বসন্তের দিন মিলেছে ভালোবাসায়

ক্যালেন্ডারের ওপর ভালবাসার প্রতীক। (ছবি- অ্যাডোবি স্টক)

পয়লা ফাল্গুন বাঙালির বসন্ত উৎসবের দিন। এ বছর বিশ্ব ভালোবাসা দিবসও এই দিনে। বাংলা বর্ষপঞ্জির পয়লা ফাল্গুন আর গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকার ১৪ ফেব্রুয়ারি মিলে গেছে। তাই বসন্ত উৎসব আর ভালোবাসা দিবস মিলেমিশে একাকার। সোমবার সেই দিন— পয়লা ফাল্গুন, বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। আর ভালোবেসে মনের মন্দিরে প্রিয়জনের নামটি লেখার দিনটিও এদিনই—১৪ ফেব্রুয়ারি, ভ্যালেন্টাইন ডে।

প্রচলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি সংস্কার করে ত্রুটিমুক্ত ও বিজ্ঞানসম্মত করে গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির সঙ্গে সমন্বয় করেছে বাংলা একাডেমির পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি। এর ফলেই এ বছর থেকে পয়লা ফাল্গুন আর ভালোবাসা দিবস একই দিনে পড়ছে।

বাংলা একডেমির বাংলা একাডেমির অভিধান ও বিশ্বকোষ উপবিভাগের কর্মকর্তা রাজীব কুমার সাহা ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানান, এই সম্বয়ের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, “মহান ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল ৮ ফাল্গুন। কিন্তু সাধারণত ২১ ফেব্রুয়ারি পড়ত ৯ ফাল্গুন। একইভাবে মহান বিজয় দিবস ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ছিল পয়লা পৌষ, বাংলা পঞ্জিকায় দিনটি পড়ত ২ পৌষ। কবিগুরুর জন্মদিন ২৫ বৈশাখ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন ১১ জ্যৈষ্ঠ গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির সঙ্গে মিলত না। এই বিশৃঙ্খলা দূর করে দুই বর্ষপঞ্জির মধ্যে দিন গণনার সমন্বয় করা হয়েছে। ফলে এখন থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি ৮ ফাল্গুন, স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ ১২ চৈত্র, বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর পয়লা পৌষ, রবীন্দ্রজয়ন্তী ৮ মে ২৫ বৈশাখ, নজরুল জয়ন্তী ২৫ মে ১১ জৈষ্ঠ এমন করে সব বিশেষ দিবসগুলো বাংলা ও গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির দিন গণনায় অভিন্ন হচ্ছে। গত ২০১৯ সাল থেকে দুই পঞ্জিকার এই সমন্বয় করা হয়েছে। আগে পয়লা ফাল্গুন পড়ত ফেব্রুয়ারির ১৩ তারিখে, আর ভ্যালেন্টাইন ডে বা বিশ্ব ভালোবাসা দিবস পরের দিন । এখন পঞ্জিকা সংস্কার করায় পয়লা ফাল্গুন ও ভালোবাসা দিবস একই দিনে পড়ছে।”

বসন্তু যৌবনের দূত, নবজীবনের প্রতীক। ঋতুরাজ বলে তার খ্যাতি আবহমানকাল থেকে। শীতের ঘনঘোর কুয়াশায় আবছা হয়ে আসা দিগন্তরেখা, কনকনে হাওয়ায় রুক্ষ হয়ে ওঠা মৃতপ্রায় প্রকৃতিতে বসন্তু ফিরিয়ে আনে নতুন কুঁড়ির উদ্যম। নুতন কুঁড়ি, নুতন পাতায় সবুজ সজীব হয়ে ওঠে মলিন নিসর্গ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার গানে লিখেছিলেন, “হেরো পুরানো প্রাচীন ধরণী হয়েছে শ্যামলবরনী/ যেন যৌবনপ্রবাহ ছুটেছে কালের শাসন টুটাতে...মধুর বসন্ত এসেছে মুধুর মিলন ঘটাতে।”

মানুষের হৃদয়েও পড়ে প্রকৃতির এই নবজগরণের প্রভাব। চিত্ত আকুল হয় প্রিয় অনুভবে, ব্যকুল হয় প্রিয়জনের সান্নিধ্য পেতে। আবেগ উথলে ওঠে গহন স্বরে হৃদয়ের গোপন গভীর না বলা কথাটি বলতে। আজ তো সেই হৃদয়ের দুয়ার খুলে দেওয়ার দিন।

ওদিকে পশ্চিমা রীতির ভ্যালেন্টাইন ডে বা ভালোবাসা দিবসও বেশ কয়েক বছর থেকে আমাদের দেশে ঘটা করে উদযাপিত হয়ে আসছে। বিশেষত তরুণ প্রজন্ম এই দিনটি বেছে নিয়েছে তাদের মনের মানুষের কাছে প্রণয়ের কথা নিবেদনের জন্য। উপহার দেওয়া, একসঙ্গে বাইরে ঘুরে বেড়ানো, কোথাও খেতে যাওয়া— অতপর সেই পরম রোমাঞ্চকর মুহূর্ত, সেই চিরপুরাতন আবেগের চিরকালের নতুন কথাটি জানিয়ে দেওয়া—আমি তোমায় ভলোবাসি। এই তো, ভালোবাসায় বন্দী হতে পারলে কে আর তা থেকে মুক্তি পেতে চায়।

