যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করলো বাংলাদেশ

যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট লোগো

যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশ। বলেছে, এটা 'গৎবাঁধা রিপোর্ট'। "বাংলাদেশের সরকারবিরোধী যে প্রপাগান্ডা মেশিনগুলো আছে, সেসব মেশিন থেকে, তথ্যগুলো প্রাথমিকভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে," বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সরকারের পক্ষ থেকে এই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। ঢাকায় অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস সাংবাদিকদের বলেছে, তাদের রিপোর্ট বস্তুনিষ্ঠ, পুঙ্খানুপুঙ্খ ও ন্যায্য।

যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট মানবাধিকার চর্চা বিষয়ে ২০২১ সালের দেশভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের আইনের আওতায়, একটি আবশ্যক বার্ষিক প্রতিবেদন। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মানবাধিকারকে তার পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছেন। এই অধিকার সর্বজনীন: কার জন্ম কোথায়, কার বিশ্বাস কী, কে কাকে ভালোবাসে বা কার কী বৈশিষ্ট্য সেগুলো নির্বিশেষে সকল মানুষ এই অধিকারের দাবীদার।

মঙ্গলবার রাতে ৭৪ পৃষ্ঠার এই রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়- বাংলাদেশের সংবিধানে একটি সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা রয়েছে, যা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধিকাংশ ক্ষমতাকে একীভূত করে। ডিসেম্বর, ২০১৮ সালের সংসদীয় নির্বাচনে শেখ হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগ, টানা তৃতীয় মেয়াদে জয়লাভ করে; যা তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদে বহাল রাখে। ব্যালট-বাক্স ভর্তি এবং বিরোধী পোলিং এজেন্ট ও ভোটারদের ভয় দেখানোসহ অনিয়মের কারণে এই নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের দ্বারা অবাধ ও সুষ্ঠু বলে বিবেচিত হয়নি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতীয় পুলিশ, সীমান্তরক্ষী বাহিনী এবং র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের মতো সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিটগুলি অভ্যন্তরীণ ও সীমান্ত নিরাপত্তা বজায় রাখে। নিরাপত্তা বাহিনী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট করে এবং সামরিক বাহিনী প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট করে। বেসামরিক কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর কার্যত নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনের অপব্যবহারের বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে।

উল্লেখ্য, মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলির মধ্যে বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ বেআইনি বা নির্বিচারে হত্যা, জোরপূর্বক অন্তর্ধান, সরকারের পক্ষ থেকে, সরকার বা তার এজেন্টদের দ্বারা নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তি, নির্যাতন বা মামলা, কঠোর এবং জীবন-হুমকি, কারাগারের অবস্থা, নির্বিচারে গ্রেপ্তার বা আটক, রাজনৈতিক বন্দী, অন্য দেশে অবস্থানরত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রতিশোধ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে গুরুতর সমস্যা, গোপনীয়তার সাথে স্বেচ্ছাচারী বা বেআইনী হস্তক্ষেপ, একজন ব্যক্তির অভিযুক্ত অপরাধের জন্য পরিবারের সদস্যদের শাস্তি, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বা সহিংসতার হুমকি, সাংবাদিকদের অযৌক্তিক গ্রেপ্তার বা বিচার, সেন্সরশিপ এবং অপরাধমূলক মানহানি এবং স্বাধীন মতপ্রকাশ এবং মিডিয়ার ওপর গুরুতর বিধিনিষেধ, ইন্টারনেট স্বাধীনতার ওপর গুরুতর নিষেধাজ্ঞা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা এবং সমিতির স্বাধীনতার ওপর উল্লেখযোগ্য হস্তক্ষেপ, যার মধ্যে সংগঠন, তহবিল বা বেসরকারি সংস্থা এবং সুশীল সমাজ সংস্থাগুলির পরিচালনার ওপর অত্যধিক সীমাবদ্ধ আইনসহ, শরণার্থীদের চলাফেরার স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধ, উদ্বাস্তুদের সাথে দুর্ব্যবহার, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণের ওপর গুরুতর এবং অযৌক্তিক বিধিনিষেধ, গুরুতর সরকারি দুর্নীতি।

