প্রতি বছরের মতোই সদ্য অতীত হয়ে যাওয়া ২০১৮ সালটাও ছিল ঘটনাবহুল। তার থেকে ভারত ও পশ্চিমবঙ্গের বাছাই করা কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে ফিরে দেখা।
বিগত বছরে ভারতে সবচেয়ে বেশিবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবরের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন কোনও ব্যক্তি নন, একটি প্রতিষ্ঠান, সুপ্রিম কোর্ট। ভারতের সংবিধান অনুযায়ী গণতন্ত্রের তিনটি স্তম্ভের অন্যতম, বিচার ব্যবস্থার ভার যার ওপর ন্যস্ত। এবং আমরা দেখেছি, শীর্ষ আদালত সেই গুরু দায়িত্ব অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে পালন করতে পেরেছে। ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট অসংখ্য ইতিবাচক রায় দিয়েছে, যেগুলো মানুষের উপকারে আসবে। তার মধ্যে কয়েকটি যুগান্তকারী। যেমন ব্রিটিশ আমলের ভারতীয় ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা বাতিল করে সমকামিতাকে বৈধতা দিয়েছে। বলেছে, সমকাম কিছু মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি..
একই ভাবে বলা হয়েছে, পরকীয়াকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা যাবে না। আরও বলেছে, দুই প্রাপ্তবয়স্কের বিয়েতে নাক গলানোর কোনও অধিকার নেই খাপ পঞ্চায়েতের। পরোক্ষ নিষ্কৃতি মৃত্যুর অধিকারেও সায় দিয়েছে শীর্ষ আদালত। এছাড়া সুপ্রিম কোর্ট মুসলমান নারীদের স্রেফ তিন তালাক দিয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। আর ৪৫-ঊর্ধ্ব মহিলারা পুরুষ সঙ্গী ছাড়াই হজ যাত্রার অনুমতি পেয়েছেন। ওদিকে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, কেরালার শবরীমালা মন্দিরে সব বয়সের মহিলাদের ঢুকতে দিতে হবে। যদিও এই সব রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ আন্দোলন চলছে। তবে ভারতের সাধারণ মানুষের আশা, শেষ পর্যন্ত আইনের শাসন বলবৎ হবে।
পূর্ব ভারতের অসম রাজ্যে নাগরিক পঞ্জী নবীকরণ আর নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন, এই দুইয়ের টানাপোড়েনে গোটা বছর ধরে অস্থিরতা চলেছে। চূড়ান্ত খসড়া তালিকা থেকে ৪০ লক্ষ মানুষের নাম বাদ পড়েছে, যাঁদের অধিকাংশই বাঙালি। এখনও ওই তালিকায় চূড়ান্ত পর্যায়ে ঝাড়াই বাছাই চলছে এবং এখনও ওই সব মানুষের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এর অবশ্যম্ভাবী প্রভাব পড়তে চলেছে পশ্চিমবঙ্গের ওপরে।
বিগত বছরে বিপর্যয়ের সংখ্যাও কম ছিল না। তার মধ্যে কলকাতার দক্ষিণ প্রান্তে মাঝেরহাট ব্রিজ ভেঙে পড়ায় তিন জনের মৃত্যু ছাড়াও ওই দুর্ঘটনায় সড়ক ও রেল যোগাযোগ বিপর্যস্ত হয়ে ওই এলাকার বাসিন্দাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। পর পর অনেকগুলো অগ্নিকাণ্ডের ফলেও কলকাতার অনেক ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে দুর্গাপুজোর আগে বড়বাজারে বাগড়ি মার্কেটের আগুনের রেশ আজও রয়ে গিয়েছে।
গত বছর কিছু নামী লোকের দামি বিবাহ অনুষ্ঠান নিয়ে বেশ চর্চা হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ভারতের ক্রিকেট অধিনায়ক বিরাট কোহলির সঙ্গে বলিউড অভিনেত্রী অনুষ্কা শর্মার বিয়ে, দুই ফিল্ম স্টার রণবীর সিং আর দীপিকা পাড়ুকোনের বিয়ে, প্রিয়ঙ্কা চোপড়া আর নিক জোনাসের বিয়ে এবং সব শেষে ভারতের সবচেয়ে ধনী মুকেশ আম্বানীর মেয়ের বিয়ে। শেষোক্ত অনুষ্ঠানে দেশবিদেশের আমন্ত্রিত ঝলমলে তারকাদের ভিড়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গিয়েছিলেন তাঁর নিজস্ব ট্রেডমার্ক সাদা শাড়ি আর হাওয়াই চটি পরে।
প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সরকারি পর্যায়ে যতই শত্রুতা থাক, গত বছর প্রাক্তন পাক ক্রিকেট ক্যাপ্টেন ইমরান খান সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর মসনদে বসায় এ দেশের ক্রিকেট প্রিয় আম জনতা কিন্তু বেজায় খুশি। ইমরান এদেশেরও হিরো..
বিশ্ব ফুটবলের মাঠে ভারতের কোনও স্থান নেই, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল নিয়ে যতই চেঁচিয়ে গলা ফাটাক, নিজেরা খেলাধূলা করে না, কিন্তু ২০১৮ সালে বিশ্ব ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের খেলা নিয়ে বাঙালির মাতামাতি ছিল অন্তহীন। তবে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় আমাদের সবচেয়ে গর্বিত করেছেন একজন বক্সার। তিনটি পুত্র সন্তানের জননী ৩৫ বছর বয়েসি মণিপুর কন্যা মেরি কম একমাত্র নারী যিনি ছ'বার বিশ্ব অপেশাদার বক্সিং চ্যাম্পিয়নের খেতাব অর্জন করে বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। তাঁর জীবন কাহিনি নিয়ে একটি ফিল্মও হয়েছে, যাতে মেরি কমের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন প্রিয়ঙ্কা চোপড়া।
বিগত বছরে ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গ তার বহু কৃতী সন্তানকেও হারিয়েছে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী সহ সেই তালিকায় আছেন লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, সিপিএমের প্রাক্তন মন্ত্রী অশোক মিত্র ও নিরুপম সেন, অভিনেত্রী শ্রীদেবী ও সুপ্রিয়া চৌধুরী, ধ্রুপদী সঙ্গীত শিল্পী অন্নপূর্ণা দেবী ও বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, কার্টুনিস্ট চণ্ডী লাহিড়ী, চলচ্চিত্র পরিচালক মৃণাল সেন, কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, লেখক রমাপদ চৌধুরী ও গায়ক দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের মতো অনেকেই। এঁরা আর নেই, কিন্তু এঁদের স্মৃতি থেকে যাবে চিরকাল..