“উই উইল নট গো কোয়াইটলি ইনটু দ্য নাইট, উই উইল নট ভ্যানিশ উইদাউট আ ফাইট, উই আর গোইং টু লিভ অন, উই আর গোইং টু সারভাইভ, টুডে উই সেলিব্রেট আওয়ার ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে।” (we will not go quietly into the night, we will not vanish without a fight, we are going to live on, we are going to survive, today we celebrate our independence day.)
বিল পুলম্যান ওরফে থম্যাস জে হুইটমোর, রূপোলী পর্দায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট মানব সভ্যতাকে ভিনগ্রহের প্রাণী বা এলিয়েনদের আক্রমণের হাত থেকে বাঁচানোর আগে গোটা দুনিয়ার মানুষের সামনে এই বক্তৃতাটি করেন। কাল্পনিক কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের এর থেকে জনপ্রিয় স্পিচ বোধহয় নেই। ‘ইন্ডিপেন্ডেস ডে’-র বিল পুলম্যান হোক বা ‘এয়ার ফোর্স ওয়ান’-এর হ্যারিসন ফোর্ড, বলাই যায় হলিউডের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিয়ে কল্পনার শেষ নেই। হলিউড ও প্রেসিডেন্ট এই দুয়ের সম্পর্ক বিচিত্র। যেমন সত্যিই রোনাল্ড রেগান-এর মতো নায়ক প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, বহু বায়োপিক হয়েছে আব্রাহাম লিঙ্কন-এর, তেমনি নানা সিনেমায় দেখা গেছে কাল্পনিক রাষ্ট্রপতি চরিত্রও। প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র ও তাদের কীর্তিকলাপের মধ্যে দিয়ে আঁচ পাওয়া যায় কী ভাবছে হলিউড যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে, কেমন নেতাকেই বা দেখতে চায়, বা কেমন হওয়া উচিত। দেখা গেছে, আফ্রিকান-আমেরিকান থেকে মহিলা প্রেসিডেন্ট চিত্রায়নে হলিউডের কল্পনা সময়ের থেকে এগিয়েই থেকেছে এক কদম। বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার এক দশক আগে মর্গান ফ্রিম্যান প্রেসিডেন্টের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ‘ডিপ ইমপ্যাক্ট’ সিনেমায়। তেমনি কামালা হ্যারিস ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার এক দশক আগেই ‘ভিপ’ নামের জনপ্রিয় সিরিজ-এ দেখা গেছে জুলিয়া লুইস-ড্রাইফাসকে ভাইস-প্রেসিডেন্টের চরিত্রে। যুক্তরাষ্ট্রের সত্যিকারের প্রেসিডেন্ট-এর বায়োপিক-এ যেমন অভিনয় করেছেন বিখ্যাত নায়কেরা তেমনি কাল্পনিক প্রেসিডেন্ট-এর চরিত্রে অভিনয় করা জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীর সংখ্যাও কম নয়। হেনরি ফন্ডা থেকে মাইকেল ডগলাস, জিন হ্যাকম্যান থেকে শার্লিজ থেরন অনেকেই ওভাল অফিসের দায়িত্ব সামলেছেন সিনেমায়। প্রেসিডেন্টস ডে উপলক্ষ্যে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পাঁচটি চরিত্রায়ন যা জনপ্রিয় হয়েছে এবং মনে রেখেছেন দর্শক তাদের দেখা যাক।
৬১তম কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে "সারভিলেন্স" ছবির জন্য পোজ দিচ্ছেন কাস্ট সদস্য বিল পুলম্যান।২১মে,২০০৮। (ছবি-রয়টার্স/ ঝাঁ-পুল পেলিসিয়ে(ফ্রান্স)
সিনেমা: ‘ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে’ (১৯৯৬)
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট চরিত্রে: বিল পুলম্যান
এই সায়েন্স ফিকশন ছবিতে দেখা গেছে পৃথিবীর বুকে নেমে আসছে এলিয়েনদের বা ভিনগ্রহী প্রাণীদের আক্রমণ, তারা ধ্বংস করে দিতে চায় মানব সভ্যতা। সেই ভয়াবহ আক্রমণের বিরুদ্ধে যখন মানুষের সমস্ত অস্ত্র বিফল হচ্ছে তখন এক স্যাটেলাইট বৈজ্ঞানিক এগিয়ে আসেন বাঁচাতে। আর থম্যাস জে হুইটমোর, যুক্তরাষ্ট্রের কাল্পনিক প্রেসিডেন্ট, নিজে ফাইটার প্লেন চালিয়ে তাকে সঙ্গ দেন। এই সিনেমায় পুলম্যানকে দেখা যায় একজন প্রাক্তন এয়ারফোর্স পাইলট হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট-এর ক্ষেত্রে নিজে যুদ্ধে