এ ছাড়াও উল্লেখ রয়েছে, গার্হস্থ্য মানবাধিকার সংস্থাগুলির ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা বা হয়রানি, লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতায় তদন্তের অভাব এবং জবাবদিহিতার অভাব, যৌন সহিংসতা, শিশু নির্যাতন, বাল্য ও জোরপূর্বক বিবাহ, সহিংসতায় জড়িত অপরাধ বা জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বা আদিবাসীদের লক্ষ্য করে সহিংসতার হুমকি, সহিংসতায় জড়িত অপরাধ, লেসবিয়ান, গে, উভকামী, ট্রান্সজেন্ডার, কুইয়ার, বা ইন্টারসেক্সচুয়াল ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সহিংসতার হুমকি, প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সম্মতিমূলক সমলিঙ্গের যৌন আচরণকে অপরাধী করে এমন আইনের অস্তিত্ব বা ব্যবহার, স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন এবং শ্রমিকদের সংগঠনের স্বাধীনতার ওপর উল্লেখযোগ্য বিধিনিষেধ এবং শিশুশ্রমের সবচেয়ে খারাপ রূপের অস্তিত্ব বিষয়ক বিভিন্ন দিক।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী দায়মুক্তি প্রসঙ্গে বলেন, “র‌্যাব’র ওপর নিষেধাজ্ঞা আসার পর আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অনেক নথি শেয়ার করেছি। আমরা এক সময় এসব নথি দিতাম না। গত তিন বছরে কতজন পুলিশ, কতজন র‌্যাব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, সে তথ্যও দিয়েছি। কিন্তু, রিপোর্টে বলা হয়েছে দু’-একটি ক্ষেত্রে। ১৯০ জনকে যেখানে চাকরিচ্যুত করা হয় সেখানে দু’-একটি ঘটনার মধ্যে এটা পড়ে না।”

প্রতিমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়ার মামলার ইতিহাসও এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। তাকে রাজনৈতিক বন্দী বলা হয়েছে। তিনি তো রাজনৈতিক বন্দি নন। তাকে মানবিক কারণে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে বাসায় থাকতে দেয়া হয়েছে। তার বিদেশ যাওয়ার প্রশ্নটাও ছিল অমূলক।”

শাহরিয়ার আলমের দাবি, রোহিঙ্গাদের বিষয়েও রিপোর্টে ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, "রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে শেখ হাসিনা সরকার কতটা মানবিক, কতটা আন্তরিক সেটা সবার জানা। এরমধ্যে, পৃথিবীর কেউ যদি রোহিঙ্গা প্রশ্নে মানবিকতা শেখাতে আসে, তখন আমার মনে হয় তাদের 'নৈতিক স্খলন' হয়েছে। আমরা রিফিউজি ট্রিটি সিগনেটরি নই। তারপরও আমরা এসব প্রটোকল মেনে চলেছি।”

সমকামীদের জন্য বাংলাদেশে আইন নেই, প্রতিবেদনের এই অভিযোগ প্রসঙ্গে শাহরিয়ার আলম বলেন, "এটা আমাদের ইসলাম ধর্মের পরিপন্থি। পৃথিবীর এমন একটা মুসলিম দেশ দেখান, যারা সমকামিতাকে অনুমোদন দেয়।”

শাহরিয়ার আলম জানান, আগামী রোববার এই রিপোর্টের বিস্তারিত প্রতিক্রিয়া জানাবে সরকার।

অন্যান্য প্রতিক্রিয়া

ওদিকে, বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, এই রিপোর্টে তথ্যের গরমিল রয়েছে। বিচার বিভাগ ব্যবহার করে রাজনৈতিক হয়রানি প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “বিচার বিভাগ স্বাধীন। হয়রানি হবে কীভাবে? গুম খুনের ব্যাপারেও আমরা অনুসন্ধান করে দেখেছি। অনেকে আত্মগোপন করে গুম বলে চালিয়ে দিচ্ছে। নিরাপত্তা বাহিনী অনেককে খুঁজে বের করে এনেছে। “

