নারীর পোশাক ভাবনা

ভিন্ন ভিন্ন পোষাকে নারী। (ছবি- অ্যাডোবি স্টক)

ভৌগলিক ও পরিবেশগত অবস্থান, সংস্কৃতি, ধর্মীয় ও সামাজিক অবস্থান, ব্যক্তিত্ব, রুচি, ফ্যাশন সবকিছুই একজন মানুষের পোশাককে প্রভাবিত করে। শুধু শরীর ঢাকার জন্য নয়, মানুষ পোশাক পরে নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপনের জন্য। নারীর পোশাক নিয়ে বিতর্ক বহু বছর ধরেই চলছে। বারবারই নারী কোথায় কী ধরণের পোশাক পরবে, সেটা তার ওপর আরোপ করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

সম্প্রতি ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে মুসলিম শিক্ষার্থীদের হিজাব পরে ক্লাসে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক চর্চা হয়েছে। তবে এই চর্চা নতুন নয়। ২০২০ সালে ঢাকায় বোরকা পরিহিত এক নারীর সাথে তার সন্তানের ক্রিকেট খেলার দৃশ্য একটি সংবাদপত্রে প্রকাশ হওয়ার পর তা নিয়ে শুরু হয় চর্চা। যে চর্চায় সন্তানের সাথে ক্রিকেট খেলাকে ছাপিয়ে গেছে নারীর পরনের বোরখা। আবার ২০১৯ সালে বাংলাদেশের এক টিভি চ্যানেলের একজন সংবাদ পাঠিকার শাড়ির সাথে পড়া স্লিভলেস ব্লাউজও ছিলো আলোচনার তুঙ্গে। তারও আগে, ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলে ছাত্রীদের জন্য নোটিশ দেয়া হয়েছিলো, “ছাত্রীরা হলে অশালীন পোশাক (সালোয়ারের ওপর গেঞ্জি) পরে ঘোরাফেরা করতে পারবে না।” সেই নোটিশ নিয়েও দেখা গিয়েছিলো অনেক মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

পোশাকের ভাবনা নিয়ে ভয়েস অফ আমেরিকা কথা বলেছে কয়েকজন নারীর সঙ্গে। এদের প্রত্যেকেই বিভিন্ন ধরণের পোশাকে অভ্যস্থ ও ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক অবস্থানে রয়েছেন। তাদের ভাষাতেই তুলে ধরা হলো পোশাক নিয়ে তাদের ভাবনা, অভিজ্ঞতা ও নারী দিবসের প্রত্যাশার কথা।

রোকসানা পারভীন স্মৃতি

উপপরিচালক, বিক্রয় ও বিপনন বিভাগ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা

আমি আমার অবস্থান থেকে খুব ভেবেচিন্তেই পোশাক নির্বাচন করি। কোথায় কোন পোশাকটা পরতে হবে সেই বিষয়ে সাধারণ জ্ঞান আমার আছে।

রোখসানা পারভীন স্মৃতি শাড়ি পরতেই স্বচ্ছন্দ। জানালেন, “আমি যখন চাকরি জীবনে প্রবেশ করি তখন আমার বয়স খুব কম ছিলো। একাডেমির বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব পালন করতে হতো, মেলার সময় তথ্যকেন্দ্রে ডিউটি পড়তো।

রোকসানা পারভীন স্মৃতি, উপপরিচালক, বিক্রয় ও বিপনন বিভাগ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।

