রোহিঙ্গাদের চলাচলের স্বাধীনতায় বাধা: যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষণের প্রতিক্রিয়া

বাংলাদেশের একটি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির।

যুক্তরাষ্ট্রের ‘কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিসেস’ রিপোর্টে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি প্রসঙ্গে রোহিঙ্গাদের অবাধ চলাচলের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ এবং দেশত্যাগের ব্যাপারে বাধা দেয়ার অভিযোগ করা হয়েছে। দেশটির সরকারি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ১৩ এপ্রিলের ৭৪ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনের চলাচলের স্বাধীনতা এবং দেশত্যাগের অধিকারের বিষয়ে বলা হয়েছে, আইনে অভ্যন্তরীণ চলাচল, অভিবাসন এবং প্রত্যাবাসনের স্বাধীনতা দেয়া হলেও তিনটি স্পর্শকাতর এলাকা বাদে সরকার সাধারণত এই অধিকারের প্রতি সম্মান দেখায়: চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প এবং ভাসানচর। এই প্রসঙ্গে মানবাধিকারকর্মী, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক, শরণার্থী বিশেষজ্ঞ এবং নিরাপত্তা গবেষকের প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছে ভয়েস অফ আমেরিকা।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘‘রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চলাচলে বিধিনিষেধ আছে।’’

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কাঁটাতার এবং কনসার্টিনা তারের বেড়ার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘‘ক্যাম্পে যাতায়াতে অথবা আশপাশের এলাকায় যেতে হাতেগোনা কয়েকটি গেট রাখা হয়েছে। মার্চে কয়েকটি ক্যাম্পের অগ্নিকাণ্ডের সময় বের হওয়ার গেটের অভাবে সমস্যা দেখা দেয়। ভাসানচর এমন একটা দ্বীপ যার সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের নিয়মিত কোনো যোগাযোগ নেই। ভাসানচর থেকে পালানোর সময় আগস্টে নৌকাডুবিতে ১১ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়। জানুয়ারি থেকে শতশত রোহিঙ্গা অন্যস্থানে যাওয়ার এই চেষ্টা শুরু করেন। স্থানীয় প্রশাসন অনেক রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করে আটকে রেখেছে। কিছু মানুষকে আবার ভাসানচরে ফেরত পাঠানো হয়েছে।’’

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ না থাকলেও গণমাধ্যমের খবরে বিষয়টি নিয়ে গত কয়েক মাসে বেশ আলোচনা দেখা গেছে। ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) সংগঠনের কার্যালয়ে বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত হন সংগঠনটির চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহ (৪৮)। এরপর গত এপ্রিলের শুরুতে তার পরিবারের সদস্যরা নিরাপত্তাহীনতার কথা বলে কানাডায় চলে যান।

এছাড়া বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য করা বাড়ি ও কমিউনিটি ভিত্তিক শত শত স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ গত মার্চে ক্যাম্পের সবচেয়ে বড় স্কুলটি বন্ধ করা হলে মানবাধিকারকর্মীরা সমালোচনা করেন। স্কুলটিতে মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে পড়ানো হতো।

তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই দাবিকে অসত্য বলছে। ৫ মে গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার ৫ হাজার ৬১৭টি লার্নিং ফ্যাসিলিটির ব্যবস্থা করেছে। ওইসব ফ্যাসিলিটির অপারেটর বা ইউনিসেফ বন্ধ সংক্রান্ত বিষয়ে কোনও উদ্বেগ প্রকাশ করেনি।’’

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘রোহিঙ্গা শিশুদের বিনামূল্যে মিয়ানমারের কারিকুলামে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে যেন কোনো বৈষম্য না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখা হচ্ছে। ক্যাম্পের ভেতরে অর্থের বিনিময়ে প্রাইভেট কোচিং নিরুৎসাহিত করে সরকার। এর কারণ হচ্ছে- প্রাইভেট কোচিংয়ে মিয়ানমারের কারিকুলাম অনুসরণ করা হয় না এবং অসৎ উদ্দেশ্যে ভিন্ন মতাদর্শ প্রচারের আশঙ্কা থাকে।’’

মন্ত্রণালয়ের দাবি, ‘‘কোভিডের কারণে লার্নিং সেন্টারের কার্যক্রম বন্ধ ছিল এবং করোনা পরিস্থিতি উন্নতির পর পুনরায় খুলে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান চলছে ।’’

