদের জন্য বিব্রতকর। এরপরও বলবো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বহুমুখী-বহুমাত্রিক একটি অংশ। তাদের সঙ্গে আমাদের কাজ করে যেতে হবে। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরও বেশি করে কীভাবে যুক্ত হওয়া যায় সেদিকে বেশি মনোযোগী হতে হবে।" হুমায়ুন কবির বলেন, "নিষেধাজ্ঞা শিথিল হওয়া না হওয়া এখানে বড় নয়। বরং এখন থেকেই এই ইস্যুটিকে পারস্পরিক স্বার্থ বিবেচনায় রেখে কীভাবে সমাধান খুঁজে পেতে পারি সেটাই দেখতে হবে। তার মতে, শুধু সংবিধান নয়, দেশের বাইরেও জাতিসংঘসহ অন্যান্য যেসব মানবাধিকারের সনদ রয়েছে তা বাস্তবায়নে আমরা দায়বদ্ধ। কাজেই এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে আগামীদিনের পথরেখা ঠিক করতে হবে।"
অর্থনীতিবিদ ড. আনু মুহাম্মদ মনে করেন, "এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কোনো প্রভাব ফেলবে না। তিনি বলেন, এটা তো র্যাব-পুলিশের ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্র কোনো কারণে রাগ হলে সাধারণত এই প্রশ্নটা আসে যে, আমাদের রপ্তানিতে প্রভাব পড়বে। এটা কখনোই হবে না। কারণ রপ্তানির সাথে তো সেখানে ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আছে। তারা কখনো চায় না যে এটা হোক। তাদের লাভের অংশটাই বেশি। রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। এটি চাপ দেয়ার জন্য তারা করেছে। এক্ষেত্রে আমি মনে করি না যে কোনো প্রভাব ফেলবে। আপাতত চাপ দিচ্ছে, কিছু দিন পর দেখা যাবে টেরও পাওয়া যাবে না নিষেধাজ্ঞা উঠে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ধরন এরকমই। এগুলো তারা দেয় এক ধরনের দরকষাকষির জন্য। কাজেই এটি দীর্ঘস্থায়ী কোনো প্রভাব ফেলবে না। কিছুদিন আগে মোদির ক্ষেত্রে যেটা হয়েছিল, সেরকমই হবে।"