তখন বেশিরভাগ সময় সালোয়ার কামিজ, টপস পরতাম। কাজ করতে গিয়ে একটা অস্বস্তি হতো। অফিসের উর্ধ্বতন কিংবা বাইরে থেকে যারা আসতেন অনেকেই ‘তুমি’ সম্বোধন করতেন, নাম ধরে ডাকতেন। সবসময় এই সম্বোধন ভালো লাগতো না। মনে হতো হয়তো আমাকে ছোট মনে করেই এধরণের সম্বোধন করা হচ্ছে। একটু যাতে বড় দেখায়, কাজের পরিবেশের সাথে, দায়িত্বের সাথে মানানসই দেখায় সেই ভাবনা থেকেই আস্তে আস্তে কর্মক্ষেত্রে শাড়ি পরা শুরু করি। দেখলাম, শাড়িতে প্রাপ্তবয়স্ক দেখাচ্ছে, কেউ চট্ করেই ‘তুমি’ সম্বোধন করছেন না। এই সুবিধাটা নিতে গিয়েই আসলে বাড়ির বাইরে শাড়ি পরা শুরু। একসময় শাড়ি পরে চলাফেরাতে অভ্যস্থ হয়ে গেলাম। শাড়ি পরে রাস্তাঘাটে চলাফেরায় কখনো কোনো সমস্যা হয়নি। তবে রাস্তা পারাপার ও রিকসায় চড়ার ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা এড়াতে শাড়ির আঁচল সামলে চলতে হয়। শাড়ি পরার স্টাইল নিয়েও কখনও কখনও বিরূপ মন্তব্য শুনতে হয়েছে। কিন্তু আমি এ ব্যাপারগুলোকে খুব বেশি পাত্তা দেই না। পোশাকের ব্যাপারে আমার ইচ্ছা, আমার ভালো লাগাটাই মুখ্য। কী পোশাক পরতে হবে, কিভাবে শাড়ি পরতে হবে সেটা আমি নিজেই ভালো বুঝি।

নারীর পোশাকের ক্ষেত্রে আমার অবস্থান হলো, একজন নারী কী পরবেন সেটা সম্পূর্ণই তার অভিরুচির ওপর নির্ভর করে। আমি আমার অবস্থান থেকে খুব ভেবেচিন্তেই পোশাক নির্বাচন করি। কোথায় কোন পোশাকটা পরতে হবে সেই বিষয়ে সাধারণ জ্ঞান আমার আছে। আমি নিশ্চয়ই মিলাদের অনুষ্ঠানে মিনি স্কার্ট বা লাল শাড়ি পরে যাবো না। তেমনি আমি মনে করি বেশিরভাগ নারীরই এই পোশাকজ্ঞান তৈরি হয়ে যায়, যে জানে কোথায় কোন পোশাকটি পরবে। তারপরও যেহেতু পোশাক সম্পূর্ণই ব্যক্তিগত ব্যাপার, তাই অন্য কেউ কী পরলো সেখানে হস্তক্ষেপ করাটা আমি পছন্দ করি না।

নারী দিবসের চাওয়া হলো, সবার জন্য নিরাপত্তা। নারীদের কাজের ক্ষেত্র ও চলাচলের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা থাকলে, নারীদের অবস্থার উন্নতি ঘটলেই দেশের উন্নতি হবে।”

শায়লা সিরাজ সিঞ্চি

ফ্যাশন ডিজাইনার, উন্নয়ন কর্মী

আমি চেষ্টা করি আমার মতো কাপড় পরার। কে কী পরবে তা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার।

শায়লা সিরাজ সিঞ্চি স্লিভলেস ব্লাউজের সাথে শাড়ি পরতে পছন্দ করেন। বললেন, “যে কোনো নতুন ফ্যাশনের পোশাক আমি পরতে পছন্দ করি। আমার আরামের দিক চিন্তা করে আমি সব সময় শাড়ি পরি। এছাড়াও ওয়েস্টার্ন আউটফিট পছন্দ করি। ওয়েস্টার্ন আউটফিট যেমন টিশার্ট, টপস, স্কার্ট আমার কাছে ফ্লেক্সিবল মনে হয়। জায়গাভেদে আমি আরেকটু রক্ষণশীল পোশাকও পরি। যেখানে যতটুকু প্রয়োজন সেখানে ততটুকুই চেষ্টা করি।

