বাংলাদেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বলেছেন, এশিয়া এখন সারা দুনিয়ার নতুন অর্থনৈতিক শক্তি। আর তার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে চীন এবং ভারত। বাংলাদেশের অর্জনও কম নয়। ওয়াশিংটন ডিসির গবেষণা প্রতিষ্ঠান হাডসন ইনস্টিটিউটে, বাংলাদেশ বিষয়ক এক আলোচনায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
রেহমান সোবহান বলেন, সমগ্র বিশ্বের পরিবর্তন ঘটেছে। আর সেই পরিবর্তনের জোয়ার লেগেছে বাংলাদেশেও। হেনরী কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহিন ঝুড়ি আখ্যা দিলেও আজকের বাংলাদেশ অন্য রকম বাংলাদেশ; বাংলাদেশ আজ আর সাহায্য নির্ভর নয়।
“১৯৭১ সালে আমাদের খাদ্য পন্য উৎপাদন ছিল ১০ মিলিয়ন টন, এখন আমাদের খাদ্য উৎপাদন ৪০ মিলিয়ন টন। খাদ্যে এখন আমরা স্বয়ংসম্পুর্ন। তবে তার মানে এই নয় যে সকলেই প্রয়োজনমত খাদ্য পাচ্ছে। এখানে সরবরাহ সমস্যা রয়েছে। মানব উন্নয়ন সূচকে আমরা অনেক ক্ষেত্রে ভারতের চেয়ে এগিয়ে রয়েছি। আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ভালো। আমরা সারা পৃথিবিতে এখন দ্বিতীয় বৃহত্তম পোষাক রপ্তানীকারক দেশ। আমাদের দেশে একটি চমৎকার উদ্যোক্তা শ্রেনী গড়ে উঠেছে। দুর্ভাগ্যবশত যদিও উদ্যোক্তারা সব সময় ঋন শোধ করে না, ব্যাংকিং সমস্যার সৃষ্টি করে; তবুও তারা ভালো উদোক্তা"।
হাডসন ইনষ্টিটিউটের দক্ষিন ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ও সিনিয়র ফেলো এ্যাম্বাসেডর হুসেইন হাক্কানীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে রেহমান সোবহান বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের আগে থেকে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে তাঁর সম্পৃক্ততা, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন, এবং স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সময়ের অবস্থা বর্ননা করেন। বলেন একাত্তুরের মার্চে ঢাকায় প্রথম যেদিন গোলাগুলি শুরু হয়, আমি ঢাকায় ছিলাম।
“রাতে, আর্মি শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে। পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল, পুলিশ লাইন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা করে। প্রফেসর নুরুল ইসলাম এবং আমি সে রাতে বাড়ীতেই ছিলাম। ২৭ শে মার্চ কার্ফিউ শেষ হয়। আমার এক বন্ধু মহিদুল হাসান আমার বাড়ীতে আসে এবং বলে তোমরা বোকা নাকি? ওরা মানুষ তুলে নিয়ে যাচ্ছে, হত্যা করছে আর তুমি এখানে বসে আছো? সে আমাকে সেখান থেকে তুলে নেয়”।
রাষ্ট্রদূত হাক্কানী বলেন, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় প্রকৃতপক্ষে কি ঘটে চলছিল আমরা খুব ভালো করে বুঝতাম না। পশ্চিম পাকিস্তানি গনমাধ্যমে যে খবর ছাপা হতো তাতে বলা হতো দুবৃত্তরা পূর্ব পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করতে চায়; তাতে ভারতের এজেন্টরা সহায়তা করছে। জামাত মুসলীম লীগের বরাত দিয়ে বলা হতো সাহসী পূর্ব পাকিস্তানীরা ঐসব দুবৃত্তদের প্রতিরোধে যুদ্ধ করছে; পাকিস্তানের নীতি আদর্শ সমুন্নত রাখতে।
“ঐ সময় টাইম ম্যাগাজিন, নিউজউইক বন্ধ করা হয়। বিদেশী রেডও টিভি ছিলনা; শুধুমাত্র বিবিসি ছাড়া। তবে তা ছিল শর্টওয়েভে। শর্টওয়েভে বিবিসি ধরা যেতো না। ফলে আমরা আসলে জানতেই পারিনি বাংলাদেশে কি ঘটছে। ১৬ই ডিসেম্বর যেদিন পাকিস্তানী মিলিটারী আত্মসমর্পন করে সেদিন আমাদের প্রধান পত্রিকা ডনের হেডলাইন ছিল, ভিক্টরী অন অল ফ্রন্টস”।