যাওয়াটা কাল্পনিক হলেও সত্যিই সামরিক অভিজ্ঞতা বাস্তবের প্রেসিডেন্টদের ছিল না তা নয়, ডোয়াইট আইজেনহাওয়ার স্বয়ং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রখ্যাত সেনাপতি, অ্যালায়েড আর্মির কমান্ডার ইন চিফ ছিলেন। রিচার্ড নিক্সন থেকে জে এফ কেনেডি প্রত্যেকেই কোনো না কোনো সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গনে ছিলেন। পুলম্যান-এর প্রেসিডেন্ট অবশ্য বিখ্যাত হননি সে কারণে, বরং তাকে মনে রাখার কারণ পৃথিবীকে বাঁচানোর আগে বক্তৃতাটি। যা কাল্পনিক হলেও কোনো প্রকৃত বিশ্বনেতার স্পিচ-এর মতোই স্মরণীয়।
লস অ্যাঞ্জেলেসে নতুন চলচ্চিত্র "দ্য ইংলিশ পেশেন্ট" এর প্রিমিয়ারের জন্য অতিথি হিসাবে উপস্থিত হন অভিনেতা হ্যারিসন ফোর্ড।
সিনেমা: এয়ারফোর্স ওয়ান (১৯৯৭)
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট চরিত্রে: হ্যারিসন ফোর্ড
ঠান্ডা যুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবীতে উগ্রপন্থীরা এয়ারফোর্স ওয়ান হাইজ্যাক করে নেয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেমস মার্শাল রূপী ফোর্ড সমেত। জেমস মার্শাল ভিয়েতনাম যুদ্ধের অভিজ্ঞ প্রেসিডেন্ট, বিমান থেকে পালানোর সুযোগ পেলেও পালান না। বরং তিনি নিজে প্রায় একা হাতে নিজ পরিবার ও বিমানের বাকিদের উদ্ধার করেন। এয়ার ফোর্স ওয়ান হাইজ্যাক হওয়ার মতো অলীক চিত্রনাট্য থাকলেও এবং হ্যারিসন ফোর্ড একা লড়াই করে প্রায় ইন্ডিয়ানা জোন্স বা হানস সোলোর মতো সবাইকে বাঁচাচ্ছেন এমন সোজাসাপ্টা গল্প হলেও, হ্যারিসন ফোর্ড-এর অভিনয় ক্ষমতার জন্য চরিত্রটি বিশ্বাসযোগ্য ও স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
ব্রাসিলিয়ার পালমারেস সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট এক বিতর্কের সময় একটি প্রশ্ন নিয়ে ভাবছেন আমেরিকান অভিনেতা মরগান ফ্রিম্যান। ২৩ এপ্রিল, ২০০২। (ছবি-রয়টার্স/জামিল বিত্তর)
সিনেমা: ডিপ ইমপ্যাক্ট (১৯৯৮)
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট চরিত্রে: মর্গান ফ্রিম্যান
বিশ্বাসযোগ্যতার দিক থেকে ফোর্ড-এর থেকেও যার নাম আগে আসবে তিনি অবশ্যই মর্গান ফ্রিম্যান। এই সিনেমা ডিজাস্টার মুভি হিসেবে যত না জনপ্রিয় তার থেকেও মর্গান ফ্রিম্যান প্রেসিডেন্ট টম বেক হিসেবে অনন্য। তার উপস্থিতি, বাচনভঙ্গি, অভিনয় দক্ষতায় ভুলিয়ে দেন যে সত্যি তিনি প্রেসিডেন্ট নন। আরেকটা কারণেও উল্লেখযোগ্য এই চরিত্রায়ন বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার এক দশক আগেই আফ্রিকান আমেরিকান একজন প্রেসিডেন্ট কল্পনা করেছিল হলিউড।
ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসে ১৯তম বার্ষিক স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড অ্যাওয়ার্ডে "লিঙ্কন"-এর জন্য প্রধান চরিত্রে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য পুরস্কার জেতার পর মঞ্চের পেছনে ছবি তোলার জন্য দাঁড়িয়েছেন অভিনেতা ড্যানিয়েল ডে-লুইস। (ছবি- রয়টার্স /আদ্রিস লতিফ)
সিনেমা: লিঙ্কন (২০১২)
যুক্তরাষ্টের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন-এর চরিত্রে: ড্যানিয়েল ডে লুইস
অ্যাব্রাহাম লিঙ্কনকে নিয়ে হলিউডে কম সিনেমা হয়নি, সেই সাদা-কালো সিনেমার হলিউড গোল্ডেন এরা থেকে আজ পর্যন্ত বহু সিনেমাই হয়েছে, এমনকি একটা কাল্পনিক সিনেমা পর্যন্ত হয়েছে যেখানে প্রেসিডেন্ট একজন ভ্যাম্পায়ার স্লেয়ার। কিন্তু যে সিনেমা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তা হল ২০১২ সালে স্টিভেন স্পিলবার্গ-এর তৈরি ‘লিঙ্কন’। লিঙ্কনের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন ড্যানিয়েল ডে লুইস, তাঁর জীবনের সেরা অভিনয়ের একটি যার জন্য তিনি সেরা অভিনেতার