শায়লা সিরাজ সিঞ্চি, ফ্যাশন ডিজাইনার, উন্নয়ন কর্মী।

ছোটবেলায় মা আমাকে সমাজের প্রচলিত মাপকাঠির বাইরে পোশাক পরতে দিতেন না। একটা বয়সের পর নিজে স্বাধীন চলাফেরা শুরু করলাম, তখন থেকে আমি আমার পছন্দমতো পোশাক পরা শুরু করেছি। আমার বেড়ে ওঠা গাজীপুরে। সেখানে আমি কখনো প্রচলিত পোশাকের বাইরে এক্সপেরিমেন্ট করতে যাইনি। কারণ ওখানে অনেক বাজে মন্তব্য আমাকে শুনতে হয়। সেক্ষেত্রে ঢাকা শহরে এসকল প্রতিবন্ধকতা তুলনামূলকভাবে কম হলেও রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্রে- নানান শ্রেণীর, নানান পেশার মানুষের অনেকরকম মন্তব্যই আমাকে শুনতে হয়েছে। আমি ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করেছি কিন্তু সেখানেও আমাকে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। আবার যখন উন্নয়ন কর্মী হিসেবে কক্সবাজারে কাজ করতে আসি তখন প্রথম প্রথম আশেপাশের পরিবেশ লক্ষ্য করতে হয়েছে। কারণ এখানকার আর ঢাকার সংস্কৃতি একদমই আলাদা। আবার আমি যেহেতু চট্টগ্রামের বাইরে থেকে এসেছি, আমার বুঝতে প্রথমে বেশ কষ্ট হয়েছে। কিন্তু আমি চেষ্টা করি আমার মতো কাপড় পরার। কে কী পরবে তা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। যে যাইই পরুক, হিজাব-বোরকা কিংবা পশ্চিমা পোশাক-আমি প্রত্যেককেই সম্মান করি। আমাদের শরীর ঢাকাটাই তো মূল বিষয়। সেক্ষেত্রে পোশাক কে কীভাবে পড়ছে তা দিয়ে কাউকে বিচার করা উচিত বলে আমি মনে করি না।

নারী দিবস আমার জন্য খুবই অনুপ্রেরণার একটি বিষয়। শ্রেণী-পেশা নির্বিশেষে সকল নারীকেই আমি মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা করি । আমি মনে করি যে যার জায়গায় সংকীর্ণ না থেকে যে যেটা পরতে চায় সেটাই পরুক, নারীরা মানুষ হিসেবে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পাক, সম্মান পাক এবং সমাজ যেন আমাদেরকে শুধুমাত্র নারী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে বিচার করে।”

অনুরণন সিফাত

স্বত্তাধিকারী, ইস্টিশন (সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, কক্সবাজার)

সালোয়ার কামিজ পরলে অন্যান্য পোশাকের তুলনায় কম কটূক্তির মুখোমুখি হতে হয়। সম্ভবত সমাজের চোখ এ পোশাকে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

“সালোয়ার কামিজ পরতে আরামদায়ক সেজন্য পরি। কোনোরকম হয়রানির শিকার হইনি। হয়রানির শিকার হতে না চাওয়াও সালোয়ার কামিজ পরার অন্যতম কারণ। আমাদের সামাজিক বাস্তবতায় সালোয়ার কামিজ স্বস্তিদায়ক। সালোয়ার কামিজ পরলে অন্যান্য পোশাকের তুলনায় কম কটূক্তির মুখোমুখি হতে হয়। সম্ভবত সমাজের চোখ এ পোশাকে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কারণ অনেকদিন ধরে তারা এটাই দেখে আসছে।

অনুরণন সিফাত, স্বত্তাধিকারী, ইস্টিশন (সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, কক্সবাজার)