যুক্তরাষ্ট্রের রিপোর্টটি প্রকাশের পরপরই পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম তার প্রতিক্রিয়ায় সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘‘আপনারা জানেন রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কতটা আন্তরিক এবং কতটা মানবিক। পৃথিবীর কেউ যদি রোহিঙ্গা প্রশ্নে মানবিকতা শেখাতে আসে, আমার মনে হয় তাদের নৈতিক স্খলন হয়েছে, যারা এটা করার চেষ্টা করবে। আমি বলছি না এই রিপোর্টে সেটা করার চেষ্টা হয়েছে। রোহিঙ্গা প্রশ্নে আমরা কতটা সিরিয়াস সেটা বোঝানোর জন্য বলছি।’’

‘‘আপনারা খুব ভালো মতো জানেন আমরা পার্টিকুলার একটা রিফিউজি প্রটোকলে সিগনেটরি নই...সেটি হল ১৯৫১’র কনভেনশন রিলেটিং টু দ্য স্ট্যাটাস অব রিফিউজিস অর দ্য ১৯৬৯ প্রটোকল, এটা আমরা সব সময় বলি। কিন্তু এটাও বলি সাথে সাথে আমরা সিগনেটরি না হওয়ার পরেও ওই প্রটোকলের প্রায় সব মানি। আমরা সিগনেটরি কেন না, তার ব্যাখ্যা দিয়েছি। আটকে যাওয়া পাকিস্তানিদের ব্যাপার আছে। কিন্তু এখানে কী বলা হয়েছে, অ্যাজ অ্যা রেজাল্ট দ্য গভর্নমেন্ট ক্লেইমড ইট ওয়াজ নট আন্ডার লিগ্যাল অবলিগেশন টু আপহোল্ড দ্য বেইসিক রাইটস...হুইচ ইজ রং; ইটস অ্যা লাই।’’

‘‘আপনাদের সামনে একাধিকবার আমি বলেছি আমাদের সরকারের উচ্চপদস্থ অনেক কর্মকর্তা বলেছেন। আমরা সিগনেটরি না হওয়ার পরেও আমরা ট্রিটির স্পিরিট ধারণ করি। সেটার আলোকে আমরা রিফিউজিদের রিফিউজি না ডাকলেও তাদেরকে আমরা যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দেই। কিন্তু এখানে বলা হয়েছে আমরা নাকি ব্যাখ্যা দিয়ে বলি আমরা যেহেতু সিগনেটরি না আমরা কোনো দায়িত্ব নেই না।’’

প্রতিক্রিয়া

নূর খান

মানবাধিকারকর্মী

নূর খান লিটন।

রোহিঙ্গাদের ৩৩টি ক্যাম্পের ভেতরেও স্বাধীন চলাচলের সুযোগ নেই। কখনো কখনো এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে যেতে চাইলে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, ক্যাম্পের ভেতরে চলাফেরা করা গেলেও বাইরে আসলে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আটক করা হচ্ছে। ঈদের ছুটির মধ্যেও কয়েকশ রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে।

মানুষ হিসেবে যে সুযোগ-সুবিধা পাওয়া দরকার, সেটি না দিলে চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। একটি দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে যেমন পাসপোর্ট লাগে, এক্ষেত্রে আপনি যদি সেভাবে বিবেচনা করেন, তাহলে তার যে সুযোগ-সুবিধা দরকার সেটি নিশ্চিত করলেই কেবল এই চেষ্টা আপনি করতে পারবেন। আমি মনে করি, এই রোহিঙ্গাদের রিফিউজি স্ট্যাটাস দিয়ে দিলেই সহজ হয়ে যায়। তার যে অধিকার সেটা পাবে, যেটা পাওয়ার কথা না সেটা পাবে না। এভাবে জোরপূর্বক নিয়ন্ত্রণ করাটা এক ধরনের অমানবিক কাজ।

তাদের ক্যাম্পে নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথেষ্ট এটা বলার সুযোগ নেই। ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি বেশ কয়েক জন রোহিঙ্গা নেতা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে মিস্টার মুহিবুল্লাহর কথা বলতে পারি। এই হত্যাকাণ্ডের পর তার ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তারপরেও বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটার কারণে তারা নিরাপত্তাহীনতার কথা তুলে ধরেছেন। পরিবারের সদস্যরা ইতিমধ্যে আমাদের দেশ ছেড়েছেন। আরও কেউ কেউ যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন।