অ্যাকাডেমি পুরস্কার বা অস্কার পান। অস্কারজয়ী এই চরিত্রায়ন উল্লেখযোগ্য কারণ এই সিনেমায় লিঙ্কনের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় দেখানো হয়েছে। আমেরিকান সিভিল ওয়ারের সময় থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত যে টালমাটাল সময়ের মধ্যে দিয়ে তিনি গেছেন ও তৈরি করেছেন ইতিহাস তা জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে ড্যানিয়েল ডে লুইসের অভিনয় দক্ষতায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াতে ইউনিভার্সাল সিটির ইউনিভার্সাল স্টুডিওস ব্যাকলটে চার্লিজ থেরন আফ্রিকা আউটরিচ প্রজেক্ট (CTAOP) এর জন্য একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সেখানে পৌঁছেছেন অভিনেতা শার্লিজ থেরন। ২৬ জুন, ২০২১।(ছবি-রয়টার্স /মারিও আঞ্জুনি)
সিনেমা: লং শট (২০২১)
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি চরিত্রে: শার্লিজ থেরন
প্রেসিন্ডেন্সিয়াল ইলেকশান-এর সমস্ত বাধাবিঘ্ন কাটিয়ে শার্লট ফিঞ্চ নামের এক মহিলার প্রেসিডেন্ট হয়ে ওঠা নিয়ে এক রমকম সিনেমা, যার মুখ্য চরিত্রে শার্লিজ থেরন। রমকম হলেও তাতে আধুনিক নারীমুক্তি ও মহিলাদের অধিকারের দিকগুলোও উঠে এসেছে কমেডির মধ্যে দিয়ে। যেমন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর শার্লট তার প্রেমিককে বিয়ে করেন এবং দেখানো হয় পদবী বদলে তিনি ‘ফার্স্ট মিস্টার’ হিসেবে হোয়াইট হাউজ-এ যাচ্ছেন। নজরকাড়া আরেকটি বিষয় হল এখানে কাল্পনিক প্রেসিডেন্ট শার্লট ফিঞ্চকে দেখানো হয়েছে সেক্রেটারি অফ স্টেট থেকে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য লড়ছেন, অনেকটা যেন বাস্তবের হিলারি ক্লিন্টন-এর মতো।
সায়েন্স ফিকশান থেকে রোম্যান্টিক কমেডি, অ্যাকশান অ্যাডভেঞ্চার থেকে কঠিন বাস্তব, নানা সিনেমা ও সিরিজে হলিউড নানা কল্পকাহিনীতে দেখতে চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে, তৈরি হয়েছে অনেক সিনেমা ও সিরিজ। এই লেখায় মূলত ফিচার ফিল্ম বা পূর্ণ দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় কয়েকটির কথাই উঠে এল। কিন্তু এর বাইরেও রয়েছে এমন বেশ কয়েক’টি সিরিজ যেগুলিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট-এর চিত্রায়ন প্রবল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল – ১৯৯৯ সালের ‘দ্য ওয়েস্ট উইং’ যেখানে কাল্পনিক প্রেসিডেন্ট জেড বার্টলেট-এর চরিত্রে ছিলেন মার্টিন শিন; ২০১২ সালে তৈরি হওয়া ‘ভিপ’ সিরিজে ছিল কাল্পনিক চরিত্র প্রাক্তন সেনেটর সেলিনা মেয়ার-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়ে ওঠার গল্প, যার মূল চরিত্রে ছিলেন জুলিয়া লুইস-ড্রাইফাস এবং মনে রাখতে হবে কামালা হ্যারিস যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম মহিলা ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রায় এক দশক আগে তৈরি হয়েছিল সিরিজটি; ২০১২-তেই তৈরি হওয়া সিরিজ ‘স্ক্যান্ডাল’, যেখানে প্রেসিডেন্ট-এর চরিত্রে ছিলেন টনি গোল্ডউইন; ২০১৩ সালের সিরিজ ‘হাউজ অফ কার্ডস’ যেখানে কেভিন স্পেসি ও রবিন রাইট অভিনয় করেছেন যথাক্রমে কাল্পনিক প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্ক আন্ডারউড ও ক্লেয়ার আন্ডারউড-এর চরিত্রে। এছাড়া আমেরিকান টেলিভিশন-এ সাপ্তাহিক বিভিন্ন কমেডি শোগুলিতেও বহু সময়েই পরিচিত কৌতুকাভিনেতারা প্রেসিডেন্ট-এর ভূমিকায় নানা উপস্থাপনা করে থাকেন। সুতরাং, নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে আগামী দিনেও যুক্তরাষ্ট্রের বাস্তবের প্রেসিডেন্টদের নিয়ে যেমন তৈরি হবে বায়োপিক, তেমনি বর্ণময় কাল্পনিক প্রেসিডেন্টদের দেখা যাবে সিনেমায়, সিরিজে... আসল প্রেসিডেন্টদের মতোই।