বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষেদের ৭৬ তম অধিবেশনে দেওয়া তাঁর ভাষণে করোনাকালের বিপর্যয় মোকাবিলা, জোর করে নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং জলবাযু পরিবর্তন মোকাবিলায় কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের গুরুত্ব প্রসঙ্গসহ বিভিন্ন বৈশ্বিক গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ তুলে ধরেন।
তিনি বলেন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এই ৭৬তম অধিবেশনটি এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন কোভিড-১৯ বিশ্বজুড়ে অব্যাহতভাবে মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। এ মহামারিতে গোটা বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
এ সঙ্কটকালে নিবেদিত সেবা ও আত্মত্যাগের জন্য শেখ হাসিনা সম্মুখসারির সকল যোদ্ধার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তিনি বলেন কোভিড-১৯-এর নির্মম বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে এ অধিবেশনের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘প্রত্যাশা’ অত্যন্ত সময়োপযোগী হয়েছে। শেখ হাসিনা আরও বলেন বহুপাক্ষিকতাবাদ ও জাতিসংঘ ব্যবস্থার দৃঢ় সমর্থক হিসেবে বাংলাদেশ এই সঙ্কটকালে জাতিসংঘকে আশা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে দেখে। সব ধরনের মতভেদ ভুলে গিয়ে আমাদের অবশ্যই ‘অভিন্ন মানবজাতি’ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে;সম্মিলিত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সবার জন্য আবারও এক সমৃদ্ধ বিশ্ব গড়ে তোলার প্রত্যয় প্রকাশ করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
প্রসঙ্গত তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এবং জাতির পিতা শেখ মুজিবর রহমানের জন্ম শত বার্ষিকী উপলক্ষ্যে বলেন জাতির পিতা ছিলেন বহুপাক্ষিকতাবাদের একজন দৃঢ় সমর্থক। তিনি জাতিসংঘকে জনগণের ‘আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্র’ মনে করতেন। আমাদের জাতিসংঘ অভিযাত্রার প্রথম দিনে ১৯৭৪ সালের ২৫-এ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে প্রদত্ত তাঁর ঐতিহাসিক একমাত্র ভাষণে তিনি বলেছিলেন: কোট: “আত্মনির্ভরশীলতাই আমাদের লক্ষ্য। জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও যৌথ উদ্যোগই আমাদের নির্ধারিত কর্মধারা। এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং সম্পদ ও প্রযুক্তিবিদ্যায় অংশীদারিত্ব আমাদের কাজকে সহজতর করতে পারে, জনগণের দুঃখকষ্ট লাঘব করতে পারে”।
শেখ হাসিনা তাঁর ভাষণে বাংলাদেশের উন্নয়নের কয়েকটি দিক উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল পাঁচটি অর্থনীতির মধ্যে অন্যতম। জিডিপি-তে আমরা বিশ্বের ৪১তম। গত এক দশকে আমরা দারিদ্র্যের হার ৩১ দশমিক ৫ থেকে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছি। এ সময়ে আমাদের মাথাপিছু আয় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২,২২৭ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ সর্বকালের সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছি”। নারীর ক্ষমতায়ন সহ সামাজিক অন্যান্য সূচিতে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা তাঁর ভাষণে বলেন গত এক দশকে আর্থ-সামাজিক খাতে ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। শিশুমৃত্যু হার প্রতি হাজারে ২৩ দশমিক ৬৭-এ কমে এসেছে। প্রতি লাখ জীবিত জন্মে মাতৃমৃত্যুর হার ১৭৩-এ হ্রাস পেয়েছে। মানুষের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭৩ বছর। তাছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশ’ উদ্যোগ, ‘সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী’ কর্মসূচির এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রার সূচকে বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে আছে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন। তিন বলেন, এ সাফল্যের মূলে রয়েছে নারীর উন্নতি ও ক্ষমতায়নে বিপুল বিনিয়োগ। বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি জ্ঞানভিত্তিক উন্নত দেশে রূপান্তরিত করার বিষয়ে দেশের স্বপ্নের কথা উল্লেখ করেন।
করোনাভাইরাসের অকষ্মাত্ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলদেশের উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন “অর্থনীতিকে সচল রাখতে বিভিন্ন সময়ে আমরা ২৮টি প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে প্রায় ১ হাজার ৪৬০ কোটি মার্কিন ডলার বরাদ্দ দিয়েছি, যা মোট দেশজ উৎপাদনের ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ। করোনাভাইরাসের টিকা সংগ্রহের জন্য চলতি অর্থবছরে বাজেটে ১৬১ কোটি মার্কিন ডলারের সংস্থান রাখা হয়েছে”।
শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এই ৭৬ তম অধিবেশনে দেওয়া তাঁর ভাষণে তিনি কয়েকটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে প্রায় প্রস্তাব আকারে উপস্থাপন করেন।
প্রথমত, কোভিডমুক্ত একটি বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে টিকার সর্বজনীন ও সাশ্রয়ী মূল্যে প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, এ মহামারি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে অধিকমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তাই তিরি ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলোকে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, নিঃসরণের জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং টেকসই অভিযোজনের জন্য অর্থায়ন ও প্রযুক্তির অবাধ হস্তান্তরের আহ্বান জানান। তৃতীয়ত মহমারির প্রকোপে পড়া শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষতি পূরণের জন্য তিনি ডিজিটাল সরঞ্জামাদি ও সেবা, ইন্টারনেটের সুযোগ-সুবিধার সহজলভ্যতা ও শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করার জন্য জাতিসংঘকে অংশীদারিত্ব ও প্রয়োজনীয় সম্পদ নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। চতুর্থত, তিনি বলেন কোভিড-১৯ অতিমারির নজিরবিহীন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের টেকসই উত্তরণ ত্বরান্বিত করার জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রণোদনাভিত্তিক উত্তরণ কাঠামো প্রণয়নে আরও সহায়তা আশা করেন। পঞ্চমত, তিনি মহামারিকাল অভিবাসীগ্রহণকারী দেশগুলোকে অভিবাসীদের সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত আচরণ করার এবং তাঁদের কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য এবং কল্যাণকে নিশ্চিত করার জন্য আহ্বান জানান। ষষ্ঠত তিনি আবার রোহিঙ্গা সংকটের দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন রাখাইন রাজ্যে তাদের মাতৃভূমিতে নিরাপদ, টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমেই কেবল এ সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান হতে পারে। এ জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই গঠনমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে শান্তি। ‘শান্তির সংস্কৃতি’ প্রস্তাবের প্রধান প্রবক্তা হিসেবে বাংলাদেশ শান্তিময় সমাজ বিনির্মাণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস উগ্রবাদের করাল থাবায় বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে।তাই বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদ ও সহিংসতার বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ বজায় রেখেছে।
ভাষণের শেষে তিনি তাঁর এবং রাষ্ট্রের জীবনের সেই করুণ সময়ের কথা তুলে ধরেন যখন তাঁর পিতা এবং জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয় এবং তিনি ও তাঁর ছোট বোন বিদেশে ছয় বছর প্রায় নির্বাসিত জীবন যাপন করেন।