যে যার খুশিমতো পোশাক পরুক। এখানে বাঁধাধরা কোনো নিয়ম আরোপ করা উচিত নয়। তবে কিছু কিছু জায়গায় যেমন মেট্রো এরিয়ার বাইরে কিংবা রিমোট এরিয়ায় লোকজনের সাথে কাজ করতে গেলে পোশাকের ব্যাপারে একটু সতর্ক বা সংবেদনশীল হতে হয় বলে আমি মনে করি। অনেক সময় দেখা যায় প্রত্যন্ত এলাকায় কাজ করতে গেলে, সে এলাকার মানুষের সাথে মানিয়ে নেয়ার একটা বিষয় থাকে। অর্থাৎ বৃহত্তর স্বার্থে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পোশাকের ব্যাপারে আমাদের সংবেদনশীল হলে যদি কাজ করা সহজ হয় সেটাকে আমি ক্ষতিকর মনে করি না।

নারী দিবসের এবারের স্লোগানই হলো “ break the bias”. তো পোশাকের জন্যও নারীদের অনেক সময় পক্ষপাত্মূলক আচরণের শিকার হতে হয়। এই পক্ষপাতমূলক আচরণের যেন বিলুপ্তি ঘটে। সবাই সবার পছন্দমতো পোশাকটা পরতে পারুক। এটা নিয়ে নারীকে যেন দোষারোপ করা না হয়, নারীর চরিত্রের ব্যবচ্ছেদ যেন করা না হয়।”

লুম্বিনী দেওয়ান

চিত্রশিল্পী

আমি চাই আমাকে লোকে আমার পোশাক দিয়েই চিনুক যে আমি একজন আদিবাসী, চাকমা সম্প্রদায়ের মানুষ।

চিত্রশিল্পী লুম্বিনী দেওয়ানের বাড়ি রাঙ্গামাটি হলেও কর্মসূত্রে ঢাকাতেই থাকছেন। চাকমা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পিনন ও খাদি পরতে ভালোবাসেন। বললেন “আমাদের পোশাকের নিচের স্কার্টের মতো অংশটাকে বলা হয় পিনন। আর ওড়নাটাকে বলা হয় খাদি। মূলত ব্লাউজ দিয়েই এই পোশাক পরা হয়। তবে আমরা অনেকসময় বিভিন্ন রকমের টপসও এর সাথে পরি। ঢাকায় আদিবাসীদের কোনো অনুষ্ঠান, কোনো ছবির প্রদর্শনীতে অংশ নিতে আমি আমার এই নিজস্ব পোশাক পরি।

লুম্বিনী দেওয়ান, চিত্রশিল্পী।

আমি চাই আমাকে লোকে আমার পোশাক দিয়েই চিনুক যে আমি একজন আদিবাসী, চাকমা সম্প্রদায়ের মানুষ। তবে আমাদের কোনো অনুষ্ঠান ছাড়া পিনন-খাদি পরতে পারি না। লোকজন অদ্ভুত চোখে তাকায়। এরকম পোশাক কেনো পরলাম, শাড়ি বা সালোয়ার কামিজ কেনো পরলাম না এধরণের কথাবার্তাও বলে। এছাড়াও আরো অনেক বিরূপ মন্তব্য শুনতে হয়েছে। পিনন-খাদি তো ব্লাউজ দিয়ে পরা হয়, এ পোশাকে কোমর, পেটের কিছুটা অংশ উন্মুক্ত থাকে। ঢাকায় আমি পিননের সাথে ব্লাউজ, স্লিভলেস ব্লাউজ পরতে পারি না। লোকের অশালীন মন্তব্য, অদ্ভুত চাহনী থেকে রক্ষা পেতে আমি কোমর ঢাকা টপস দিয়ে পিনন পরি।”

লুম্বিনী মনে করেন কোনো পোশাক যদি কাউকে মানিয়ে যায়, সে সেটা পরতেই পারে। বললেন, “আমি শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, স্লিভলেস ব্লাউজ, স্লিভলেস ড্রেস সবই পরি। কিন্তু সবটাই স্থান বিবেচনা করে পরি যাতে বিব্রত হতে না হয়। আমি মনে করি আমার যথেষ্ট ড্রেসসেন্স আছে। নারী হয়ে জন্মে আমি খুব গর্বিত। বাংলাদেশে নারীরা এখন অনেকটাই স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারছে, দেশে অনেক নারী উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে, এটাকে আমি “গুড সাইন” মনে করি। নারীদের আরো এগিয়ে আসার জন্য পরিবার ও সমাজের কাছে সহযোগিতা ও স্বাধীনতা প্রত্যাশা করি। যে সহযোগিতা ও ব্যক্তি-স্বাধীনতাটুকু পেলে সে নিজের ও পরিবারের উন্নতি করতে পারবে সেটা তাকে দেয়া প্রয়োজন। ”