বিএনপি বাংলাদেশে মানবাধিকার চর্চার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনের প্রশংসা করেছে। দলটি বলেছে, এই প্রতিবেদনে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অপকর্ম এবং 'চরম দুঃশাসন' তুলে ধরা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক রুহুল কবির রিজভী এসব কথা বলেছেন। তিনি বলেন, "যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিচার বিভাগ সরকারের হাতে থাকা অবস্থায় বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাজা দেয়া হয়েছে এবং দেশের নিরাপত্তা বাহিনী হত্যা, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।"

নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, "যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে বাকস্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে, বিরোধীদের নির্মূল করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করা হচ্ছে।...আমি বলতে চাই, এই প্রতিবেদনে আওয়ামী সরকারের অপকর্ম প্রকাশ পেয়েছে।"


আরো কী আছে যুক্তরাষ্টের প্রতিবেদনে

মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রসঙ্গ

মানবাধিকার বিষয়ক এই রিপোর্টে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে বলা হয়, এখানে অনলাইন এবং অফলাইনে মত প্রকাশের স্বাধীনতা উল্লেখযোগ্যভাবে সীমাবদ্ধ। মিডিয়ার সদস্যরা এবং ব্লগাররা নিজেরাই ভয়ে নিজেদের বক্তব্যকে সেন্সর করেন। সংবিধানের সমালোচনাকে রাষ্ট্রদ্রোহের সমান অপরাধ করা হয়েছে। এই আইনে 'ঘৃণামূলক' বক্তব্যকে সীমিত করা হয়েছে। কিন্তু সংজ্ঞায়িত করা হয়নি ঘৃণামূলক বক্তব্য কোনটি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যাবজ্জীবন পর্যন্ত শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ করা হয়েছে। এই আইনের অধীনে ৪৩৩ জনকে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে কমপক্ষে ১৮৫ জনের বিরুদ্ধে অনলাইনে আক্রমণাত্মক ও মিথ্যা তথ্য প্রকাশের অভিযোগ আনা হয়েছে। এডিটরস কাউন্সিলের বরাতে এই রিপোর্টে বলা হয়, এই আইনের ২০টি ধারার মধ্যে ১৪টি জামিন অযোগ্য। মুক্তমনা লেখক মুশতাক আহমেদ তার জীবন দিয়ে এটা প্রমাণ করে গেছেন। ২০২০ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক প্রেস রিলিজে বলা হয়, দেশের ভেতরে এবং বিদেশে বসে সরকার, জনপ্রতিনিধি, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট ও প্ররোচনামূলক বিবৃতির ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ দেয়া হয়েছে।

সংখ্যালঘু প্রসঙ্গ

প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কারণে হিন্দু ও বৌদ্ধদের সম্পদ ও মন্দিরের ওপর হামলার খবর পাওয়া গেছে। এসব ধর্মীয় বিশ্বাসের গ্রুপগুলোর কেউ কেউ বলেছেন, করোনা মহামারির সময়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা বৃদ্ধি পেয়েছে। সিলেটে একটি হিন্দু গ্রামে প্রায় ৮০টি বাড়ি ও ৮টি মন্দির ভাঙচুর করা হয়। এর জন্য মিডিয়া ও নাগরিক সমাজ হেফাজতে ইসলামের শত শত সদস্যকে দায়ী করে। যদিও সংগঠনটি হামলার দায় অস্বীকার করে।

রিপোর্টে বলা হয়, এলজিবিটি (লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার) সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আছে সহিংস অপরাধ ও হুমকি। সমকামিতাকে ক্রিমিনালাইজ করার আইন বিদ্যমান রয়েছে।

মানবাধিকার রিপোর্টে বলা হয়, লিঙ্গ সমতা কার্যকরভাবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে সরকার সবসময় সংবিধান অনুসরণ করে না। পরিবারে পুরুষের সমান আইনগত মর্যাদা ও অধিকার ভোগ করতে পারেন না নারীরা। তারা সম্পদেও সমঅধিকার পান না। ইসলামিক উত্তরাধিকার আইনে, মেয়েরা এখনও ছেলেদের তুলনায় অর্ধেক সম্পত্তির মালিক হন। হিন্দু আইন অনুযায়ী, একজন নারীর স্বামী মারা গেলে, স্বামীর সম্পত্তিতে ওই বিধবার অধিকার থাকে সীমিত।

রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হত্যাকাণ্ড

প্রতিবেদনে বলাহয়, সংবিধানে জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকারের কথা বলা রয়েছে। তবে, সরকার বা তার এজেন্টরা সেসব ভুলে, স্বেচ্ছাচারিতা করছে বা বেআইনি হত্যা করছে । গুরুতর শারীরিক আঘাত বা মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে, পুলিশের দ্বারা অভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রয়োজন। কিন্তু সরকার মৃতের পরিসংখ্যান প্রকাশ করছে না বা নিরাপত্তা কর্মীদের দ্বারা হত্যার অভিযোগের প্রেক্ষিতে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। মানবাধিকার সংগঠনগুলো ব্যক্তি স্বাধীনতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে। তাদের দাবি, নাগরিকরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই ধরনের মৃত্যুতে তাদের ভূমিকার কথা নিরাপত্তাবাহিনী প্রায়ই অস্বীকার করে। সরকার সাধারণত এই মৃত্যুকে "ক্রসফায়ার হত্যা," অথবা "এনকাউন্টার হত্যা" বলে উল্লেখ করে আসছে। মিডিয়াও এই পদগুলি ব্যবহার করে। দেশীয় মানবাধিকার সংস্থা, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (ASK) একটি তথ্য দিয়ে বলেছে যে , ৮০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে মারা গেছে, যার মধ্যে ৫১ জন তথাকথিত ক্রসফায়ার হত্যাকাণ্ডের শিকার। ২০১৮- র মে থেকে জুনের মধ্যে , আইন ও সালিশ কেন্দ্র বিচারবহির্ভূত মৃত্যুদণ্ডের মোট ৬০৬ টি ঘটনা রিপোর্ট করেছে।

আরেকটি মানবাধিকার সংস্থা 'অধিকার' এর তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে ৩৫ জন মারা গেছে। আইন প্রয়োগকারীদের সাথে বন্দুকযুদ্ধের ফলে ৩০জন ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হন এবং আরও ছয়জন হেফাজতে থাকা অবস্থায় নির্যাতনের জেরে মারা যান।

২০২০ সালে অধিকার মোট ২২৫টি বিচারবহির্ভূত মৃত্যুদণ্ড রিপোর্ট করেছে, ২০১৯ সালে এই সংখ্যাটা ছিল ৩৯১। মানবাধিকার সংগঠন ও সুশীল সমাজ, কথিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গ্রেপ্তারের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মধ্যে, স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা এবং মিডিয়া রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে ১০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের খবর সামনে এনেছে।

প্রসঙ্গ রোহিঙ্গা শরণার্থী

মিয়ানমারের বর্বরতা থেকে প্রাণে বাঁচতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অস্থায়ী আশ্রয়গ্রহণকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবস্থার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের এই মানবাধিকার রিপোর্টে। রিফিউজি কনভেনশনের সিগনেটরি না হওয়ায়, তাদের শরণার্থীর মর্যাদা না দেয়ার কড়া সমালোচনা করা হয়েছে প্রতিবেদনে। একইসঙ্গে বাস্তুচ্যুতদের, দ্বীপ এলাকা ভাসানচরে স্থানান্তর নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনকেে উদ্ধৃত করে, রিপোর্টে ভাসানচরকে সাগরের মধ্যবর্তী একটি জেলখানা বলে তীর্যক মন্তব্য করা হয়। অভিযোগ করা হয়, রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং দাতা সম্প্রদায়কে ভাসানচর সম্পর্কে সরকারি প্রতিনিধিরা বিভ্রান্তিকর তথ্য সরবরাহ করেন। কিছু শরণার্থীকে সম্মতি ছাড়াই স্থানান্তরে বাধ্য করা হয়েছে এমন অভিযোগও তোলা হয়। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের রিপোর্টে এ-ও বলা হয়, রোহিঙ্গারা এটা স্বীকার করেন যে, কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোর তুলনায় ভাসানচর উন্নত। তবে, সেখানে রয়েছে খাদ্য ঘাটতি, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা তথা চলাফেরার স্বাধীনতায় বিধিনিষেধ। আর, জীবিকার সুযোগ কম।

