করোনা ঝুঁকির মধ্যেই কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে লাখ লাখ পর্যটকের ভিড়

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে পর্যটকদের ভিড়

বাংলাদেশের কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত এখন পর্যটকে ভরপুর। কোথাও তিল পরিমাণ জায়গা খালি নেই। ট্যুরিস্ট পুলিশ ও হোটেল মালিকেরা বলছেন, গত তিন দিনে সৈকত ভ্রমণে এসেছেন ৩ লাখের বেশি পর্যটক। করোনা ঝুঁকির মধ্যেও লাখ লাখ পর্যটক সমুদ্রসৈকত ভ্রমণের পাশাপাশি ছুটছেন বঙ্গোপসাগরের মধ্যে ৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সেন্টমার্টিন দ্বীপ ও পাহাড়-ঝরনার পার্বত্য জেলা বান্দরবান ও রাঙামাটির দিকে। তিন জেলার সাগর, নদী, পাহাড়, ঝরনার মিশেল যেন পর্যটকদের দিচ্ছে বাড়তি আনন্দ। ভ্রমণকে করে তুলছে উৎসবমুখর।

১৯ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টার দিকে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে একসঙ্গে জড়ো হয়েছেন হাজার হাজার মতো পর্যটক। তাদের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। তারা এসেছেন ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী ও কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। সৈকতের কলাতলী, সিগাল, লাবনী ও শৈবাল পয়েন্টেও দেখা গেল আরও প্রায় ২০ হাজারের মতো পর্যটককে।

পর্যটকদের বেশির ভাগ ঠান্ডা উপেক্ষা করে সমুদ্রের লোনা জলে শরীর ভেজাচ্ছেন। কেউ দ্রুতগতির ওয়াটার বাইক “জেডস্কি” দিয়ে ঘুরে আসছেন সাগরে বিশাল জরলাশি থেকে। কেউ টায়ারে গা ভাসিয়ে ঢেউয়ের সঙ্গে দুলছেন। এত আনন্দ–উচ্ছাসের মধ্যে তারা ভুলে গেছেন করোনা মহামারির স্বাস্থ্যবিধির কথা।

দুপুর সোয়া ১২টার দিকে সৈকতে সিগাল পয়েন্টে গোসলে নামেন রাজশাহীর আম ব্যবসায়ী খলিলুর রহমান। তার মুখে মাস্ক নেই। তার আশপাশে দাঁড়িয়ে হাজারো মানুষ। তাদের অধিকাংশের মুখেও মাস্ক নেই।

খলিলুর রহমান (৫৪) ভয়েস অফ আমেরিকার এই প্রতিবেদকে বললেন, “কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত হচ্ছে স্বাস্থ্যকর এলাকা। অসুস্থ্ মানুষজন শরীর–মন ভালো করার জন্য এখানে (কক্সবাজার) ছুটে আসেন। তা ছাড়া উন্মুক্ত সৈকতে করোনা ঝুঁকি থাকার কথা না। এ কারণে অনেকেই মুখে মাস্ক পরেন না। তবে সবার সুরক্ষায় প্রত্যেকের মুখে মাস্ক থাকা অথবা মাস্ক পরে সৈকতে নামা উচিত।”

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত

সৈকতের কলাতলী থেকে লাবনী পয়েন্ট পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার সৈকতে দেখা গেল বিপুলসংখ্যক পর্যটকের সমাগম। পর্যটকের সংখ্যা ৬০-৭০ হাজারের কম নয়। সামাজিক দূরত্বও ঠিকমতো মানা হচ্ছে না। পরিস্থিতি সামাল দিতে শতাধিক ট্যুরিষ্ট পুলিশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মহিউদ্দিন ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “করোনা সংক্রমণ স্বাভাবিক হয়ে আসাতেই হঠাৎ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষজন অবকাশ যাপনে কক্সবাজার ছুটে আসছেন। এই তিন দিনে ভ্রমণে আসা অন্তত তিন লাখ পর্যটকের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ২১০ জন ট্যুরিষ্ট পুলিশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।”

কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ৮৪ কিলোমিটারের মেরিন ড্রাইভ, মেরিন ড্রাইভের দুই পাশের দরিয়ানগর, হিমছড়ি, ইনানী, টেকনাফ সৈকত, এরপর সেন্ট মার্টিন দ্বীপ এবং ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক ভ্রমণেও পর্যটকের নিরাপত্তা দিচ্ছে ট্যুরিষ্ট পুলিশ।

কক্সবাজার শহর ও সৈকত এলাকায় গত এক দশকে গড়ে উঠেছে পাঁচ শতাধিক আবাসিক হোটেল, গেস্টহাউস, রিসোর্ট ও কটেজ। সবগুলো মিলে ধারণক্ষমতা ১ লাখ ৬০ হাজার মানুষের। হোটেল ও রেস্তোরাঁ মালিকদের সংগঠন আছে সাতটি। সবগুলো সংগঠনের সমন্বিত মোর্চা “ফেডারেশন অব ট্যুরিজম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ”–এর সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “শনিবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) শহরের পাঁচ শতাধিক হোটেল, মোটেল ও গেস্টহাউসে অবস্থান করছেন ৯০ হাজারের বেশি পর্যটক। কয়েক শ বাসে এসেছেন আরও ৫০ হাজারের মতো পর্যটক। গত দুই দিনে (বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার) ভ্রমণে আসেন প্রায় দুই লাখ। সব মিলিয়ে গত তিন দিনে সৈকত ভ্রমণে এসেছেন তিন লাখের বেশি পর্যটক। এর মধ্যে দৈনিক প্রায় ১০-১২ হাজার পর্যটক সেন্ট মার্টিন দ্বীপ এবং ৭ হাজার পর্যটক বান্দরবান–রাঙামাটি ভ্রমণে যাচ্ছেন। আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পর্যটকের এই চাপ থাকবে।”

তবে কয়েকজন পর্যটক অভিযোগ করেন, মানুষের উপচে পড়া ভিড়ের অজুহাতে হোটেলকক্ষের ভাড়া অতিরিক্ত হারে আদায় করছেন মালিকেরা। আবার রেস্তোরাঁগুলোতেও খাবারের দাম বেশি নেওয়া হচ্ছে। সমুদ্রের লোনা জলে গোসল, গোড়ার পিঠে-বিচ বাইকে চড়ে বালুচরে দৌঁড়ঝাঁপ, সন্ধ্যার পর হোটেলে গিয়ে রাত কাটানো ছাড়া কক্সবাজারে বিনোদনের তেমন কিছু নেই। সৈকত তীর এলাকায় তারকামানের কয়েকটি হোটেল থাকলেও সেখানে বিনোদনের কিছু নেই।

সমুদ্রসৈকতে হঠাৎ বিপুলসংখ্যক পর্যটকের উপস্থিতিতে করোনা ঝুঁকি বাড়াতে পারে, এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে জেলার সিভিল সার্জন মাহবুবুর রহমান ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “গেল জানুয়ারির মাঝামাঝিতে শহরে করোনা সংক্রমণ বেড়ে গিয়েছিল। এখন কিছুটা কমতে শুরু করেছে। এমন পরিস্থিতিতে সৈকতে পর্যটকের ভিড় সংক্রমণ বৃদ্ধি পেতে পারে। করোনা ঝুকি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের বিকল্প নেই। সমুদ্রসৈকতে নামতে পর্যটকের মুখে মাস্ক পরা বাধ্যতামুলক করা হয়েছিল। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে পর্যটকদের সচেতন করতে প্রচারণাও চালাচ্ছে। কিন্তু পর্যটকের সংখ্যাটা লাখ ছাড়িয়ে গেলে সে ক্ষেত্রে উন্মুক্ত সৈকতে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।”