তাসমিন আরা

চেয়ারম্যান, স্টারপাথ হোল্ডিংস লিমিটেড, ঢাকা

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে হিজাব পরি। এটা সম্পূর্ণই আমার নিজের পছন্দেই বেছে নেয়া।...দেশে এখন হিজাব ফ্যাশনের অনুষঙ্গ হয়ে গেছে।

তাসমিন আরা, চেয়ারম্যান, স্টারপাথ হোল্ডিংস লিমিটেড, ঢাকা।

সাধারণত সালোয়ার কামিজ পরেন, তার সাথে হিজাব পরেন। এ নিয়ে তাঁর অভিমত, “ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে হিজাব পরি। এটা সম্পূর্ণই আমার নিজের পছন্দেই বেছে নেয়া। হিজাব পরে বের হতে আমার কোনো সমস্যা হয় না। এমনকি দেশের বাইরেও হিজাবে কখনও সমস্যা হয়নি। দেশে আমি সালোয়ার কামিজের সাথে হিজাব পরি। আমি আমেরিকায় ও কানাডায় বেড়াতে গিয়ে জিনস ও লং শার্টের সাথেও হিজাব পরেছি। দেশে এখন হিজাব ফ্যাশনের অনুষঙ্গ হয়ে গেছে।

পোশাক সম্পূর্ণই ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার। তবে শালীনতার বিষয়টি মাথায় রাখা উচিত। যে পোশাকই পরুক সেটা পরিবেশ ও সামাজিকতার সাথে মানিয়ে যায়, মার্জিত হয়।

নারী দিবসের প্রত্যাশা, নারীদের নিরাপত্তা। নিরাপদ কর্মপরিবেশ, নিরাপদ চলাফেরাটাই এখন নারীদের জন্য সবচেয়ে বড় চাওয়া।”

শাহনাজ পারভীন মীম

শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ

কে কী ধরণের পোশাক পরবে এটা সম্পূর্ণই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আর ধর্মীয় পোশাক, যেমন ইসলাম ধর্ম অনুসারে পর্দা করার বিষয়টিও কাউকে জোর করে করানো যায় না।

বোরখা পরে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করেন। বললেন, “একসময় ওয়েস্টার্ন ড্রেস বেশি পরতাম। কিন্তু হঠাৎ করেই পোশাক নিয়ে ভাবনার বদল হলো। একদিন শখের বশে বোরখা পরে মনে হলো এই পোশাকটাই আমাকে বেশি মানাচ্ছে। মনে হলো, বোরখা পরলে আশেপাশের মানুষরা একটু সম্মানের দৃষ্টিতে তাকায়। আমিও বের হতে স্বস্তি বোধ করছি। তখন থেকেই নিয়মিত বোরখা পরি এবং স্বতস্ফুর্তভাবেই পরি।

শাহনাজ পারভীন মীম, শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ।

বোরখা পরার ব্যাপারে কখনও কোনো পারিবারিক চাপ ছিলো না। তবে বোরখা পরেও অনেকসময় হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। রাস্তায় চলাফেরার ক্ষেত্রে বিরূপ মন্তব্য শুনতে হয়েছে। বাসে উঠতে গেলে, আন্টি, খালাম্মা এধরণের সম্বোধন শুনতে হয়। ‘ভুত আসছে’ এই টাইপের মন্তব্যও শুনেছি। মার্কেটে গেলে আশেপাশে থেকে অনেক ধরণের মন্তব্য শুনি। বুঝতে পারি, এগুলো আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হচ্ছে।