ভালোবাসার উপহারে মধ্যে প্রথম অবস্থান ফুলের। দেশে এক দিনে সবচেয়ে বেশি ফুল বিক্রিও হয় এই ভালোবাসা দিবসে। আগে ১৩ ফেব্রুয়ারিতে পয়লা ফাল্গুন এবং পরদিন ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন ডে পড়ত। ফুল উৎপাদক ও বিক্রেতাদের কেন্দ্রীয় সংগঠন বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ইমামুল হোসেন ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানালেন, পয়লা বসন্তে ঢাকায় প্রায় ১০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়। ভ্যালেন্টাইন ডেতে সারা দেশে প্রায় ৯০ থেকে ১০০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়। কেবল ঢাকাতেই বিক্রি হয় প্রায় ৫০ কোটি টাকার ফুল। তবে এবার বসন্ত ও ভালোবাসা দিবস এক সঙ্গে পড়ায় মোট বিক্রির পরিমাণ কম হবে। এক দিনে বিক্রির দ্বিতীয় স্থানে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। সারা দেশে এ উপলক্ষে প্রায় ৬০ কেটি এবং ঢাকাতে প্রায় ৩০ কোটি টাকার বিক্রি হয়।

দেশের ফুল উৎপাদন, চাষাবাদ ও বিক্রির হিসাবও জানালেন তিনি। সারা দেশে গড়পরতা সাড়ে সাত হাজার হেক্টর জমিতে ফুলের বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে। বাৎসরিক ফুল বিক্রির পরিমাণ ১২শ থেকে ১৫শ কোটি টাকা। প্রায় ৩০ জাতের ফুলের চাষ হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয় গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা, রজনীগন্ধা ও গ্লাডিওলাস। প্রায় ২০ হাজার চাষী ফুল চাষে যুক্ত, আর উৎপাদন থেকে বিক্রি অবধি ফুল বাণিজে যুক্ত লোকসংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ। এবার ফুলের উৎপাদন বেশ কম হয়েছে। তাই খুচরা পর্যায়ে দাম পড়বে চড়া। ভালো জাতের গোলাপ প্রতিটি ৫০ টাকার কমে কেনা যাবে না। কারণ পাইকারিতেই প্রতিটি ২৫ টাকা থেকে ৪০ টাকা হিসাবে বিক্রি হবে।

১৪ ফেব্রুয়ারি বাসন্তী শাড়ি, হলুদ পাঞ্জাবিতে সুসজ্জিত নানাবয়সী নরনারী ফুল নিয়ে পথে নামবেন। বসন্ত উৎসব হবে সকাল সাতটা ১৫ মিনিটে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্মুক্ত মঞ্চে। গত ২৭ বছর ধরে পয়লা ফাল্গুনে রাজধানীতে বসন্ত উৎসবের আয়োজন করে আসছে জাতীয় বসন্ত উৎযাপন পরিষদ। বসন্ত নিয়ে আলোচনা, আবৃত্তি, সংগীত ও নৃত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে দিনভর এই উৎসবে পারস্পারিক প্রীতির বন্ধন হিসেবে রাখীবন্ধন পড়ানো হয়।

উৎসব উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “কোভিড–১৯ অতিমারির কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবার খুব সংক্ষিপ্ত আয়োজনে হবে এবারের বসন্ত উৎসব। প্রতি বছরের মতো এবার উত্তরা, ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবর মঞ্চ এবং পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে বসন্ত উৎসব হবে না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্মুক্ত মঞ্চেও শুধু সকালবেলায় একটি অধিবেশন হবে। শুরু হবে এসরাজে বাসন্তি রাগ পরিবেশনার ভেতর দিয়ে। এরপরে বসন্ত কথন, আবৃত্তি, একক ও দলীয় সংগীত ও নৃত্য এবং শিশুদের পরিবেশনা থাকবে। বিকেল কোনো অনুষ্ঠান থাকবে না।

করোনার অতিমারিতে মানুষের জীবনযাপনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। মুখ ঢাকতে হয়েছে মাস্কে। তফাতে থাকতে হচ্ছে পরস্পরের। মাঝে মাঝেই আসছে জনসমাগমস্থল এড়িয়ে চলার আদেশ, বড় সামজিক উৎসব আয়োজনে নিষেধাজ্ঞা। এমনকি এই নিদারুণ মহামারির কোপ থেকে বাঁচতে ঘরবন্দীও থাকতে হয়েছে দিনের পর দিন। বিচ্ছিন্নতাই যেন এক অনিবার্য নিদান হয়ে উঠেছে এই বিপন্ন সময় অতিক্রমের। কিন্তু মানুষ তো সমাজ, পরিবার, প্রিয়জনের সান্নিধ্য ছাড়া—সত্যিকারের বাঁচা বলতে যা বোঝায়, সেভাবে কেমন করে বেঁচে থাকবে!

দীর্ঘ শীতের পরে প্রকৃতিতে আসছে প্রাণস্পন্দন জাগানিয়া উষ্ণ বসন্ত। কুয়াশার ঘনঘোর সরিয়ে দিতে আসছে ফাল্গুনের সোনালি রোদ, দক্ষিণের বাঁধনহরা উতল হাওয়া। আশা থাকুক এই রোদ, এই উষ্ণতা, এই বিপুল প্রাণের স্পন্দনে অতিমারির পরাক্রম মুক্ত হবে প্রকৃতি ও পরিবেশ। কেটে যাবে দেহমনের সকল জড়তা, অবসাদ। অতিমারি অনেক কিছুই হয়েতো বদলে দিয়েছে, কিন্তু মানুষের চিরন্তন আবেগ বদলায়নি। এই বসন্ত দিনে সেখানে ভালোবাসার প্রসুন প্রস্ফুটিত হবেই।