ক্যাম্পগুলোতে মিয়ানমারের কারিকুলামে লেখাপড়ার একটা ব্যবস্থা করেছিলেন মুহিবুল্লাহ। সেই স্কুলটিকেও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তার আগে সব স্কুল বন্ধ করা হয়েছে। ওখানে লার্নিং সেন্টার আছে, কিন্তু কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। শিক্ষা মানুষের জন্মগত অধিকার। কিন্তু দুর্ভাগ্য জনক হচ্ছে একদিকে আমরা মানবিকতার কথা বলছি, আরেক দিকে তার সুস্থ বিকাশের জন্য, জ্ঞান অর্জনের জন্য যে ব্যবস্থা সেটি বন্ধ করে দিচ্ছি। এটি এক ধরনের নিপীড়ন বলে আমি মনে করি।

কে এ এম মোর্শেদ

সিনিয়র ডাইরেক্টর, ব্র্যাক

কে এ এম মোর্শেদ।

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা নতুন নয়। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরেও এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে। তাছাড়া শহরের মাঝে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের অবস্থান, শিবিরের বাসিন্দা ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতার সম্ভাবনাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

আগুনে কক্সবাজার শরণার্থী শিবিরে প্রাণহানি একটি মর্মান্তিক ঘটনা। কক্সবাজার শিবির জুড়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকলে এত প্রাণহানি হত কি না তা বলা কঠিন, কারণ এসব অগ্নিকাণ্ডের প্রায় সব ঘটনাই নাশকতা হিসেবে সন্দেহ করা হয়। সে ক্ষেত্রে শুধু বেষ্টনী উঠিয়ে দিয়ে হতাহতের ঘটনা বন্ধ করা দুষ্কর।

খাতাপত্রে যাই থাক, ভাসানচরে নোয়াখালী অঞ্চলের বাসিন্দাদের প্রায় অবাধ চলাচল আছে। তবে রোহিঙ্গা শিবিরের পাশাপাশি ভাসানচরে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটি ঘাঁটি আছে। এই চরে ত্রাণকর্মী ও বিদেশিদের চলাচলে বিধিনিষেধ আছে।

ভাসানচর থেকে রাতের আধারে নোয়াখালী চলাচলের সময় নৌকা ডুবিতে প্রাণহানির ঘটনাও মর্মান্তিক। তবে বাংলাদেশের দক্ষিণের সাগরঘেঁষা যেকোনো দ্বীপ থেকেই রাতের বেলা চলাচলের সময় নৌদুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনাও নতুন নয়।

এই প্রেক্ষিতে কক্সবাজার রোহিঙ্গা শিবিরে যারা অগ্নিকাণ্ডের সাথে জড়িত তাদের দমন করা জরুরি। শিবিরের বাসিন্দাদের সাথে নিয়ে দুষ্কৃতিকারীদের প্রতিরোধ করা জরুরি। ভাসানচরের বেলায় কেন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা রাতে চর থেকে মূল ভূখণ্ডে যাতায়াতের মতো মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয় তা বুঝে, তাদের নিরুৎসাহিত করতে যথাযথ প্রণোদনা ও পরিবেশ সৃষ্টিতে মনোযোগ দেওয়া দরকার।

অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ।

এই ধরনের রিপোর্টের সঙ্গে গ্রাউন্ড লেভেলের খুব একটা সম্পর্ক আছে বলে আমি মনে করি না। হয়তো মানুষের কথা শুনে এভাবে তারা লিখেছে। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের মতো একটা দেশ ভুটানের চেয়েও বড় একটা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়েছে। সেখানে এখন পর্যন্ত নিরাপত্তাহীনতার বড় ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। ছোটখাটো কিছু ঘটনা ঘটেছে। আমেরিকা কিংবা ইউরোপের মতো দেশে শরণার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের যে ঘটনাগুলো ঘটে আমাদের এখানে এখনো তা দেখিনি।

ফারহা কবির

কান্ট্রি ডিরেক্টর, অ্যাকশন এইড

ফারহা কবির।

নাগরিকেরা তার নিজের দেশে যেভাবে থাকে, শরণার্থী হিসেবে অন্য দেশে সেভাবে থাকে না। আমাদের এত জনসংখ্যার একটা দেশ, এখানে রোহিঙ্গারা পাঁচ বছর ধরে আছে। আমাদের সাধ্যমতো তো চেষ্টা চলছে। তাই মন্তব্য করার আগে বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে অন্য দেশে রিফিউজিদের কীভাবে রাখা হয়। উন্নত দেশের দিকে যারা ধাবিত হচ্ছে, তারা শরণার্থীদের জন্য কতটুকু করতে পারবে, এটা বিবেচনায় রাখতে হবে।