কে কী ধরণের পোশাক পরবে এটা সম্পূর্ণই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আর ধর্মীয় পোশাক, যেমন ইসলাম ধর্ম অনুসারে পর্দা করার বিষয়টিও কাউকে জোর করে করানো যায় না। মন থেকে ভালো না লাগলে এ ধরণের পোশাক পরা যায় না। আবার ওয়েস্টার্ন পোশাকের ক্ষেত্রেও তাই। ক্যারি করতে না পারলে কোনো পোশাকেই স্বচ্ছন্দ হওয়া যায় না। তাই কে কী পরবে সে ক্ষেত্রে তার পছন্দের স্বাধীনতা থাকা উচিত।

আরেকটা সমস্যা বোধ করেছি চাকরি খুঁজতে গিয়ে। বিভিন্ন জায়গায় আমার চাকরি হয়নি আমি বোরখা পরি বলেই। এ ধরণের কথাও বলা হয়েছে, আমি যেনো অফিসে এসে হিজাব বা বোরখা খুলে ফেলি। চাকরি ক্ষেত্রে আমার চেহারা তো মুখ্য বিষয় হতে পারে না। আমার যোগ্যতা ও দক্ষতাকেই তো প্রাধান্য দেয়া উচিত। সেখানে কাজের জায়গায় মেয়েরা পোশাক নিয়ে প্রতিনিয়ত সমালোচনার মুখে পড়ছে।

তাই নারী দিবসে আমার প্রত্যাশা থাকবে, কাজের জায়গায় পোশাক নিয়ে প্রতিবন্ধকতা বন্ধ হোক। আমি যদি কর্মক্ষেত্রে পর্দা করতে চাই, সেই স্বাধীনতাটুকু আমার থাকা উচিত।”

ফারিয়া আফরোজ

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, বাংলাদেশ পুলিশ, নরসিংদী সদর সার্কেল

পোশাকে পকেট থাকাতে আমাকে কোনো ভ্যানিটি ব্যাগ বা পার্স ক্যারি করতে হয় না, তাই আমি ইউনিফর্মেই বেশি কম্ফোর্টেবল।

“ইউনিফর্ম পরে চলাফেরা করতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করি। ট্র্যাডিশনাল কাপড়চোপড়ের চাইতে এটাতেই এখন অভ্যস্থ হয়ে গেছি। পোশাকে পকেট থাকাতে আমাকে কোনো ভ্যানিটি ব্যাগ বা পার্স ক্যারি করতে হয় না, তাই আমি ইউনিফর্মেই বেশি কম্ফোর্টেবল।

ফারিয়া আফরোজ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, বাংলাদেশ পুলিশ, নরসিংদী সদর সার্কেল।

আমি মনে করি, পোশাক-আশাক খুবই ব্যক্তিস্বাধীনতার বিষয়। কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে, পারিবারের লোজকনের সাথে দেখা করতে গেলে আমি ট্র্যাডিশনাল পোশাক অর্থাৎ শাড়ি বা সালোয়ার কামিজ পরেই যোগ দেই। আবার বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গেলে আমি জিনস, টি-শার্ট পরতে পছন্দ করি। পুরোটাই আসলে কমন সেন্সের ব্যাপার। একজন নারীর কোথায় কী পরতে হবে, তিনি নিজেই সেটা ভালো বুঝেবেন। এই ব্যাপারে আসলে কোনো নিয়ম বা বিধিনিষেধ আরোপ করা যায় না।