রোহিঙ্গারা চাইলেই কক্সবাজার ক্যাম্পে থাকা স্বজনদের সঙ্গে দেখার অনুমতি পান না; এমন দাবি করে রিপোর্টে বলা হয়, দ্বীপ ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে, তাদের প্রায়শই মারধর খেতে হয়। এমনকি কম্পাউন্ডের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করলেও মারধর করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে; যা যুক্তরাষ্ট্র স্বতন্ত্রভাবে তদন্ত করতে পারে নি। ভাসানচর থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় নারী ও শিশুসহ ৪০ থেকে ৪৫ রোহিঙ্গাবোঝাই নৌকা ডুবে যাওয়া এবং ১১জন রোহিঙ্গা মারা যাওয়ার বিষয়টিও যুক্তরাষ্ট্রের রিপোর্টে অন্তর্ভুক্ত ছিল।

গুম প্রসঙ্গ

মানবাধিকার গোষ্ঠী এবং মিডিয়া গুম ও অপহরণের একাধিক খবর প্রকাশ্যে এনেছে। গত বছরের জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলি জানিয়েছে যে, ১৮ জন ব্যক্তিকে বলপূর্বক গুম করা হয়েছে। সরকার বিষয়টি প্রতিরোধে সীমিত প্রচেষ্টা করছে। সুশীল সমাজের সংগঠনগুলো জানাচ্ছে, বলপূর্বক গুম করা মানুষদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল বিরোধী নেতা, কর্মী এবং ভিন্নমতাবলম্বী।

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের অভিযোগ, পুলিশ বাহিনী অন্তর্ধান হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের পরিবার থেকে কোনো অভিযোগ নিচ্ছে না। সুশীল সমাজ সংগঠন ও গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ২৬ থেকে ২৮ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের সময়ে, ইসলাম প্রচারক আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনান, মাদ্রাসার বেশ কিছু ছাত্র এবং হেফাজতে ইসলাম সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত অনেকে নিখোঁজ। এখনো তাদের বেশিরভাগের সম্পর্কে কোনো খোঁজ মেলেনি। যাদের খোঁজ মিলেছে তাদের মিথ্যা অভিযোগে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে

আগস্টে, 'হিউম্যান রাইটস ওয়াচ' বর্ণনা করেছে যে, বলপূর্বক গুম করার বিষয়টি ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নিরাপত্তা বাহিনী দ্বারা ব্যবহৃত কৌশলে পরিণত হয়েছে। সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স (ডব্লিউজিইআইডি) বাংলাদেশে নিখোঁজের একাধিক অভিযোগ এবং সরকারের দায়মুক্তির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

নির্যাতন এবং অমানবিক আচরণ

সংবিধান ও আইনে নির্যাতন ও অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক আচরণ নিষিদ্ধ করা তা সত্ত্বেও, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এবং মিডিয়ার রিপোর্ট বলছে, দেশের পুলিশ এবং নিরাপত্তাবাহিনী আইন লঙ্ঘন করে চলেছে। জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটিসহ (CAT) একাধিক সংস্থার মতে , নিরাপত্তা বাহিনী অভিযুক্তদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের জন্য নির্যাতনকে হাতিয়ার বানিয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- লোহার রড দিয়ে মারধর, বৈদ্যুতিক শক, ধর্ষণ , অন্যান্য যৌন নির্যাতন এবংমৃত্যুদণ্ড।