নিজেদের পর্যবেক্ষণে আমেরিকার কাছে এটা মনে হতে পারে। কিন্তু আমার কথা হলো কোন স্ট্যান্ডার্ডের কথা বলছি। আন্তর্জাতিকভাবে সব রিফিউজির মানবাধিকার নিশ্চিতে সব ধরনের প্রচেষ্টাকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। মানুষ হিসেবে তাকে চিহ্নিত করতে হবে। তার পাশে দাঁড়াতে হবে।

আমি মনে করি, রোহিঙ্গা শিশু এবং তরুণদের জন্য সহযোগিতা বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ। উদ্বাস্তু পরিস্থিতিতে তারা অনিশ্চয়তা নিয়ে জীবনযাপন করছে যা তাদের শারীরিক, মানসিকসহ সার্বিক সুস্থতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তাই শিক্ষা প্রদান জরুরি। অন্যথায় শিক্ষাবঞ্চনার প্রভাব গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে।

আসিফ মুনির

শরণার্থী বিশেষজ্ঞ

আসিফ মুনির।

বাংলাদেশ সরকার কীভাবে বিষয়টি দেখছে প্রথম সেটা দেখা দরকার। সরকার জাতিসংঘের রিফিউজি কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি। তাই জাতিসংঘের আইনকানুন মানার আন্তর্জাতিকভাবে বাধ্যবাধকতা নেই। তবে বাংলাদেশ বলে থাকে, দেশে অবস্থানরত যেকোনো ব্যক্তির যেটুকু অধিকার প্রাপ্য সেটুকু দেয়া হবে। সেখানে দৃষ্টিভঙ্গিটা এমন-সরকারের মনে হচ্ছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোহিঙ্গারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণ হতে পারে। তারা যে আইনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি হতে পারে, ব্যক্তি হিসেবে এ ব্যাপারে আমার মত হল, এটা একটা ধারণা মাত্র। প্রমাণিত না।

একটা জায়গায় ঘনবসতি আছে। ঘনবসতির কারণে কিছু কিছু বিশৃঙ্খলা হতে পারে। সশস্ত্র গোষ্ঠীর যেসব ঘটনা আমরা শুনেছি, তারা কিন্তু ক্যাম্পের ভেতরেই করে। তারা অনেক সময় অন্য রোহিঙ্গাদেরও জিম্মি করেছে। চুরিডাকাতি করেছে। এদের কিছু কিছু অংশ সুযোগ বুঝে ভাসানচরেও চলে গেছে। এসব ঘটছে ক্যাম্পের ভেতরে। এখন সরকার ভাবছে রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের বাইরে আসলে আইনশৃঙ্খলার ক্ষতি হতে পারে।

ভাসানচরের ব্যাপারটা আরেকটু স্পর্শকাতর। একটা দ্বীপ। চারদিকে পানি। স্বাভাবিক চলাচল খুব একটা সহজ না। এখন কক্সবাজারেও চলাচল সীমিত করা হয়েছে। তবু সেখানে কিন্তু তারা বাইরে আসছে। গত কয়েক দিনে সংবাদমাধ্যমে দেখলাম, কক্সবাজারে ক্যাম্পের বাইরে আসার জন্য ৫০০ রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে।

তাই তারকাটা দিয়ে মানুষের চলাচল বন্ধ করা যাবে, ব্যাপারটা এমন না। নজরদারি দরকার।ভাসানচরে এটা কঠিন। চারদিকে পানি থাকায় তারকাটার বেষ্টনী দিয়ে বের হলেও দ্বীপের বাইরে যাওয়ার জন্য তাদের অন্য রকম সহায়তা নিতে হবে। অনেক সময় নৌকা নিয়ে তারা দ্বীপের বাইরে গেছে।