প্রতিটি নারী দিবসে আমার প্রত্যাশা থাকে, বাংলাদেশে কর্মজীবী সব নারীর পাশে তাদের পরিবারগুলো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিক। যে মেয়েটা কর্মজীবী তার সন্তান ও সংসারের সহযোগিতা করার জন্য পরিবারকে পাশে পাক। তাহলে কর্মক্ষেত্রে আরো নারীরা এগিয়ে আসবে। ফ্যামিলি সাপোর্টের অভাবে অনেক মেয়েই কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকতে পারে না। এছাড়া বাংলাদেশের মোড়ে মোড়ে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র তৈরি হওয়া দরকার। কর্মজীবী নারীর জন্য সন্তানের দেখাশোনা একটা চ্যালেঞ্জের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তাই প্রতিটি থানায়, ঢাকা শহরসহ বড় শহরগুলোর প্রতিটি এলাকাতে একটি করে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র থাকলে এবং পারিবারিক সহযোগিতা থাকলে অনেক নারীর পক্ষেই পড়াশোনা ও কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। যতই নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলা হোক, এ সকল সহযোগিতা ছাড়া আসলে সেটা সম্ভব না।”

রিফাহ তাসনিম অর্না

শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ দেশ। তাই নানান ধরনের পোশাক মানুষ পরবে এটাই স্বাভাবিক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিফাহ তাসনিম অর্না পশ্চিমা ধাচের পোশাক পরতে বেশি পছন্দ করেন। তিনি বলেন, “ওয়েস্টার্ন পোশাক পরতে ভালো লাগে, আমার পার্সোনালিটির সাথে যায়। এই পোশাক আরামদায়ক, চলাফেরায় খুবই সুবিধা হয়।

রিফাহ তাসনিম অর্না, শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সরাসরি কখনও হয়রানির শিকার হইনি। তবে অনেকসময় মানুষ খুব ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে, আমি বুঝতে পারি, আমার স্লিভলেস পোশাকের কারণে হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু এরচেয়ে বেশি কোনো হয়রানির শিকার হইনি। একসময় আমার চুল ছোট ছিলো। তখন ওয়েস্টার্ন পোশাক পরলে ‘ছেলে নাকি মেয়ে’-এমন মন্তব্য শুনতে হতো। মানুষজন খুব কাছে এসে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতো। ‘ছেলেদের মতো জামা পরসে’- এমন মন্তব্যও করতো। এটা এখনও মাঝেমাঝে শুনতে হয়।

আমি মনে করি, যে যা ইচ্ছা পরবে। আমাদের দেশের মানুষ এখনো এই জিনিসটা মেনে নিতে পারে না, তাদের মাইন্ডসেটের বাইরে মানুষ কিছু পরতে পারে। এই ব্যাপারটা কেন মেনে নিতে পারে না আমি বুঝি না। মানে তাদের চিন্তা-ভাবনার বাইরেও যে মানুষ ভাবতে পারে এটা অনেকেই মেনে নিতে পারে না। আর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ দেশ। তাই নানান ধরনের পোশাক মানুষ পরবে এটাই স্বাভাবিক। ’৬০-’৭০ দশকেও আমাদের মেয়েরা শাড়ির সাথে স্লিভলেস ব্লাউজ পরতো, ওড়না ছাড়াও কামিজ পরতো, এমনকি আমার মা খালারাও পরতেন। কিন্তু এখন আর এ ব্যাপারটা সেভাবে নেই। এখন সবাই একই ধরনের জামা-কাপড় পরে। মোটকথা মানুষ নিজের চিন্তার বাইরে কিছু ভাবতে পারে না; বরং অন্যকেও নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে।

নারী দিবসের প্রত্যাশা হলো,ঢাকায় যেনো নিরাপদে চলতে পারি। অর্থাৎ প্রতিদিন যে রাস্তায় বের হই একটা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, আতঙ্ক নিয়ে, সেভাবে যেনো বাসা থেকে বের হতে না হয়। শুধুমাত্র কথাবার্তা বা আলোচনাতেই যেন নারী দিবস সীমাবদ্ধ না থাকে। প্রতি বছর শুধু উদযাপনই যেন নারী দিবসের উদ্দেশ্য না হয়ে ওঠে। অবস্থার উন্নতি হোক,কিছু একটা হোক- এটাই প্রত্যাশা।”