৪ জানুয়ারি গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার চারদিন পর বরিশালে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু হয় রেজাউল করিম রেজার। মেডিকেল রিপোর্টে বলা হয়েছে, রেজা নামে একজন আইনের ছাত্র অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা গেছেন এবং তার শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন ছিল। ২৫ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিক মুশতাক আহমেদ কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। ট্রায়ালের আগে তাকে ১০ মাসের জন্য আটকে রাখা হয়েছিল। ৪ মার্চ, ডিএসএ-এর অধীনে অভিযুক্ত আহমেদ কবির কিশোর জামিনে মুক্তি পান। মুক্তি পাওয়ার পর কিশোরকে দৃশ্যত আহত অবস্থায় দেখা গেছে। হেফাজতে থাকাকালীন তার ওপর অকথ্য নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে ১০ মার্চ কিশোর ঢাকার একটি আদালতে মামলা দায়ের করেন । এখানেই শেষ নয়, ভারতীয় বন্দি শাহজাহান বিলাশের ওপর নির্যাতনের অভিযোগের পর, ঘটনার ফুটেজ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। পরে, কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের পাঁচ কর্মকর্তাসহ প্রধান কারারক্ষীকে বরখাস্ত করা হয়।

বৈষম্য এবং সামাজিক নির্যাতন

ধর্ষণ এবং গার্হস্থ্য সহিংসতা: আইনে শুধুমাত্র নারীদের ধর্ষণ নিষিদ্ধ বলে উল্লেখ করা আছে। ধর্ষণে দোষী সাব্যস্ত হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে অথবা মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু, স্বামী যদি স্ত্রীকে ধর্ষণ করে বা বৈবাহিক ধর্ষণকে আইন থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলি দেখেছে যে, ধর্ষণ একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে বাংলাদেশে। দেশের অভ্যন্তরীণ মানবাধিকার গ্রুপ আইন ও সালিশ কেন্দ্র অন্তত ১,৩২১ টি ধর্ষণের ঘটনা রিপোর্ট করেছে।

অধিকার -এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২০ সালে, ১৫৩৮ জন নারী এবং শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। শুধু তাই নয়, ধর্ষকদের দ্বারা নির্যাতিতাদের ব্ল্যাকমেইল করার অভিযোগ ছিল। ধর্ষণের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করার হুমকি দিয়েছিল অভিযুক্তরা। অধিকার গোষ্ঠীগুলি জানিয়েছে যে, মহামারির সময়ে নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সর্বত্র বেড়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র রিপোর্ট করেছে যে, ৬৪০ জন নারী গার্হস্থ্য সহিংসতার শিকার হয়েছেন এবং সহিংসতার ফলে মারা গেছেন ৩৭২ জন।

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে সিলেটে একটি গণধর্ষণ মামলার প্রতিক্রিয়ায় নারীবাদীরা লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা এবং অপব্যবহারের বিরুদ্ধে একটি স্থানীয় গ্রুপ চালু করে, যার নাম "ধর্ষণের বিরুদ্ধে ক্রোধ" বা “Rage Against Rape,”। লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতাকে একটি জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার দাবি জানানো হয় এই আন্দোলন থেকে।

আইন অনুযায়ী ধর্ষণের মামলা পরিচালনার জন্য একজন পুলিশ অফিসারকে ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়ন সম্পর্কিত যেকোনো তথ্য রেকর্ড করতে হবে। রাসায়নিক এবং ডিএনএ পরীক্ষা অবশ্যই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে করাতে হবে। স্টেশনে অবশ্যই একজন নারী পুলিশ অফিসার থাকতে হবে, যিনি ধর্ষণের অভিযোগ লিপিবদ্ধ করবেন। নির্যাতিতাকে; একজন আইনজীবী, সমাজকর্মী বা অন্য কোন ব্যক্তি; যাকে তিনি উপযুক্ত বলে মনে করেন, তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দিতে হবে। প্রয়োজনে তদন্তকারী কর্মকর্তার সঙ্গে একজন নারী পুলিশ কর্মকর্তাও থাকতে হবে নির্যাতিতাকে সময়মতো স্বাস্থ্য পরীক্ষায় নিয়ে যাওয়ার জন্য।

পর্যবেক্ষকদের মতে, অনেক ধর্ষিতা আইনি সহায়তার অভাবের কারণে, ধর্ষণের অভিযোগ রিপোর্ট করেননি, সেইসঙ্গে তাদের মনে যথাযথ পরিষেবা পাওয়া নিয়ে সংশয়, সামাজিক কলঙ্ক ও হয়রানির ভয়ও ছিল।

(এই প্রতিবেদনের কিছু অংশ ইউএনবি থেকে নেওয়া হয়েছে।)