এটা সরাসরি মানবাধিকার লঙ্ঘন বলতে চাই না। কারণ তাদের সবকিছুতে যে বাধা দেয়া হচ্ছে, সেটা হয়তো না। কিন্তু আমি যদি এমন ব্যবস্থা রাখি তারা সব জায়গায় যাবে বা যাবে না, তাহলে নিয়ন্ত্রণটা আমার হাতে থাকতে হবে। প্রয়োজনবোধে তাদের চলাচলের কিছু সুযোগ করে দিতে হবে। সেটা অনানুষ্ঠানিকভাবে সরকার কিছুটা দেয় বলেও আমি শুনেছি। মাঝে মাঝে তারা ভাসানচর থেকে মেইনল্যান্ডে যেতে পারে। কিন্তু মানুষ তো; তখন তারা অনেকে পালিয়ে যান। তাই তদারকি থাকা দরকার।

আমার যেটা মনে হয় কিছু বিধিনিষেধ চাপিয়ে দিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। রোহিঙ্গাদের মধ্যে সরকারের প্রতিনিধিত্ব তৈরি করা উচিত। তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা দরকার। কক্সবাজারে যে এপিবিএন কাজ করছে, তারা কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে কিছুটা চেষ্টা করেছে। সেক্ষেত্রে চলাচলের বিধিনিষেধটা কিছুটা শিথিল হতে পারে। এটা ভাসানচরেও করা যেতে পারে।

রোহিঙ্গারা নিজেদের মধ্যে মনিটর করবে। কেউ বেআইনিভাবে কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কি না, সেটা তারা দেখবে। সরকারও পর্যবেক্ষণ করবে। বিভিন্ন কারণে একজন ব্যক্তির অন্য জায়গায় চলাচলের প্রয়োজন হতে পারে। শুধুমাত্র ত্রাণের ওপরে একজন মানুষ বছরের পর বছর, মাসের পর মাস এক জায়গায় থাকতে পারে না। অনুমতি সাপেক্ষে বাইরে যাওয়ার একটা নিয়মকানুন থাকা উচিত। যেকোনো মানুষের ওপর বলপূর্বক আমি যদি বিধিনিষেধ আরোপ করি, সেটা অন্যায়। কার্যকরীও হবে না।

মুহিবুল্লাহসহ কয়েক জনকে ক্যাম্পের ভেতর হত্যা করা হয়েছে। এটি দুঃখজনক। মুহিবুল্লাহর পরিবার কানাডায় চলে গেছে। অন্য পরিবারগুলো ক্যাম্পে নিরাপদ না। কোনো দেশ যদি তাদের আশ্রয় দেয়ার ব্যাপারে ভূমিকা গ্রহণ করে, সেটি ভালো পদক্ষেপ। তবে তার আগে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার যাচাই-বাছাই করা উচিত।

কোন কারিকুলামের ভিত্তিতে ক্যাম্পের শিশুরা শিক্ষাগ্রহণ করতে পারবে সে ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার দেনদরবার চলছিল। বন্ধ হওয়াটা সাময়িক। সরকারি অনুমোদনের বাইরে গিয়ে যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দিচ্ছে, তাদেরগুলো বন্ধ করা হয়েছে। কেউ যদি ব্যক্তি উদ্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করেন, তাহলে সেখানে কী পড়ানো হচ্ছে, কী পড়ানো হবে এগুলোর তালিকা থাকতে পারে। রিপোর্টিংয়ের ব্যবস্থা থাকতে পারে সরকারের কাছে। আমরা আশা করবো, বন্ধ না করে যারা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যুক্ত, তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হোক। সরকারিভাবে যে উদ্যোগের কথা আমরা শুনছিলাম, সেটিও চালু রাখা দরকার।

শাফকাত মুনির

সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ

শাফকাত মুনির।

রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে আমরা উদ্বেগজনক পরিস্থিতি লক্ষ্য করছি। সেখানে আইনশৃঙ্খলার অবনতির ব্যাপারে বেশ কিছুদিন থেকে শঙ্কার কথা শোনা যাচ্ছে। আমরা মনে করি, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা পরিস্থিতির ব্যাপারে আরও গভীর বিশ্লেষণ দরকার। সেখানে নিরাপত্তা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে অবনতি ঘটেছে, সেটা সংশোধনে পদক্ষেপ নেয়ার দরকার। এই মুহূর্তে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে যত দ্রুত সম্ভব তাদের দেশে ফেরত পাঠানো অনেক বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। তাদের দ্রুত দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও জোরালো ভূমিকা নেয়া প্রয়োজন। এর আগেও আমরা বলেছি, দেশের শীর্ষ পর্যায় থেকেও বলা হয়েছে যতদিন তারা বাংলাদেশে থাকবে, নিরাপত্তা সমস্যা তত বাড়বে।