যে কঠোর সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তুমুল যুদ্ধের পর শত সহস্র লক্ষ মানুষের জীবনের বিনিময়ে বাংলাদেশের সৃষ্টি হলো সেই দেশের কাংখিত স্বপ্ন পূরনে কতোটা সফল হয়েছে, স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর; এ প্রশ্নে তিনি বলেন রাজনীতি, অর্থনীতিসহ বাংলাদেশ নানা সমস্যা ও সংকটের সামনে পড়লেও বিভিন্ন ক্ষেত্র আর্জনও প্রশংসা করার মতো।
প্রশ্নোত্তর পর্বে রাফায়েত হক নামে একজন প্রশ্ন করার আগে এক মন্তব্য বলেন বাংলাদেশে বানিজ্য সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করতে পরারছে না সরকার, যার ফলে ঋন খেলাপী বাড়ছে। তিনি জানতে চান আওয়ামি লীগ কেনো আইসিস আল কায়েদার অস্তিত্ব অস্বীকার করছে।
জবাবে রেহমান সোবহান বলেন, “এটা বাস্তব যে বাংলাদেশে মৌলবাদী শক্তি রয়েছে। আর এখন এমন একটি সময় চলছে বিভিন্ন স্থানে এর সঙ্গে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী এটি রাজনীতির অংশ হয়ে গেছে”।
ব্লগার ও হিন্দু খ্রিষ্টান বৌদ্ধসহ মাইনরিটি অধিকার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ইসলামকে প্রধান ধর্ম বাদ দেয়ার কথা ওঠে; তার বিরুদ্ধ অনেকেই তখন বাংলাদেশে প্রতিবাদ করে। সাম্প্রতিক সময়কার সন্ত্রাসগুলোর সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক আছে কি?
অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, “বাংলাদেশের মূল সংবিধানে চার মূলনীতির মধ্যে একটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। ফলে সংবিধানে ইসমলাম বাদ দেয়া বা সংখ্যালঘুদের অধিকারের জন্যে সন্ত্রাস হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না। এর পেছনে আরো বহু বিষয় জড়িত থাকতে পারে”।
মরিন নামে এক আমেরিকান নারী রেহমান সোবহানের উদ্দেশ্যে বলেন, “বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল, রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট, আন্তর্জিতক সম্প্রদায়ের এই অভিযোগের ভিত্তিতে আপনার মত কি?”
রেহমান সোবহান বলেন, “যুদ্ধাপরাধ যারা করেছে তাদের বিচারের ব্যাপারে কোনো দ্বিমত বা বিতর্ক নেই। তারা অপরাধ করেছে সেটা সত্যা। তবে বিচারের যে ধারবাহিক পদ্ধাতির কথা বলা হচ্ছে সেটি নিয়ে কথা বলা যায়।
“তা খুব লম্বা আইনী প্রক্রিয়া; যা এখনো চলছে। কতোটুকু কি হলে তার আন্তর্জাতিক মানসম্মত হয় বা না হয়, সেটি আমি বলতে পারবো না। তা বলতে পারবেন এ সংক্রান্ত আইনজীবিরা। তবে এতে অনেক সময় লাগে অনেক তথ্য সংগ্রহ করতে হয় সেটুকু জানি”।
গত কয়েক মাসে বাংলাদেশে ব্লগার অভিজিত রায়সহ লেখক সাংবাদিক মারা গেছেন। সন্ত্রাসসহ বহু ঘটনা ঘটে চলেছে সম্প্রতি। তরুনেরা সামাজিক মাধ্যমে এক একটা ইসুতে তাৎক্ষনিকভাবে জেগে উঠছে আবার কিছুদিন পর ভুলে যাচ্ছে। এই অবস্থায় বর্তমান প্রজন্মের সঙ্গে আগের প্রজন্মের ফারাকটা কোথায়; এমন প্রশ্নে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, "আমাদের সময় তরুনদের রাজনীতিসহ সমাজ সংসারের প্রায় সব ক্ষেত্রে শক্ত অবদান ছিল। আর তারুন্যের একটা বৈশ্বিক স্বভাব আছে"।
তিনি বলেন, "এখনো বহু আদর্শবাদী তরুন তরুনী রয়েছেন যারা নির্দিষ্ট বিশেষ বিশেষ ঐতিহাসিক মুহুর্তে জাগ্রত হন। যেমন গত কিছুদিন আগেও আমরা দেখেছি শাহবাগে তরুনদের আন্দোলন। অন্য সময়েও এমন হয়েছে। বাংলাদেশের তরুনেরা একত্রিত হয়েছিল”।
তিনি তারুন্যের শক্তিতে ভরপুর বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সাফল্য কামনা করেন।