এ বছর পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা মহামারী ব্যাখ্যা করার সময় “নজীরবিহীন” শব্দটি বার বার আমার শুনেছি। সত্যি তাই, এই রোগে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার এবং সংক্রমিত হয়েছে প্রায় ২০ হাজারের মত মানুষ।
পশ্চিম আফ্রিকার সীমন্ত সংলগ্ন এক দেশ থেকে অন্য দেশে ইবোলা ছড়িয়ে পরে যা বিশ্বব্যাপী আতংক সৃষ্টি করেছে।
এবছর পশ্চিম আফ্রিকা সংলগ্ন সীমান্ত পারা পার পথ এবং বিমান বন্দরে দেহের তাপমাত্রা পরিক্ষা করা একটি স্বাভাবিক ঘটনা কারন ইবোলা আক্রান্ত হবার সবচাইতে প্রথম লক্ষণ হচ্ছে দেহের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া।
পশ্চিম আফ্রিকার গিনি, সিয়ারা লিয়ন এবং লাইবেরিয়াতে সবচাইতে বেশি মানুষ ইবোলায় আক্রান্ত হয়েছে। ঐ সবদেশের মানুষ এখন আলিংগন বা করমর্দন করতে করতেও ভয় পান। আগে অসুস্থ হলে বা কেউ মারা গেলে প্রচলিত প্রথায় মানুষ যে ভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করত তা করতে বারণ করা হয়েছে।
ইবোলায় আক্রান্ত রোগীর দেহ নিঃসৃত যে কোন তরল পদার্থ থেকে এ রোগ ছড়ায়।
২০১৩ সালের ডিসাম্বর মাসে গিনির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে প্রথম এই রোগ দেখা দেয়। পশ্চিম আফ্রিকী অঞ্চলে এ মহামারী এখনো নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নী। ইবোলা ভাইরাসটি সনাক্ত করা যায় এই রোগ শুরুর হবার বেশ কয়েক মাস পরে। গিনির রাজধানী কোনাকরিতে ইবোলা ছড়ানোর পর সিয়ারা লিয়ন এবং লাইবেরিয়া ছড়াতে শুরু করে এবং জুন মাস থেকে তা মহামারির মত ছড়িয়ে পড়ে।
পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা রোগটি নতুন এবং এ বিষয়ে প্রচুর ভয় ভীতি এবং বিভ্রান্তিও ছিল।
মনরোভিয়ার এক অধিবাসী জানালেন, মনরোভিয়ায় কিছু মানুষ এই রোগের চিকিতসা পদ্ধতি এবং ইবোলায় মৃতদের সতকা ও সমাধিস্ত করার নিয়ম কানুন নিয়েও অনেকেই বিরোধীতা করে। মনরোভিয়ায় এ নিয়ে দাংগাও হয়েছে, সরকার এই পরিস্থিতি সামাল দিতে আক্রান্ত কিছু এলাকা একেবারে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। সরকার শিক্ষা মূলক কার্যক্রমও সেখানে বৃদ্ধি করেছে। রাস্তায় রাস্তায় সাইন বোর্ড লাগানো হয়েছে। যাতে মানুষ পড়ে এ বিষয়টি জানতে পারে।
স্বাস্থ্য কর্মীরা রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানুষকে এই রোগের লক্ষণগুলো লোকজনকে জানায়। এমন কি বাড়ীতে গিয়ে তারা ইবোলায় আক্রান্ত হতে পারে এমন লোক জনেরও সন্ধান করে চিকিতসা করে।
মোনরোভিয়ার এক স্বাস্থ্যকর্মী বললেন, ইবোলা সংক্রমণ রোধ করার জন্য অসুস্থদের অবশ্যই আলাদা করে রাখতে হবে আক্রান্তদের চিকিতসা করাতে হবে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের দিয়ে এবং তাদেরকে অবশ্যই আপাদমস্তক ঢাকা সংরক্ষণ মূলক পরিচ্ছদ পরাতে হবে।
তবে এই ধরণের সুরক্ষা মূলক পদক্ষপ সব সময় বজায় রাখা সম্ভব হয়নী। কারন ঐসব দেশে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য পরিসেবা আগে থেকেই ছিল না। ফলে ইবোলার কারনে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আরো ধ্বসে পড়ে।
সিয়ারা লিয়নের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডঃ আবু বাকার ফোফানা বলেন, “এ দেশে ৬০ লক্ষ মানুষের বাস। যখন এই সংক্রমণ মাহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়ে তখন আমাদের কাছে কতগুলো এম্বুল্যান্স আছে সেটাও আমি আংগুলে গুনে বলে দিতে পারব। এছাড়া দেশেটির ভূপ্রকৃতি খুবই দূর্গম।”
সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে মনরোভিয়ায় প্রতি তিন সপ্তাহে ইবোলায় আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। হাসপালগুলোতে পর্যাপ্ত শয্যা এবং কর্মচারী না থাকায় সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়।
লাইবেরিয়ার স্বাস্থ্য কর্মী জ্যাকসন নিয়ামা ডক্টোরস উইথআউট বোর্ডাসের জন্য কাজ করেন। তিনি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষোদে টেলিকনফারেন্সে যোগ দেন।
তিনি বলেন, “আমাদের দরজায় এসে যারা প্রাণ হারাচ্ছেন সেইসব মানুষের দিক থেকে আমরা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছি। এই মুহুর্ত্বে আমি যখন কথা বলছি তখন আমাদের দরজার সামনে মানুষজন তাদের প্রাণ ভিক্ষা চাইছে। আন্তর্জাতিক সমাজ এগিয়ে না আসলে আমরা নিঃশ্চিহ্ন হয়ে যাব।”
জাতি সংঘ ঐ অঞ্চলে ইবোলা মিশন শুরু করেছে। আমেরিকা লাইবেরিয়াতে ৩ হাজার সেনা পাঠিয়েছে এবং ইবোলায় আক্রান্তদের চিকিতসায় ইবোলা ইউনিটও তৈরী করেছে। অক্টোবর মাসে প্রথম আন্তর্জাতিক ভাবে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায় এবং তা ২০১৫ সাল পর্যন্ত এই কার্যক্রম চলবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সামনে এখনও অনেক ক’মাসের কাজ বাকী রয়েছে।
এ বছর, ইবোলায় লাইবেরিয়ায় প্রাণ হারিয়েছে মোট সংখ্যার প্রায় অর্ধেক আর বাদবাকি মারা গেছে গিনি ও সিয়ারা লিয়নে।
পশ্চিম আফ্রিকায় ৩৫০জন স্বাস্থ্য কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। সিয়ারা লিয়নের ৩জন ডাক্তার মারা যায়। তবে এই সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইএ অগ্রগতিও হয়েছে।
এ বছর, যারা চিকিতসা পেয়েছে তাদের ৪০ শতাংশ প্রাণে রক্ষা পেয়েছে। সেনেগাল এবং নাইজেরিয়া দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ায়র ফলে ঐ সংক্রমণ রোধ করা গেছে।
বিশ্বব্যাপী ইবোলা সংক্রমণের টিকার এবং অষুধ, সম্ভাব্য রোগ প্রতিষেধক নিয়ে পরীক্ষানিরিক্ষা প্রায় শেষে হয়ে এসেছে। আর খুব শিঘ্রীই যে রোগ প্রতিকার করা যাবে সে আশা ক্রমশই আরও উজ্বল হচ্ছে।